মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৫

গোল মরিচ চাষ ও পুষ্টিমান বা উপকারিতা



গোল মরিচ (Piper nigrum) Piperaceae গোত্রের একটি লতাজাতীয় উদ্ভিদ, যার ফলকে শুকিয়ে মসলা হিসাবে ব্যবহার করা হয়। গোল মরিচ ফলটিগোলাকার, ৫ মিলিমিটার ব্যাসের, এবং পাকা অবস্থায় গাঢ় লাল বর্ণের হয়ে থাকে। এর মধ্যে ১টি মাত্র বিচি থাকে।
গোল মরিচ গাছের আদি উৎস দক্ষিণ ভারতপৃথিবীর উষ্ণ ও নিরক্ষীয় এলাকায় এটির চাষ হয়ে থাকে।
গোল মরিচের গুঁড়া পশ্চিমা (ইউরোপীয়) খাদ্যে মসলা হিসাবে ব্যবহার করা হয় প্রাচীন কাল থেকে। তবে ভারত বর্ষের মসলাধিক্য রান্নায় এটির ব্যবহার প্রচুর। এছাড়া ঔষধী গুণাগুণের জন্যেও এটি সমাদৃত। গোল মরিচে পাইপারিন (piperine) নামের রাসায়নিক উপাদান রয়েছে, যা থেকে এর ঝাঁঝালো স্বাদটি এসেছে।


গোল মরিচের ইংরেজি নাম Black pepperএর Pepper শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ভাষার "পিপালী" শব্দ থেকে, যার অর্থ দীর্ঘ মরিচ। এখান থেকে উদ্ভুত হয়েছে লাতিন ভাষার piper যা মরিচ ও গোল মরিচ দুটোকেই বোঝানোর জন্য রোমানরা ব্যবহার করতো।
গোল মরিচ বহুবর্ষজিবি লতা জাতীয় গাছ। লতা রোপনের ৪/৫ বছর পর থেকে ফল ধরতে থাকে। ৮-৯ বছর বয়সে পূর্ণ উত্পাদন ক্ষমতায় আসে এবং ২০-২৫ বছর পর্য়ন্ত ভাল ফলন দেয়। গোল মরিচ গাছ সাধারণত সহায়ক গাছকে আকড়িয়ে বেড়ে ওঠে। এই গাছ সর্বোচ্চ ৩০-৩৫ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। এই গাছের পাতা দেখতে অনেকটা পান পাতার মতো। একটি গাছ থেকে বছরে দেড় কেজি পর্যন্ত গোল মরিচ পাওয়া যায়। 

গোলমরিচ চাষ  লাভজনক । কৃষকদের গ্রামীণ অর্থনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় ও কম সময়ে অধিক উপার্জন পেতে গোলমরিচ এক অর্থকরী ফসল হিসেবে বিবেচিত হয়।
গোলমরিচ লতাজাতীয় উদ্ভিদ। পান গাছ, ওদাল, বেত ইত্যাদির মতো গোলমরিচ এক পরাশ্রয়ী গাছ। এ জন্য গোলমরিচের অন্য গাছের আশ্রয় প্রয়োজন। আম, সুপারি, কাঁঠাল, মান্দার, তেঁতুল, নারিকেল, তাল, সিলভার, খেজুর ইত্যাদি গাছ গোলমরিচের আশ্রয়ী হিসেবে ব্যবহার হয়। এ ছাড়া অমসৃণ ছাল বিশিষ্ট গাছে গোলমরিচ গাছ ওঠার জন্য সুবিধা হয়।
পুষ্টিগুন: গোল মরিচে আমিষ, চর্বি এবং প্রচুর পরিমাণে ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম ও লৌহ থাকে।

ভেষজগুণঃ
১. হজমে সহায়তা করে
২. স্নায়ু শক্তি বাড়ায়
৩. দাঁতের ব্যাথা কমানোতে সহায়তা করে
৪. মাংসপেশী ও হাড়ের জোড়ার ব্যাথা উপশম করে
৫. কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে




উপযুক্ত মাটিও জমিঃ পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয় ও আর্দ্রতা বেশি এমন এলাকায় গোল মরিচ ভাল জন্মে। এ ফসল 100-400C পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। পিএইচ ৪.৫-৬.০ পর্যন্ত এ ফসল ফলানো যায়। পাহাড়ি এলাকার মাটি এ ফসল চাষের জন্য খুব উপযোগী। 

জাতঃ   (হাইব্রিড), কারিমুণ্ডা, বালনকাট্টা, কল্লুভেল্লি, আরকুলপাম মুণ্ডা প্রভৃতি।

চারাতৈরিঃ গোল মরিচে ৩ ধরনের লতা/কান্ড দেখা যায়।
১. প্রধান কান্ড যার পর্বমধ্য বড়,
২. রানার ডগা (সুট) ও
৩. ফল ধারণকারী পার্শ্বীয় শাখা।

সাধারণ গোল মরিচের চারা ডালের কলম থেকে তৈরি করা হয়। গোলমরিচের গাছের গোড়ার অংশকে রানার বলা হয়। রানার-এর প্রতিটি গিঁট থেকে শিকড় বের হওয়ার স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে।শীর্ষ ডগা ও ব্যবহার করা যায়। ফেব্রয়ারী-মার্চ মাসে ২-৩ টি পর্বসন্ধি (গিট) যুক্ত কান্ড কাটিং হিসেবে নার্সারীতে বা পলি ব্যাগ লাগানো হয়। পলি ব্যাগ উর্বর মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়। কাটিং-এ ছায়ার ব্যবস্থা রাখা হয় ও প্রয়োজনে সেচ দিতে হয়।  পলিব্যাগে চারা রোপণের পূর্বে বাঁশের কাঠি দিয়ে পলিথিন ব্যাগের মাটিতে গর্ত করে নিয়ে শিকড়যুক্ত কাটিং লাগাতে হয়। ৪৫-৬০ দিনের মধ্যে একটি সুন্দর চারা তৈরি হবে। মে-জুন বা চৈত্র-বৈশাখ  মাসে কাটিং লাগানোর উপযোগী হয়।



ব্যবসায়িক ভিত্তিতে গোলমরিচের চারা উৎপাদনের জন্য দ্রুত চারা উৎপাদন পদ্ধতি বেশি কার্যকর। একটি গাছ থেকে বছরে অন্তত ৩০-৩৫টি চারা উৎপাদন করা সম্ভব। এ জন্য একটি ছায়াঘর তৈরি করতে হবে। প্লাস্টিকের তৈরি বিশেষ ধরনের শেডনেট ব্যবহার করে ছাউনিও তৈরি করা যায়।
ঘরের বাঁশের খুঁটির সারির উচ্চতা হবে ৩ মিটার এবং দুই পাশের খুঁটির উচ্চতা হবে ২ মিটার। ঘরের মধ্যে ১ মিটার দূরত্ব বজায় রেখে ৭৫ সেন্টিমিটার গভীর এবং ৩০ সেন্টিমিটার প্রসের নালা তৈরি করতে হবে। নালাগুলো বালিমাটি, কম্পোস্ট, কাঁঠালের গুঁড়ো এবং সারমিশ্রিত মাটি সমানভাগে মিশিয়ে ভর্তি করতে হবে। এখন ওই নালার এক ফুট অন্তর অন্তর ভালো জাতের সুস চারা মাতৃগাছ হিসেবে রোপণ করতে হবে। দুই নালার মধ্যবর্তী জায়গার দুই মাথায় খুঁটি পুঁতে মাটির সঙ্গে আনুভূমিকভাবে একটি লম্বা বাঁশ বেঁধে দিতে হবে।
গোলমরিচের গাছ প্রতিটি গিঁট মাটির সংস্পর্শে বেঁধে দিতে হয়, এর ফলে প্রতি গিঁট থেকে শিকড় বেরিয়ে আসবে। ৩-৪ মাসের মধ্যে গোলমরিচের লতা আধাখানা বাঁশের মাথা পেরিয়ে যাবে। এ সময় লতার আগা কেটে নিন এবং গাছের গোড়ার তিনটি গিঁটের উপরে লতা থেঁতলে দিন। তখন পাতার অঙ্কুর বাড়তে আরম্ভ করবে। ১০ দিন পর থেঁতলানো অংশটুকু কেটে ফেলুন।
বংশ বিস্তারঃ   গোলমরিচের বীজ থেকে বংশবৃদ্ধি করা যায়। কিন্তু এতে উৎপাদন পেতে অনেক বেশি সময় লাগে। গোলমরিচের গুণাগুণ মাতৃগাছের মত নাও হতে পারে। সেজন্য সাধারণত অঙ্গজ প্রজননের দ্বারা গোলমরিচের বংশবৃদ্ধি করা হয়। সাধারণত এক মুকুল একপত্রী কাটিং দ্বারা বংশবৃদ্ধি করা হয়। ওই পদ্ধতি দ্বারা অতি সহজেই গোলমরিচের চারা প্রসত করা যায়।
চারা লাগানোঃ  গোল মরিচ ঠেস গাছের ছায়ায় লাগাতে হয়। ঠেস গাছ আগে থেকে ২.৫ মি. দূরত্বে লাগিয়ে গোল মরিচের কাটিং লাগানো হয়। ২-৩ টি কাটিং এক গর্তে লাগানো হয়।
চারা রোপণ পদ্ধতিঃ   গোলমরিচের চারা দুই প্রকারে রোপণ করা যায়। যদি বাগানে সুপারি, নারকেল, আম, মান্দার, কাঁঠাল ইত্যাদি আশ্রয় গাছ হিসেবে ব্যবহারের গাছ থাকে, তখন ওই গাছ থেকে দেড় হাত দূরে, দেড় হাত দৈর্ঘ্য, দেড় হাত প্রস এবং দেড় হাত গভীর গর্ত করতে হয়। গোবর, পচনসার, বালুযুক্ত মাটি দিয়ে গর্তটি পূর্ণ করে চারা রোপণ করা হয়। গাছ ওঠার সুবিধার জন্য বাঁশের অবলম্বন দেয়া প্রয়োজন।


রোপণের সময়ঃ  গোল মরিচ ভালো জাতের চারা বৈশাখের ১০-১৫ দিন থেকে আষাঢ়ের ১০-১৫ দিন পর্যন্ত রোপণের উপযুক্ত সময়।
মাটিঃ   অব্যবহৃত বা পতিত জমিতে উচ্চ জৈবসার বিশিষ্ট পানি জমে না থাকা, পাহাড়ের লালমাটি গোলমরিচ চাষের জন্য বেশি উপযোগী। বন্যা কবলিত অঞ্চল ছাড়া বেলে দো-আঁশ মাটিতে গোলমরিচের চাষ করা যায়। আর্দ্রতাহীন মাটি গোলমরিচ চাষের জন্য অনুপযোগী।
জাতঃ  পানিউর-১ (হাইব্রিড), কারিমুণ্ডা, বালানকাট্টা, কল্লুভেল্লি, আরকুলাম মুণ্ডা প্রভৃতি গোল মরিচের জাত।
সারব্যবস্থাপনাঃ  প্রতি গর্তে ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১১০ গ্রাম টিএসপি ও ৪৫০ গ্রাম পটাশ দিতে হয়। তবে এ পরিমাণ সার তৃতীয় বছর হতে দিতে হবে। এ পরিমাণের ১/৩ ভাগ ১ম বছর এবং ২/৩ ভাগ দ্বিতীয় বছরে দিতে হবে। সার সাধারণতঃ বছরে দুবারে দিতে হয়। একবার মে-জুন মাসে ও পরের বার আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাসে দিতে হয়। এছাড়া প্রতি বছর প্রতি গর্তে মে-জুন মাসে ১০ কেজি পঁচা গোবর ও প্রতি ১ বছর অন্তর-অন্তর প্রতি গর্তে ৬০০ গ্রাম চুন দিতে হবে।

সেচ ও আগাছাব্যবস্থাপনাঃ  আগাছা দেখা দিলে পরিষ্কার করতে হবে ও মাটিতে রসের অভাব হলে পানি সেচ দিতে হবে। ডগা বাড়তে থাকলে ঠেস গাছের সাথে বেঁধে দিতে হবে।
 
পোকার আক্রমণঃ
পোকার নাম : ফ্লি বিটল 
ভূমিকা : এ পোকার আক্রমণে শতকরা ৩০ -৪০ ভাগ ক্ষতি হতে পারে। সে কারনে এ পোকা দেখা মাত্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। 
পোকা চেনার উপায় : পূর্নাঙ্গ বিটল কালো পাখা যুক্ত, মাথা ও ঘাড় হলদে বাদামী বর্ণের। 
ক্ষতির নমুনা : পূর্ণাঙ্গ ও কীড়া উভয় গাছের কচি অংশ খেয়ে নষ্ট করে । 
- পূর্ণাঙ্গ বিটল ফল ছিদ্র করে ফলের মধ্যে ঢুকে ভেতরের অংশ খায়। 
- আক্রান্ত ফল প্রথমে হলুদ ও পরে কালো হয়। 
- কীড়া ফলের বীজ ছিদ্র করে ভেতরের অংশ খায় । 

পোকার জীবন চক্র : স্ত্রী বিটল জুলাই মাসে কচি ফলে ১-২ টি ডিম পাড়ে। প্রতিটি পোকা ১০০ টি করে ডিম পাড়ে। ৫-৮ দিনে ডিম থেকে কীড়া বের হয়। কীড়া ২০-৩২ দিন পরে পুত্তলিতে পরিণত হয়। ৬-৭ দিন পর পুত্তলি হতে পূর্ণাঙ্গ বিটল বের হয়। পূর্ণাঙ্গ বিটল ৩৯-৫০ দিন বাঁচে। 
ব্যবস্থাপনা : নিয়মিত গাছ ছাঁটাই করে বৃদ্ধি কমাতে হবে। 
- অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ। 



রোগব্যবস্থাপনাঃ  নার্সারীতে পাতা পচা ও ঢলে পড়া রোগ দেখা যায়। পাতা পচা রোগে পাতায় কাল দাগ পড়ে এবং ঢলে পড়া রোগ হলে কাটিং নেতিয়ে পড়ে।

দমন: ব্যাভিস্টিন বা কপার অক্সি ক্লোরাইড নামক ছত্রাক নাশক প্রতি দশ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম হারে ১০-১২ দিন অন্তর অন্তর ৩ বার প্রয়োগ করলে এ রোগ দমন করা যায়। 

 হটাৎ ঢলে পড়া রোগ লক্ষণঃ
১. পাতার উপর কালো দাগ পড়ে এবং পরে দাগ বড় হয়।
২. কচি পাতা ও ডগা আক্রমণে কালো হয়ে যায়। অধিক আক্রমণে গাছ মরে যায়।
৩. গোড়া সহ সকল স্থানে আক্রমণ ছড়াতে পারে।
৪. বর্ষা মৌসুমের শেষে আক্রমণ হলে গাছ হলুদ হয়ে ঢলে পড়তে পারে।

দমনঃ
১. মাটিসহ গাছ তুলে ধ্বংস করা
২. রোগমুক্ত কাটিং ব্যবহার
৩. পরিচর্যার সময় শিকড়ে ক্ষত করা যাবেনা
৪. সাকার (ডগা) মাটিতে বাড়তে দেয়া যাবেনা
৫. ০.২% হারে কপার অক্সিক্লোরাইড প্রয়োগ 

ফলছিদ্রকারী পোকাঃ  গোলমরিচে এক প্রকার ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ দেখা যায়। শ্রাবণ ও কার্তিক মাসে প্রতি ৫ লিটার পানিতে এক চা চামচ এন্দোসালফার ৩৫ ইসি বা কুইনলফস বা ডাইমিথয়েট ৩০ ইসি প্রয়োগ করে সুফল পাওয়া যায়।

ঝরে পড়া রোগঃ  গোলমরিচ ধরা শুরু হওয়ার কিছু দিনের মধ্যে বীজগুলো ঝরে যায়। বর্ষাকাল আরম্ভ হওয়ার কিছুদিন পূর্বে এক শতাংশ বোর্দো মিশ্রণ গোলমরিচ গাছে প্রয়োগ করতে হয়। এছাড়া খরার সময়ে পানি, খুব গরমে ছায়া এবং নিয়মিত সার প্রয়োগ করে এ রোগের প্রতিরোধ করা যায়।
ফসলতোলাঃ মে-জুন মাসে ফুল আসে এবং ৬-৮ মাস পর ফল তোলা যায়। থোকায় ২/১টি ফল উজ্জ্বল কমলা বা বেগুণী হলে সংগ্রহ করে ৭-১০ দিন রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়।

ব্যবসা-অর্থনীতিঃ  গোলমরিচ রোপণের তিন বছর থেকে উৎপাদন শুরু হয়। যদিও ৭-৮ বছর থেকে পুরোপুরি উৎপাদন চলে আসে। প্রতি গাছ থেকে ৫-৬ কেজি কাঁচা গোলমরিচ উৎপাদন হয়। কাঁচা গোলমরিচ থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ শুকনো গোলমরিচ পাওয়া যায়। অর্থাৎ, একটি গাছ থেকে গড়ে দেড় থেকে দুই কেজি শুকনো গোলমরিচ পাওয়া যায়। প্রতি কেজি ৫০০ টাকা হলে একটি গোলমরিচের গাছ থেকে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা উপার্জন করা যায়। হিসেব অনুযায়ী একটি গাছের জন্য খরচ প্রায় ৩৫ টাকা। সুতরাং খরচের তুলনায় লাভ যথেষ্ট।



কোন মন্তব্য নেই: