বৃহস্পতিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫

পেয়ারার পুষ্টিমান ও উপকারিতা





পেয়ারা ব্যাপক জনপ্রিয় গোটা এশিয়ায়। সুস্বাদু এই ফলের চিকিৎসা গুণের জন্যই প্রচুর পেয়ারা খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, ডায়াবেটিস রুখতে পেয়ারার বিকল্প হয় না। আবার পেয়ারার পাতা রক্তচাপ, হৃদরোগে কাছে ঘেঁসতে দেয় না। 
পেয়ারাকে (guava) ভিটামিনের গুপ্তধন বলা যায়। এতে রয়েছে Anti-oxidant সহ  নানা ধরণের ভিটামিন, যা আমাদের শরীরের বিভিন্ন উপকার করে থাকে। এজন্যেই  তো পেয়ারাকে 'super food' বলে ডাকা হয়।




বিজ্ঞানীরা বলছেন, ফলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিটামিন ও মিনারেল থাকে পেয়ারায়। বিশেষ করে ভিটামিন সি। অনেকের ধারণা লেবুতে সবচেয়ে বেশি ভিটামিন থাকে। কিন্তু বহু লোক জানেন না, একটি পেয়ারায় লেবুর চারগুণ বেশি ভিটামিন সি থাকে। প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ সমৃদ্ধও পেয়ারা। পাতিলেবুর চেয়ে ১০ গুণ বেশি ভিটামিন এ থাকে পেয়ারায়। এছাড়াও পেয়ারায় থাকে ভিটামিন B2, ভিটামিন K এবং Eশুধু ভিটামিনই নয়, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফেরাস, লোহা, তামা, ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়ামের মতো প্রচুর খনিজও থাকে এই ফলে।

পেয়ারা পাতায় কিছু প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক রয়েছে, যা প্যাথোজেনস মেরে ফেলে। প্যাথোজেনস-এর জন্যই ডায়রিয়া হয়। একই সঙ্গে রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে ও হার্ট ভালো রাখতেও সাহায্য করে পেয়ারা পাতার নির্যাস। সুতরাং পেয়ারা ও পেয়ারা পাতার নির্যাস নিয়মিত খেতে পারলে, রোগ নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না।



পেয়ারার পুষ্টিগুনঃ  

উপাদান
পরিমাণ
ক্যালরি
৭ গ্রাম
ভিটামিন
২৫০ আই ইউ
থায়ামিন
০.০৭ গ্রাম
নিয়াসিন
১.২ মিলিগ্রাম
ভিটামিন সি
৩০২ মিলিগ্রাম
ক্যালসিয়াম
৩০ মিলিগ্রাম
ফসফরাস
২৯ মিলিগ্রাম
কার্বোহাইড্রেট
১৭.১০ গ্রাম
প্রোটিন
১ গ্রাম
মিনারেল
১০০ গ্রাম
পানি
৮০-৮৩ %
অম্ল
২.৪৫ %
বিজারিত চিনি
৩.৫০ ৪.৪৫ %
অবিজারিত চিনি
৩.৯৭ ৫.২৩ %
দ্রবণীয় শুষ্ক পদার্থ
৯.৭৩ %
পটাশিয়াম
০.৪৮ %




পেয়ারার উপকারিতাঃ

১।  শরীরের অতিরিক্ত শর্করা শুষে নিতে পারে পেয়ারা৷ এছাড়াও এতে যে ফাইবার রয়েছে তা বেশ উপকারি৷ এই বিশেষ ফলটি টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে সক্ষম৷
২।  পেয়ারাতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন সি ও লাইকোপিন রয়েছে৷ এর ফলে রক্ত পরিষ্কার হয় ও ত্বক অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়৷ এছাড়াও লাইকোপিনের সাহায্যে গালে গোলাপী আভা ফুটে ওঠে৷
৩। পেয়ারায় অবস্থিত ভিটামিন সি বিভিন্ন ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে৷ এছাড়াও এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সক্ষম৷
৪।  পেয়ারাতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বর্তমান৷ এই জাতীয় ভিটামিন দৃষ্টি শক্তি বাড়াতে সক্ষম৷
৫। যেকোনো ব্যকটেরিয়া সংক্রমণ বা পেটের গোলযোগে সবচেয়ে কার্যকরী হল পেয়ারা৷ এই ফলটিতে অ্যাস্ট্রিজেন্ট ও অ্যান্টি-মাইক্রোবাল উপাদান থাকে ফলে এটি পাকস্থলীর স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে৷
৬।  পেয়ারাতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে৷ এটি শরীরের অতিরিক্ত রক্তপাচ কমাতে সাহায্য করে ও রক্তচাপকে স্বাভাবিক রাখে৷
৭।  যারা ওবেসিটির শিকার বা যাদের ওজন অতিরিক্ত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তারা পেয়ারা খেতে পারেন৷ পেয়ারা খেলে শরীরের অতিরিক্ত ওজন খুব সহজেই ঝড়ানো যেতে পারে৷
৮।  হাই ব্লাডপ্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। অনেক দিন ধরে মেনস্ট্রুয়েসন-এর সমস্যায় পেয়ারা উপকারী।
৯।  অ্যাজমা, স্কার্ভি, ওবিসিটি ইত্যাদি অসুখের ক্ষেত্রেও পেয়ারা উপকারী। ডায়াবেটিসতো বটেই, ক্যান্সার এমন কি প্রস্টেট ক্যান্সারের মতো রোগ প্রতিরোধেও সাহায্য করে পেয়ারা। কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট ও ফাইবারসমৃদ্ধ পেয়ারা ব্লাড সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
১০।  পেয়ারা পাতার জুস গ্যাস্ট্রোনটেস্টিনাল সমস্যায় উপকারী। কারণ, পেয়ারা পাতায় রয়েছে শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। এ ছাড়া পেয়ারা পাতা ওজন কমাতে সাহায্য করে। পেয়ারা পাতার জুস সর্দি-কাশি উপশমে সাহায্য করে। আয়রন ও ফাইবারে সমৃদ্ধ পেয়ারা কনস্টিপেশন সারাতে উপকারী
১১।  অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ পেয়ারা ত্বকের বুড়িয়ে যাওয়া রুখতে সাহায্য করে। একই কারণে অনেক বডি লোশন বা ফেস ক্রিমের উপাদানে পেয়ারা থাকে।
১২।  বয়সের সঙ্গে জড়িত নানা রোগ, যেমনঅ্যালজাইমার, ছানি, রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস প্রতিরোধে সাহায্য করে। অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদানে সমৃদ্ধ পেয়ারা ডিসেন্ট্রি প্রতিরোধ করে।
১৩।  পেয়ারাতে ভিটামিন এ, বিটাক্যারোটিন, লাইকোপিন, লুটিন এবং ক্রিপ্টোজ্যান্থিন বিদ্যমান। সুস্থ দেহের জন্য এসব উপাদান অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যারা ফুসফুস এবং মুখগহবরে ক্যান্সার হওয়া প্রতিরোধ করে।
১৪।  পেয়ারাতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি বিদ্যমান। অনেকে বাইরের সবুজ ত্বক খেতে চান না। কিন্তু ভিতরের শাঁস অপেক্ষা বাইরের ত্বকেই বেশি ভিটামিন বিদ্যমান। ভিটামিন সি নিয়মিত গ্রহণ করলে শরীরে যেকোনো ক্ষত হতে ঘা সৃষ্টি (ইনফেকশান) হওয়ার আশংকা অনেকাংশে কমে যায়, কোলাজেন সংশ্লেষণের হার ঠিক থাকে, যা রক্তনালি, ত্বক, বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দৃঢ় রাখতে সহায়তা করে।
১৫।  পেয়ারার লাইকোপিন সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি হতে ত্বককে রক্ষা করে এবং প্রস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।



১৬।  পেয়ারায় আরও রয়েছে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স (প্যান্টোথেনিক এসিড, নিয়াসিন, পাইরিডক্সিন), ভিটামিন ই, ভিটামিন কে, এবং কয়েকরকম খনিজ (ম্যাগনেশিয়াম, কপার এবং ম্যাঙ্গানিজ)। কপার লৌহ রক্ত কণিকা উৎপাদনে সহায়তা করে, ম্যাঙ্গানিজ এন্টিঅক্সিডেন্ট এনজাইমের সহকারী হিসেবে কাজ করে।
১৭।  পেয়ারায় ক্যালরি এবং ফ্যাট বলতে গেলে একেবারেই নেই। তবে তা ভিটামিন, মিনারেল এবং এন্টিঅক্সিডেন্ট (পলিফেনোলিক ও ফ্ল্যাভেনয়েড) সমৃদ্ধ যা ক্যান্সার প্রতিরোধে অত্যন্ত সহায়ক। শরীরের চামড়ায় ভাঁজ পড়া প্রতিরোধেও এর ভূমিকা মুখ্য।
১৮।   চুল পড়া রোধ করেঃ   পেয়ারার ভিটামিন সি চুল পড়া রোধে বিশেষভাবে কার্যকরী। এছাড়াও প্রতিদিন মাত্র ১ টি পেয়ারা খেলে চুল গজানোতে সহায়তা করে।
১৯।   মস্তিস্কের সুরক্ষা করেঃ   পেয়ারা আমাদের মস্তিষ্ক সুরক্ষায় কাজ করে। পেয়ারার ভিটামিন বি৩ এবং বি৬ আমাদের মস্তিস্কের নার্ভ রিলাক্স করতে সহায়তা করে। এতে মস্তিস্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
২০।   নার্ভ ও মাংসপেশি শিথিল করেঃ  পেয়ারাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম যা অনেক কঠিন পরিশ্রমের পরও আমাদের মাংসপেশি শিথিল করতে সহায়তা করে। এছাড়াও নার্ভ রিলাক্স করে, এতে করে আমরা আরামবোধ করি।
২১। থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণ করেঃ   পেয়ারায় কপার থাকায় তা থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া এটি হরমোনের উৎপাদন এবং শোষণ নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখে। থাইরয়েড আমাদের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থি, যা হরমোন উৎপন্ন করে এবং শরীরের নানা কার্যপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহন করে। পেয়ারা কপারের  একটি অন্যতম উৎস যা থাইরয়েডের মেটাবোলিজম (metabolism) প্রক্রিয়ার জন্যে  জরুরি। 
২২। ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করেঃ  এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে যা টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। কাজেই ডায়াবেটিসে সুস্থ থাকতে পেয়ারা খাওয়ার বিকল্প নেই। 

২৩।  কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করেঃ  ফাইবার সমৃদ্ধ পেয়ারা শরীরে পানি ধরে রাখে এবং অন্ত্রকে পরিষ্কার রাখে। ফলে সহজেই কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। 
২৪। স্নায়ুকে বিশ্রাম দেয়ঃ  পেয়ারা ম্যগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্য হওয়ায় তা স্নায়ুগুলোকে বিশ্রামে রাখতে সাহায্য করে। একইসঙ্গে এটি শরীরের মাংসপেশীগুলোকে বিশ্রামে রাখতে ভূমিকা পালন করে।
২৫। গর্ভবতী নারীদের জন্যঃ  ডাক্তাররা গর্ভবতী নারীদের বেশি করে পেয়ারা খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি৯ তথা ফলিক অ্যাসিড রয়েছে যা স্নায়ুজনিত যে কোন সমস্যা দূর করে গর্ভোজাত শিশুদের সুস্থ রাখে। 
২৬। গর্ভধারণ ক্ষমতা বাড়াতেঃ   পেয়ারা ফলেটের একটি বড় উৎস যা গর্ভধারণে সক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 
২৭। পুষ্টি গ্রহণেঃ  পেয়ারায় ম্যাঙ্গানিজ নামক উপাদান থাকায় তা দ্রুত পুষ্টি গ্রহণে সহায়তা করে। আমরা প্রতিনিয়ত যেসব খাবার খাই এগুলো থেকে প্রয়োজনীয় বায়োটিন, ভিটামিন এবং মিনারেল গ্রহণে সাহায্য করে এই খাবারটি। 
২৮। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণেঃ  পেয়ারা সর্দি-কাশি উপশমে সাহায্য করে। একইসঙ্গে এটি শ্বাসতন্ত্রের নানা সমস্যা প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখে।
২৯। তারুণ্য ধরে রাখেঃ  ভিটামিন এ, বি, সি এবং পটাশিয়ামের ভালো উৎস হলো পেয়ারা। এগুলো ত্বককে শুধু সুস্থ রাখতেই সাহায্য করে না, একইসঙ্গে ত্বকের তারুণ্যও বজায় রাখে।  
৩০। দাতেঁর যত্নেঃ  দাঁতের যে কোন সমস্যা যেমন-মাড়ি ফোলা এবং আলসার প্রতিরোধে সাহায্য করে পেয়ারা।  এক্ষেত্রে পেয়ারা পাতার রস বেটে খেলে ভালো উপকার পাওয়া যায়।
৩১।  আয়রণ ও ফাইবার সমৃদ্ধ পেয়ারা কনস্টিপেশান সারানোর জন্য উপকারী
৩২।  স্কার্ভি নামক রোগ থেকে বেঁচে থাকুন (Avoid scarvy by eating guava) 
পেয়ারাতে কমলার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি ভিটামিন 'সি' থাকে। আর ভিটামিন 'সি' 
স্কার্ভি নামক ভয়াবহ রোগ থেকে রক্ষা করে। এখন পর্যন্ত জানা উপায়গুলোর  মধ্যে স্কার্ভি (scarvy) প্রতিরোধে একমাত্র উপায় ভিটামিন 'সি' আর ভিটামিন  'সি' এর অন্যতম উৎস পেয়ারা। তাই স্কার্ভির মত রোগ থেকে বেঁচে থাকতে  সাহায্য নিন পেয়ারার। 





কোন মন্তব্য নেই: