বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৫

স্ট্রবেরি চাষ ও পুষ্টিমান




স্ট্রবেরি (Fragaria ananasa) হচ্ছে Rosaceae পরিবারভুক্ত একটি গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। স্ট্রবেরি মূলত শীত প্রধান অঞ্চলের ফল। স্ট্রবেরি শীতকালীন দেশের ফল হলেও বর্তমানে বাংলাদেশের যেসব এলাকায় শীত বেশি পড়ে ও অনেক দিন স্থায়ী হয় সেসব এলাকায় বারি স্ট্রবেরি-১ নামে একটি উচ্চফলনশীল জাতের স্ট্রবেরি চাষ করা হচ্ছে।

স্ট্রবেরির পাকা ফল টকটকে লাল রঙের হয়। এ ফলটি সুগন্ধিযুক্ত, টক ও মিষ্টি স্বাদের অত্যন্ত রসালো ও সুস্বাদু ফল।  



স্ট্রবেরী গাছ দেখতে অনেকটা থানকুনি অথবা আলুর গাছের মত, তবে পাতা আরো বড় এবং চওড়া। এটি থানকুনি গাছের মতই রানারের মাধ্যমে চারা চারদিকে ছড়াতে থাকে। পাশ থেকে বের হওয়া পরিণত রানার কেটে আলাদা লাগিয়ে এর চাষ করা সম্ভব। তবে এর বীজ বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে। একটি স্ট্রবেরী গাছ থেকে রানারের মাধ্যমে বংশ বৃদ্ধি করলে বছরে কয়েকশত চারা উৎপাদন করা সম্ভব। স্ট্রবেরী শীত প্রধান দেশের ফল তাই বেশি তাপমাত্রার কারণে বাংলাদেশে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এ গাছ বাঁচিয়ে রাখা খুব কষ্টসাধ্য। স্ট্রবেরী ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ এবং পাকা অবস্থায় টকটকে লাল রঙের হয়। ফলটি দেখতে অনেকটা লিচুর মত। 


পুষ্টিমানঃ  স্ট্রবেরী জীবন রক্ষাকারী নানা পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ। এতে আছে ভিটামিন এ, সি, , ফলিক এসিড, সেলেনিয়াম, ক্যালসিয়াম, পলিফেনল, এলাজিক এসিড, ফেরালিক এসিড, কুমারিক এসিড, কুয়েরসিটিন, জ্যান্থোমাইসিন ও ফাইটোস্টেরল। এদের মধ্যে এলাজিক এসিড ক্যান্সার, বার্ধক্য, যৌনরোগ প্রতিরোধের গুণাগুণ আছে বলে জানা গেছে। স্ট্রবেরির মধ্যে কোলেস্টেরল, চর্বি ও সোডিয়ামের পরিমাণ খুবই কম। এছাড়া এর মধ্যে ভিটামিন এ, কে, , বি১, বি২, বি৩, ও বি৬ রয়েছে। 




উপকারিতাঃ 

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়ঃ  স্ট্রবেরীতে আছে প্রচুর ভিটামিন সি যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং বিভিন্ন রকম সংক্রমণ থেকে শরীরকে রক্ষা করে। মাত্র এক কাপ স্ট্রবেরী প্রতিদিনের ভিটামিন সি এর চাহিদার ১০০% পূরণ করতে সক্ষম।


হার্টের অসুখের ঝুঁকি কমায়ঃ  দেখতে কিছুটা হার্টের মত এই ফলটিতে আছে প্রচুর পরিমাণে ফ্ল্যাভনয়েড ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট।
এই উপাদান গুলো শরীরের খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে হৃদপিন্ড ভালো রাখতে সহায়তা করে। এছাড়াও স্ট্রবেরী রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করে।
ডায়াবেটিস ও কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করেঃ  স্ট্রবেরীতে আছে প্রচুর ফাইবার যা ডায়াবেটিস ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়তা করে। ফাইবার রক্তের চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং ডায়াবেটিসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়ঃ  অন্য সব ফল ও সবজির মত স্ট্রবেরীতেও আছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। এছারাও স্ট্রবেরীতে আছে লুটেইন ও জিয়াথানাসিন যা ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি হ্রাস করে। এতে উপস্থিত ভিটামিন সি শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
ত্বকের জন্য ভালোঃ  স্ট্রবেরীতে উপস্থিৎ ভিতামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বককে বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও নিয়মিত স্ট্রবেরী খেলে ত্বকে সহজে বার্ধক্যের ছাপ পরে না।
ওজন কমাতে সহায়কঃ  স্ট্রবেরী ওজন কমাতে সহায়ক। স্ট্রবেরীতে ক্যালরীর পরিমাণ খুবই কম। এক কাপ স্ট্রবেরীতে আছে মাত্র ৫৩ ক্যালরী। স্ট্রবেরী খেলে বেশ অনেকক্ষন পেট ভরা থাকে। তাই স্ট্রবেরী ওজন কমানোর জন্য একটি সহযোগী খাবার।
গর্ভবতীদের জন্য উপকারীঃ  গর্ভবতী নারীদের জন্য স্ট্রবেরী খুবই উপকারী খাবার। স্ট্রবেরী গর্ভের শিশুর মস্তিশক গঠনে সহায়তা করে এবং মা ও শিশুকে পুষ্টি সরবরাহ করে। তাই গর্ভবতী মায়েদের খাবার তালিকায় স্ট্রবেরী হতে পারে একটি আদর্শ খাবার।
হাড়ের জন্য ভালোঃ  স্ট্রবেরীতে আছে ম্যাঙ্গানিজ,পটাশিয়াম ও কিছু মিনারেল যা হাড়ের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বজায় রাখে। এছাড়াও এই উপাদান গুলো হাড়কে রাখে মজবুত ও সুস্থ। তাই বাড়ন্ত শিশুদের জন্য স্ট্রবেরী একটি উপকারী খাবার।
চুল পড়া রোধ করেঃ  অনেকেই চুল পড়া নিয়ে বেশ সমস্যায় আছেন। যাদের চুল পড়ে যাচ্ছে তারা নিয়মিত স্ট্রবেরী খাওয়ার অভ্যাস করুন। স্ট্রবেরীতে আছে ফলিক এসিট, এল্লাজি এসিড, ভিটামিন বি ৫ ও ভিটামিন বি ৬ যা চুল পড়া প্রতিরোধ করে এবং চুলকে গোড়া থেকে মজবুত করতে সহায়তা করে। এছাড়াও এতে আছে কপার ও ম্যাগনেশিয়াম যা চুলের গোড়ায় খুসকি ও অন্য কোনো ফাঙ্গাল ইনফেকশন হতে দেয় না। স্ট্রবেরী চুলকে উজ্জ্বল করে তোলে এবং চুলের বৃদ্ধি বাড়ায়।
স্মৃতিশক্তি ভালো রাখেঃ  স্ট্রবেরীতে আছে ফিসটেনিন নামের একটি ফ্ল্যাভনয়েড যা স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সহায়তা করে। আন্যালস অফ নিওরোলোজিতে প্রকাশিত একটি রিসার্চে প্রমানিত হয়েছে যে সপ্তাহে মাত্র দুটি করে স্ট্রবেরী খেলেই মহিলাদের স্মৃতিশক্তি বেশিদিন ভালো থাকে।


রূপচর্চায় স্ট্রবেরিঃ

 ০১। স্ট্রবেরিতে রয়েছে কার্যকর ক্লিনজিং প্রপার্টিস। বিভিন্ন বিখ্যাত ব্র্যান্ড গুলোর ক্লিনজার, ফেইসওয়াশ, ফেইস মাস্ক তৈরিতে ব্যবহার করা হয় এই স্ট্রবেরির নির্যাস। স্ট্রবেরিতে থাকা ভিটামিন সি, স্যালিসাইলিক এসিড এবং এক্সফলিয়েন্টস মুখের মৃত কোষ দূর করে ত্বককে উজ্জ্বল করে এবং মুখের রোমকূপ টাইট করতে সাহায্য করে। এতে থাকা এলাজিক এসিড নামক এক ধরনের এন্টি অক্সিডেন্ট ত্বকের ড্যামেজ প্রতিরোধ করে ত্বককে সজীব এবং যৌবনদীপ্ত করে তোলে।
০২। মুখের বিভিন্ন দাগ দূর করতে স্ট্রবেরি বেশ কার্যকরী। এতে রয়েছে স্কিন লাইটেনিং প্রপার্টিস যা অসমান স্কিনটোন দূর করে ত্বকের উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনে। স্ট্রবেরি ব্লেন্ড করে এর রস আলাদা করে একটি পাত্রে নিন। তুলার সাহায্যে রস ভালো মতো মুখে লাগিয়ে ১০-১৫ মিনিট রেখে ঈষদুষ্ণ পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন। নিয়মিত ব্যবহারে ত্বক উজ্জ্বল এবং দাগমুক্ত হবে।
০৩। স্ট্রবেরি স্কিন টোনার হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে। ২ চা চামচ স্ট্রবেরি জুসের সাথে ৫০ মিলি গোলাপ জল ভালো মত মিশিয়ে তৈরি করতে পারেন স্ট্রবেরি স্কিন টোনার। এই টোনার ত্বকের বলিরেখা, ব্রণের দাগ দূর করতে খুব কার্যকরী। এটি ফ্রিজে ১০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে পারেন।
০৪। ২-৩ টি স্ট্রবেরি, ২ চা চামচ মধু, কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে পেস্ট করে মুখে লাগান। ১৫ মিনিট পর মুখ ধুয়ে ফেলুন। এই মাস্কটি ত্বককে ভেতর থেকে পরিষ্কার করে একে উজ্জ্বল এবং সুন্দর করে তোলে।
০৫। স্ট্রবেরিতে থাকা ফলিক এসিড, ভিটামিন B5 এবং ভিটামিন B6 চুল ঝরা রোধ করতে খুব কার্যকর। এক চা চামচ মধু, ৭-৮ টি স্ট্রবেরি এবং ৪-৫ চা চামচ টক দই ভালো মতো ব্লেন্ড করে এই মিশ্রণটি চুলে লাগান। এই হেয়ার মাস্কটি চুলের রুক্ষভাব দূর করে এবং চুল ঝরা রোধ করতে সাহায্য করে।
০৬। ৭-৮ টি স্ট্রবেরি ভালো মতো পেস্ট করে এতে ১ টেবিল চামচ মেয়োনিজ মিক্স করুন। এই মিশ্রণটি চুলে এবং স্ক্যাল্পে ভালো মতো লাগিয়ে ১৫-২০ মিনিট রাখুন। এরপর চুল ধুয়ে শ্যাম্পু করে ফেলুন। এটি ন্যাচারাল কন্ডিশনার হিসেবে কাজ করে এবং চুলের উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে তোলে।
০৭। তৈলাক্ত ত্বকের জন্য সমান পরিমাণে স্ট্রবেরি এবং টক দই ভালো মতো মিশিয়ে মুখে লাগান। ১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। এই মাস্কটি ত্বকের অয়েলি ভাব কমিয়ে ত্বক নরম এবং মসৃণ করে।
০৮। চোখের ফোলাভাব এবং ডার্ক সার্কেল দূর করতে ব্যবহার করতে পারেন স্ট্রবেরি। স্ট্রবেরি পাতলা করে স্লাইস করে কেটে নিন। এরপর রিল্যাক্স ভাবে শুয়ে স্ট্রবেরি স্লাইস চোখের নীচে ১০-১৫ মিনিট রাখুন। এরপর পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন। নিয়মিত ব্যবহারে ভালো ফল পাবেন।
০৯। চুলে ময়েশ্চার যোগাতে ৪-৫ টি স্ট্রবেরি এবং একটি ডিমের কুসুম ভালো মতো মিক্স করে চুলে লাগান। ৩০ মিনিট রেখে শ্যাম্পু করে ফেলুন। এটি চুলের রুক্ষভাব দূর করে চুল নরম করে তোলে।





জাতঃ
জাতের নাম
উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম
চাষের সময়
বারি স্ট্রবেরী-১*
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ
রাবি-১, রাবি-২ এবং রাবি-৩
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর
মর্ডান স্ট্রবেরী-১, মর্ডান স্ট্রবেরী- ২, মর্ডান স্ট্রবেরী- ৩, মর্ডান স্ট্রবেরী- ৪ (Camarosa),  মর্ডান স্ট্রবেরী- ৫(Festival)
মর্ডান হর্টিকালচার সেন্টার, নাটোর
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর


বারি স্ট্রবেরি-১ এর বৈশিষ্ট্যঃ
১. বারি স্ট্রবেরি-১ বাংলাদেশের সব জায়গায় চাষ করার উপযোগী একটি উচ্চফলনশীল জাত।
২. সাধারণত গাছের গড় উচ্চতা ৩০ সে.মি. এবং বিস্তার ৪৫-৫০ সে.মি. হয়ে থাকে। 
৩. সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রোপণ করা হলে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে গাছে ফুল আসতে শুরু করে এবং ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। 
৪. প্রতি গাছে গড়ে ৩২টি ফল হয়, যার গড় ওজন ৪৫০ গ্রাম। প্রতি বিঘায় ফলন ১.৫-২ টন। 
৫. ফল দেখতে ছোট ও মাঝারি আকারের হয়ে থাকে। 
৬. পাকা ফল আকর্ষণীয় টকটকে লাল রঙের। ফলের ত্বক নরম ও কিছুটা খসখসে। ফল সম্পূর্ণরূপে খাওয়া  যায়। 
৭. স্ট্রবেরির জাতটি যথেষ্ট পরিমাণ সরু লতা (runner) ও চারা উৎপাদন করে তাই এর বংশবিস্তার সহজ।

চাষের উপযোগী পরিবেশ ও মাটিঃ
মাটির প্রকৃতি
জলবায়ু
তাপমাত্রা
দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি
ভাদ্র থেকে আশ্বিণ মাস (মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য অক্টোবর)
দিন ও রাতে যথাক্রমে ২০-২৬º ও ১২-১৬º সে.


চারা উৎপাদনঃ
১. স্ট্রবেরি সরু লতার মাধ্যমে বংশ বিস্তার করে থাকে। তাই আগের বছরের গাছ নষ্ট না করে জমি থেকে তুলে জৈব পদার্থ আছে সেরকম হালকা ছায়াযুক্ত জায়গায় রোপণ করতে হবে। 
২. ওই গাছ থেকে উৎপন্ন রানারে যখন শেকড় বের হবে, তখন তা কেটে ভালোভাবে মেশানো গোবর মাটি দিয়ে ভরা পলিথিন ব্যাগে (৪"X৩") লাগাতে হবে এবং তা হালকা ছায়াযুক্ত নার্সারিতে সংরক্ষণ করতে হবে। 
৩. অতিরিক্ত বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য বর্ষা মৌসুমে চারার ওপর পলিথিনের ছাউনি দিতে হবে। 
৪. রানারের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করা হলে স্ট্রবেরির ফলন ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে। তাই ফলন ক্ষমতা ঠিক রাখার জন্য তিন বছর পরপর টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত চারা ব্যবহার করা ভালো।
 ৫. স্ট্রবেরী রানারের মাধামে বংশ বিস্তার করে থাকে। তাই পূর্ববর্তী বছরের গাছ নষ্ট না করে জমি থেকে তুলে জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ হালকা ছায়াযুক্ত স্থানে রোপণ করতে হবে। উক্ত গাছ হতে   উৎপন্ন রানারের পর্বসন্ধির নীচ থেকে যখন মূল বের হবে, তখন রানারটি মাতৃগাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভালভাবে মিশানো গোবরমাটি (১:১) দিয়ে ভরা পলিথিন ব্যাগে (৪ x ) লাগাতে হবে এবং তা হালকা ছায়াযুক্ত নার্সারীতে সংরক্ষণ করতে হবে।



জমি চাষঃ জমি ভালভাবে চাষ করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে অন্তত ৩০ সেন্টিমিটার গভীর করে জমি চাষ দিতে হবে। যেহেতু স্ট্রবেরি গাছের শিকড় মাটির উপর দিকে থাকে সেজন্য মাটি ঝুরঝুরা করে নির্ধারিত মাত্রায় সার মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
চারা তৈরীঃ স্ট্রবেরি গাছগুলো গুল্ম ও লতা জাতীয় গাছ বলে গাছের গোড়া থেকে বেশ কিছু লম্বা লম্বা লতা মাটির উপর দিয়ে লতিয়ে যায়। মাটির সংস্পর্শে লতার গিট থেকে শিকড় গজায়। শিকড়যুক্ত গিট কেটে নিয়ে মাটিতে পুতে দিলে নতুন চারা তৈরি হবে। অর্ধেক মাটি অর্ধেক গোবর সার মিশিয়ে পলিব্যাগে ভরে একটি করে শিকড়যুক্ত গিটসহ লতা পুঁতে দিতে হয়। এক্ষেত্রে একটি গাছ থেকে ১৮-২০ টি চারা তৈরি করা সম্ভব।
বপন ও রোপন এর পদ্ধতিঃ চারা রোপন এর সময়ঃ স্ট্রবেরির চারা মধ্যঅক্টোবর থেকে মধ্যডিসেম্বর পর্যন- রোপণ করা যায়। তবে নভেম্বর মাস স্ট্রবেরি চারা রোপণের জন্য সবচেয়ে ভাল। বৃষ্টি হলে ক্ষেত থেকে অতিরিক্ত পানি সরিয়ে দিতে হবে না হলে গাছ পঁচে যাবে।
১. চারা রোপণের জন্য বেড পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এ জন্য এক মিটার চওড়া এবং ১৫-২০ সে.মি. উঁচু বেড তৈরি করতে হবে। দুটি বেডের মাঝে ৫০ সে.মি. নালা রাখতে হবে। 
২. প্রতি বেডে ৫০ সে.মি. দূরত্বে দুই সারিতে ৫০ সে.মি. দূরে দূরে চারা রোপণ করতে হবে।

পানি সেচ ও নিষ্কাশনঃ  
১. স্ট্রবেরি চাষে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। জমিতে রসের অভাব দেখা দিলে পর্যাপ্ত পানি সেচ দিতে হবে। 
২. স্ট্রবেরি জলাবদ্ধতা মোটেই সহ্য করতে পারে না। তাই বৃষ্টি বা সেচের অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।

সার ব্যবস্থাপনাঃ   স্ট্রবেরির জন্য দরকার প্রচুর জৈব সার। এজন্য প্রতি একরে ৫০-৬০ কেজি ইউরিয়া সার, ৭০ কেজি টিএসপি সার এবং ৮০ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
সার প্রয়োগের সময়ঃ এসব সারকে সমান দুভাগে ভাগ করে একভাগ দিতে হয় ফুল আসার একমাস আগে এবং অন্য ভাগ দিতে হবে ফুল ফোটার সময়। 



রোগ ও পোকামাকড় দমনঃ


রোগের নাম
লক্ষণ
প্রতিকার
কীটনাশকের নাম
পাতায় দাগপড়া রোগ
কোন কোন সময়, বিশেষত কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় পাতায় বাদামী রং এর দাগ পরিলক্ষিত হয়। এ রোগের আক্রমন হলে ফলন এবং ফলের গুনগত মান হ্রাস পায়।
রিডোমিল গোল্ড নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করে সুফল পাওয়া যায়।
রিডোমিল গোল্ড
ফল পঁচা রোগ
এ রোগের আক্রমণে ফলের গায়ে জলে ভেজা বাদামী বা কালো দাগের সৃষ্টি হয়। দাগ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ফল খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যায়।
ফল পরিপক্ক হওয়ার পূর্বে নোইন ৫০  ডব্লিউ পি অথবা ব্যাভিস্টিন ডিএফ নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৮-১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
নোইন ৫০  ডব্লিউ পি অথবা ব্যাভিস্টিন ডিএফ
ভারটিসিলিয়াম উইল্ট
এ রোগে আক্রানত্গাছ হঠাৎ করে দূর্বল ও বিবর্ণ হয়ে পড়ে। আক্রমণ বেশী হলে গাছ বাদামী বর্ণ ধারণ করে এবং মারা যায়। সাধারনতঃ জলাবদ্ধ জমিতে এ রোগের আক্রমণ বেশী হয়।
জমি শুষ্ক রাখতে হবে। পলিথিন মাল্‌চ ব্যবহার করলে তা  তুলে ফেলতে হবে। কপার জাতীয় ছত্রাকনাশক যেমন বর্দ্দোমিক্সার (১:১:১০), কুপ্রাভিট অথবা কপার অক্সিক্লোরাইড প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৮-১০ দিন পর পর ২-৩ বার গাছের গোড়া ও মাটি ভালভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
কপার জাতীয় ছত্রাকনাশক যেমন বর্দ্দোমিক্সার (১:১:১০), কুপ্রাভিট অথবা কপার অক্সিক্লোরাইড
পোকামাকড়ের নাম
লক্ষণ
প্রতিকার
কীটনাশকের নাম
পাখি
বিশেষ করে বুলবুলি ও শালিক স্ট্রবেরী ফলের সবচেয়ে বড় শত্রু। ফল আসার পর সম্পূর্ণ পরিপক্ক হওয়ার পূর্বেই পাখির উপদ্রব শুরু হয়।
ফুল আসার পর সম্পূর্ণ বেড জাল দ্বারা ঢেকে দিতে হবে যাতে পাখি ফল খেতে না পারে।



বিশেষ পরিচর্যাঃ স্ট্রবেরি গাছে ফুল ধরাতে চাইলে বিশেষ যত্ন নিতে হবে। গাছ লাগানোর পর তার গোড়া থেকে প্রচুর রানার বা কচুর লতির মতো লতা বের হতে থাকে। এগুলো জমি ঢেকে ফেলে। এতে ফলন ভাল হয় না। আবার মাটির সংস্পর্শে এলে স্ট্রবেরীর ফল পঁচে নষ্ট হয়ে যায়। এ জন্য চারা রোপনের ২০-২৫ দিন পর স্ট্রবেরী গাছের গোড়ায় খড় বা পলিথিন বিছিয়ে দিতে হয়। পলিথিন সিট ৩০ সেন্টিমিটার পর গোলাকার ছিদ্র করে স্ট্রবেরি গাছের ঝোপকে মুঠো করে ঢুকিয়ে দিতে হয়।  বেশি ফলন ও তাড়াতাড়ি ফল পেতে হরমোন গাছ পাতায় স্প্রে করা যেতে পারে। স্ট্রবেরীর গাছ প্রখর সৌর-তাপ এবং ভারী বর্ষণ সহ্য করতে পারেনা। এজন্য মার্চ-এপ্রিল মাসে হালকা ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নতুবা ফল আহরণের পর মাতৃগাছ তুলে টবে রোপণ করে ছায়ায় রাখতে হবে। ফল আহরণ শেষ হওয়ার পর সুস্থ্য-সবল গাছ তুলে পলিথিন ছাউনির নীচে রোপণ করলে মাতৃ গাছকে খরতাপ ও ভারী বর্ষণের ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যাবে। মাতৃ গাছ থেকে উৎপাদিত রানার পরবর্তি সময়ে চারা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।  ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে (সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে) রোপণকৃত বারি স্ট্রবেরী-১ এর ফল সংগ্রহ পৌষ মাসে আরম্ভ হয়ে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত (ডিসেম্বর থেকে মার্চ) চলে।



চাষের সময়ে পরিচর্যাঃ
১. সরাসরি মাটির সংস্পর্শে এলে স্ট্রবেরির ফল পচে নষ্ট হয়ে যায়। এ জন্য চারা রোপণের ২০-২৫ দিন পর স্ট্রবেরির বেড খড় বা কাল পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। 
২. খড়ে যাতে উইপোকার আক্রমণ না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। জমি সবসময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
৩. গাছের গোড়া থেকে নিয়মিতভাবে রানার বের হয়, যা ফল উৎপাদনে বাধা দেয়। এজন্য ওই রানারগুলো নিয়মিত কেটে ফেলতে হবে। রানার কেটে না ফেললে গাছের ফুল ও ফল উৎপাদন দেরিতে হয় এবং কমে যায়।

  মাতৃগাছ রক্ষণাবেক্ষণঃ
১. স্ট্রবেরির গাছ কড়া সূর্যের তাপ এবং ভারি বর্ষণ সহ্য করতে পারে না। এজন্য মার্চ-এপ্রিল মাসে হালকা ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নতুবা ফল তোলার পর মাতৃগাছ তুলে টবে রোপণ করে ছায়ায় রাখতে হবে।
২. ফল তোলা শেষ হওয়ার পর সুস্থ-সবল গাছ তুলে পলিথিন ছাউনির নিচে রোপণ করলে মাতৃ গাছ থেকে উৎপাদিত রানার পরবর্তী সময়ে চারা হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।

ফল সংগ্রহ ও বিক্রিঃ  কাঁচা ফল যখন হলদে বা লালচে রঙের হতে শুরু করে তখন বুঝা যাবে ফল পাকা শুরু হয়েছে। ফল পুরো পাকলে লাল হয়ে যায়। তবে বিক্রির জন্য ফল পুরো লাল হওয়ার দরকার নেই। সেক্ষেত্রে ফলগুলো শক্ত থাকা অবস'ায় তুলতে হবে। আর ফল তুলতে হবে বোটা সমেত। পরে কাগজের প্যাকেটে করে বাজারজাত করতে হবে। ফল তোলার পর ১০-১২ দিন পর্যন- ভালো থাকে।

উৎপাদিত ফসলের পরিমাণঃ   প্রতি বিঘা জমিতে প্রায় ৭ হাজার চারা রোপণ করা যায়। প্রতি গাছে ২৫০ থেকে ৩০০ গ্রাম বারি স্ট্রবেরি-১ জন্মালে প্রতিবিঘা থেকে প্রায় ১.৫ থেকে ২ টন ফল পাওয়া সম্ভব।




পদ্ধতিঃ ফল তুলতে হবে বোটা সমেত। এতে ফলের স্থায়ীত্ত বারে।
পরিবহণ পদ্ধতিঃ কাগজের কার্টুন বা প্লাস্টিক কেজ দারা প্যাকেজিং করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবহণ করা হয়ে থাকে এতে করে ফলে দাগ বা পঁচন কম হয়।

বাজার ব্যবস্থাঃ কাগজের প্যাকেটে বা টিস্যু পেপার দিয়ে মুড়িয়ে প্লাস্টিকের ঝুড়ি বা ডিমের ট্রেতে করে বাজারজাত করতে হবে।




কোন মন্তব্য নেই: