রবিবার, ১ মে, ২০১৬

আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, ১ মে




আজকের এই সভ্যতায় বিশ্বের প্রতিটি দেশের সকল শ্রমিক, কর্মচারী, কর্মকর্তা প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা করে কাজ করে থাকেন । প্রতিদিন এই ৮ ঘণ্টা কাজের প্রতিশ্রুতি আদায় করতে অনেক রক্ত ঝরেছে শ্রমিকদের।

পূর্বে শ্রমিকদের অমানবিক পরিশ্রম করতে হত, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১ থেকে ১ ঘন্টা আর সপ্তাহে ৬ দিন। বিপরীতে মজুরী মিলত নগন্য, শ্রমিকরা খুবই মানবেতর জীবনযাপন করত, ক্ষেত্রবিশেষে তা দাসবৃত্তির পর্যায়ে পড়ত।   

অনিরাপদ পরিবেশে রোগ-ব্যধি, আঘাত, মৃত্যুই ছিল তাদের নির্মম সাথী। তাদের পক্ষ হয়ে বলার মত কেউ ছিলনা তখন। ১৮৬০ সালে শ্রমিকরাই মজুরি না কেটে দৈনিক ৮ ঘন্টা শ্রম নির্ধারনের প্রথম দাবি জানায়। কিন্তু কোন শ্রমিক সংগঠন ছিলনা বলে এই দাবী জোরালো করা সম্ভব হয়নি।



এই সময় সমাজতন্ত্র শ্রমজীবি মানুষের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। শ্রমিকরা বুঝতে পারে বনিক ও মালিক শ্রেণীর এই রক্ত শোষণ নীতির বিরুদ্ধে তাদের সংগঠিত হত হবে। ১৮৮০-৮১ সালের দিকে শ্রমিকরা প্রতিষ্ঠা করে Federation of Organized Trades and Labor Unions of the United States and Canada [১৮৮৬ সালে নাম পরিবর্তন করে করা হয় American Federation of Labor]

এই সংঘের মাধ্যমে শ্রমিকরা সংগঠিত হয়ে শক্তি অর্জন করতে থাকে। তারা এই সময়ের মধ্যে সংঘের আওতাধীন সকল শ্রমিক সংগঠনকে এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে সংগঠিত হওয়ার পুনঃ পুনঃ আহবান জানায়। প্রথম দিকে অনেকেই একে অবাস্তব অভিলাষ, অতি সংস্কারের উচ্চাকাংখা বলে আশংকা প্রকাশ করে। কিন্তু বনিক-মালিক শ্রেণীর কোন ধরনের সাড়া না পেয়ে শ্রমিকরা ধীরে ধীরে প্রতিবাদি ও প্রস্তাব বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে থাকে।

১৮৮৪ সালে সংঘটি '৮ ঘন্টা দৈনিক মজুরি' নির্ধারনের প্রস্তাব পাশ করে এবং মালিকও বনিক শ্রেণীকে এই প্রস্তাব কার্যকরের জন্য ১৮৮৬ সালের ১লা মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়।কিন্তু কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের এ দাবি কানে তোলেননি।  এ সময় এলার্ম নামক একটি পত্রিকার কলাম 'একজন শ্রমিক ৮ ঘন্টা কাজ করুক কিংবা ১০ ঘন্টাই করুক, সে দাসই' যেন জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢালে। শ্রমিক সংগঠনদের সাথে বিভিন্ন সমাজতন্ত্রপন্থী দলও একাত্মতা জানায়।

১লা মে এগিয়ে আসতে লাগল। মালিক-বনিক শ্রেণী অবধারিতভাবে ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল।
১লা মে - সমগ্র যুক্ত্ররাষ্ট্রে প্রায় ৩০০,০০০ শ্রমিক তাদের কাজ ফেলে এদিন রাস্তায় নেমে আসে। শিকাগোতে শ্রমিক ধর্মঘট আহবান করা হয়, প্রায় ৪০,০০০ শ্রমিক কাজ ফেলে শহরের কেন্দ্রস্থলে সমবেত হয়। অগ্নি গর্ভ বক্তৃতা, মিছিলে, মিটিং, ধর্মঘট, বিপ্লবী আন্দোলনের হুমকি সবকিছুই মিলে ১লা মে উত্তাল হয়ে উঠে। পার্সন্স, জোয়ান মোস্ট, আগস্ট স্পীজ, লুই লিং সহ আরো অনেকেই শ্রমিকদের মাঝে পথিকৃত হয়ে উঠেন। ধীরে ধীর আরো শ্রমিক কাজ ফেলে আন্দোলনে যোগ দেয়। আন্দোলনকারি শ্রমিকদের সংখ্যা বেড়ে দাড়ায় ১লক্ষ।  

৪ঠা মে ১৮৮৬ সালে সন্ধ্যাবেলা হালকা বৃষ্টির মধ্যে শিকাগোর হে-মার্কেট নামক এক বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকগণ মিছিলের উদ্দেশ্যে জড়ো হন। তারা ১৮৭২ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত এক বিশাল শ্রমিক শোভাযাত্রার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে এটি করেছিলেন। ১৮৭৭ সালে শ্রমিকরা একবার রেলপথ অবরোধ করলে পুলিশ ও ইয়ুনাইটেড স্টেটস আর্মি তাদের উপর বর্বর আক্রমন চালায়। ঠিক একইভাবে ১লা মে কে মোকাবেলায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রস্তুতি চলতে থাকে। পুলিশ ও জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়।   

আগস্ট স্পীজ জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলছিলেন। হঠাত দূরে দাড়ানো পুলিশ দলের কাছে এক বোমার বিস্ফোরন ঘটে, এতে এক পুলিশ নিহত হয় এবং ১১ জন আহত হয়, পরে আরো ৬জন মারা যায়। পুলিশবাহিনীও শ্রমিকদের উপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে যা সাথে সাথেই রায়টের রূপ নেয়। রায়টে ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন।

পুলিশ হত্যা মামলায় আগস্ট স্পীজ সহ আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়। এক প্রহসনমূলক বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লুইস লিং নামে একজন একদিন পূর্বেই কারাভ্যন্তরে আত্মহত্যা করেন, অন্যএকজনের পনের বছরের কারাদন্ড হয়। ফাঁসির মঞ্চে আরোহনের পূর্বে আগস্ট স্পীজ বলেছিলেন, আজ আমাদের এই নি:শব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে



এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। দেশে দেশে গড়ে ওঠে মেহনতি জনতার ঐক্য। অবশেষে শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগোর রক্তঝরা দিনটিকে স্বীকৃতি দিয়ে মে দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়।

১৮৮৯ সালে প্যারিসে ফরাসি বিপ্লবের একশো বছর পূর্তিতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেসে, শিকাগো শ্রমিক আন্দোলনের দিনটিকে ১৮৯০ সাল থেকে উদযাপনের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। পরের বছর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কংগ্রেসে প্রস্তাবনাটি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শ্রমিক আন্দোলনের পক্ষে যুক্তি খুঁজে পাচ্ছিলো ঠিক তখনই উন্মোচিত হয় শ্রমিক আন্দোলন ঘটনার এক মর্মান্তিক সত্য। ২৬শে জুন, ১৮৯৩ ইলিনয়ের গভর্ণর অভিযুক্ত আটজনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা দেন, এবং রায়টের হুকুম প্রদানকারী পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। প্রমাণিত হয় পুলিশের ওপর বোমা হামলার দায়ে শাস্তিপ্রাপ্ত অগাস্ট স্পিস ও বাকি সাতজন মূলত দায়ী ছিলেন না, তারা ছিলেন নির্দোষ। তবে আসল অপরাধীকে শনাক্ত করা যায়নি।

যাই হোক, ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন স্থ‍ানে শ্রমিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়তে থাকে। ১৯০৪ সালে নেদারল্যান্ডের আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবি আদায় এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বব্যাপী মে মাসের প্রথম দিন মিছিল ও শোভাযাত্রার আয়োজন করতে সব সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল ও শ্রমিক সংঘের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

এ আহ্বানের সাড়া হিসেবে বিশ্বের প্রায় সব শ্রমিক সংগঠন ০১ মে বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক দেশের শ্রমিকরা মে মাসের ০১ তারিখকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালনের দাবি জানায়। বিভিন্ন দেশে মে দিবস সরকারিভাবে ছুটির দিন হিসেবে উদযাপিত হতে থাকে। ধীরে ধীরে রাশিয়া, চীন, বাংলাদেশ ও ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই দিনটির তাৎপর্য ছড়িয়ে পড়ে।

 ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হচ্ছে মে দিবস।

আমেরিকা ও কানাডাতে অবশ্য সেপ্টেম্বর মাসে শ্রম দিবস পালিত হয়। সেখানকার কেন্দ্রীয় শ্রমিক ইউনিয়ন এবং শ্রমের নাইট সংগঠন ছিল এই দিন পালনের উদ্যোক্তা। হে মার্কেটের হত্যাকাণ্ডের পর আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড মনে করেছিলেন পয়লা মে তারিখে যে কোনও আয়োজন হানাহানিতে পর্যবসিত হতে পারে। সে জন্য ১৮৮৭ সালেই তিনি নাইটের সমর্থিত শ্রমজীবী দিবস পালনই চালু করেন।