মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৫

অ্যাসপারাগাস চাষ ও পুষ্টিমান বা উপকারিতা




অ্যাসপারাগাস (Asparagus officinalis) লিলি গোত্রের বহু বর্ষজীবী গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। আমাদের দেশে এর ব্যবহার নতুন হলেও ইউরোপ আমেরিকাসহ জাপান, চীন ও কোরিয়ায় বহুল ব্যবহৃত একটি জনপ্রিয় সবজি।  

খাবারের আগে অ্যাপিটাইজার হিসেবে, খনো বা স্যুপে ব্যবহৃত ঞয় আ্যাসপ্যারাগাস। পশ্চিমা বিশ্বের হোটেল রেস্তেরাগুলোতে হালকা চিকেন বা টোনাফিস স্লাইস সহযোগে অ্যাসপারাগাস সালাদ খুবই প্রচলিত। জাপানে মায়্যোনেজ মিশ্রিত আলু ভর্তায় অ্যাসপারাগাস ব্যবহার খুবই কমন। তবে ফ্রাইপ্যানে হালকা তেলে ভেঁজে বা ভাঁপে সিদ্ধ করে অ্যাসপারাগাস সহজেই খাওয়া যায়। উন্নত বিশ্বে প্রতি বেলার খাবার মেনুতে অ্যাসপারাগাস খুবই কমন তবে পরিবেশন পদ্ধতিতে ভিন্নতা রয়েছে। 




এর স্বাদ চমৎকার। মিষ্টি ও তেতোর মিশেল। দেখতেও আদি অকৃত্রিম ও তাজা। আর অ্যাসপারাগাস এমনই একটি খাবার যে, কেউ চাইলে এটাকে কাঁচা কিংবা রান্না করে খেতে পারবে। এছাড়া ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে লড়তে এটাকে একটি শক্তিশালী রন্ধন অস্ত্র বলা হয়। বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন, এই ক্রমশ জনপ্রিয় সবজিটাকে নিয়মিত খেলে রক্তে চিনির মাত্রা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং এটি একইসঙ্গে শরীরে ইনসুলিন তৈরির গতিও ত্বরাণি¦ত করে, যে হরমোনটি কিনা শরীরের গ্লুকোজকে শুষে নিতে পারে।

গুনাগুণঃ ওষুধি গুণের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোতে অ্যাসপারাগাস বহুল সমাদৃত। অ্যাসপারাগাস মূলত, প্রোটিনসহ ভিটামিন B6, A, C, E, I, K, থায়ামিন, রিভোফ্লাভিন, রুটিন, নায়াসিন, ফলিক এসিড, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, কপার ও ম্যাঙ্গানিজসমৃদ্ধ। অ্যাসপারাগাসে প্রচুর পরিমাণে প্লান্টপ্রোটিন হিস্টোন এবং গ্লটাথিয়ন থাকে, যা এন্টিঅক্সিডেণ্ট হিসেবে দেহের ক্ষতিকারক ফ্রিরেডিক্যালের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত কাজ করে। যা ক্যান্সার প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা রাখে এবং দেহের টনিক হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া ফলিক এসিড থাকার কারণে অ্যাসপারাগাস হার্টে ব্লক সৃষ্টিতে সরাসরি বাঁধা দেয়।এজন্য হুদরোঘীওদর জণ্য আ্যাসপ্যারাগাস বেশ উপকারী। উচ্চতর গবেষণায় প্রতিয়মান হয়েছে যে, মানব দেহের ত্বক ও ফুসফুসের ক্যান্সারসহ কিডনি ইনফেকশান ও পিত্ত্ব থলিতে পাথর প্রতিরোধেও অ্যাসপারাগাস উল্লেখযোগ্য কাজ করে। প্রতিদিন ২বার সকাল সন্ধ্যায় ২-৩টি অ্যাসপারাগাস স্টিক খেলে ৩-৪ সপ্তাহের মাধ্যেই এসব রোগের উপশম হয়।



প্রচুর অক্সিজেনঃ    গুরুত্বপূর্ণ কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে অ্যাসপারাগাস তার শ্বাসপ্রক্রিয়ায় বেশ ভাল ফল দিয়েছে। কেননা, এটা উত্তোলন করার পর সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় না। বস্তুত এটি এরপরও নিজস্ব প্রক্রিয়ায় শ্বাস-প্রশ্বাস তথা শ্বসন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে পারে, অর্থাৎ এটি অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে। এরপর ওটা শর্করা ও সুগারে পরিণত হয়ে পরে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে।

অন্যান্য সবজির সঙ্গে তুলনা করেও দেখা গেছে অ্যাসপারাগাসের শ্বাসক্রিয়া বেশ দ্রুত (যে প্রক্রিয়ায় এর ভেতর অক্সিজেন গ্রহণের ঘটনা ঘটে)। এর প্রতি ১০০ গ্রামে ৬০ মিলিগ্রাম করে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসৃত হয় (৪১ ডিগ্রি ফারেনহাইট রেফ্রিজারেটর তাপমাত্রায়)। যা কিনা পেঁয়াজ ও আলুর চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি, টমেটোর চেয়ে তিন গুণ ও ফুলকপি ও আভোকাদোর চেয়ে দ্বিগুণ বেশি। আর এর খারাপ দিকটা হলো, এই কারণেই অন্যান্য সবজির চেয়ে অ্যাসপারাগাস দ্রুত পঁচে যায়। এ জন্য পাচকদের দেখা যায় অ্যাসপারাগাসের গোড়ার দিকটা ভেজা কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে রাখতে। এতে করে এর কা-টার স্থায়ীত্ব বাড়ে। সুতরাং পরবর্তীতে আপনি যখন এই জাদুকরী লতাটি কিনবেন, খেয়াল রাখবেন যাতে কেনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই তা সাবাড় করতে পারেন।

জমি তৈরিঃ  অ্যাসপারাগাস পর্যাপ্ত জৈব পদার্থসমৃদ্ধ সুনিষ্কাসিত মাটিতেই ভালো হয়। মাটিতে যন পানি না জমে সেদিকে লক্ষ রাখতে হয়। মাটি ঝুরঝুরা হলে স্পেয়াস এর সংখ্যা বেশি হয়। মাটির পিএইচ মাত্রা ৬-৭ তে অ্যাসপারাগাস ভালো হয়। জমি তৈরি করার সময় বেডে পরিমাণ মতো চুন প্রয়োগ করে নিতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে গোবর সার ও খৈলগুঁড়া প্রয়োগ করতে হবে। মার্চ মাসের দিকে স্পেয়ার্স বের হতে শুরু করলে এবং জুলাই মাসের শেষের দিকে বছরে ২ বার ১:১:২ : ইউরিয়া:টিএসপি:এমপি অনুপাতে প্রতিবার হেক্টর প্রতি ১শকেজি সার মাটির উপরিভাগে ছিটিয়ে হালকা করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।



শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে অ্যাসপারাগাসের বাংলাদেশে উৎপাদন উপযোগিতা, উৎপাদন পদ্ধতি ও পুষ্টিমান নিয়ে গবেষণা চলছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে চাষযোগ্য ৩টি লাইন সাউ অ্যাসপারাগাস-১ (মেরী ওয়াশিংটন), সাউ অ্যাসপারাগাস-২ (গ্রীন বাংলা) ও সাউ অ্যাসপারাগাস-৩ (ওয়েলকাম ঢাকা) উৎপাদন শুরু হয়েছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্যানতত্ত্ব খামারে।  

চাষের নিয়মঃ বীজ থেকে সহজেই চারা উৎপাদন করা যায়, তবে বীজ থেকে উৎপাদিত অ্যাসপারাগাস থেকে প্রথম বছর কোন ফলন পাওয়া যায় না। দ্বিতীয় বছর থেকে ফলন দিতে থাকে এবং পর্যায়ক্রমে ফলন বাড়তে থাকে। সারা বছর স্পেয়ার্স উৎপাদিত হলেও শীতে উৎপাদন কমে যায়। বর্ষায় জমিতে কোনভাবেই পানি জমতে দেয়া যাবেনা, শুকনো মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি সেচ দিতে হবে। অ্যাসপারাগাসে সাধারণত স্ত্রী ও পুরুষ দুধরনের গাছ দেখা যায়। পুরুষ গাছে উন্নত মানের স্পেয়ার্স উৎপাদিত হলেও, বীজ কিন্তু স্ত্রী গাছেই হয়। স্ত্রী গাছে স্পেয়ার্স খুব কম হয় ও উৎপাদিত স্পেয়ার্স নিম্ন মানের হয়। স্পেয়ার্স ১৫-২০ সেন্টিমিটার লম্বা হলেই ধারালো ছুড়ি দিয়ে কেটে নিতে হবে। দ্বিতীয় বছর থেকে গড়ে ৮-১০টি স্পেয়ার্স প্রতি গাছ থেকে সংগ্রহ করা যাবে, তবে বয়সের সাথে সাথে তা বাড়তে থাকবে।


রোগ ও নিরাময়য়ঃ  ফিউজারিয়াম রট ও ক্রাউন রট অ্যাসপারাগাসের মারাত্মক ক্ষতি করে। তাই বছরে অন্তত ২-৩ বার রিডোমিল বা ডাইথেন ¯েপ্র করতে হবে যেন মাটিসহ ভিজে যায়। মাটিতে সেভিন ডাস্ট দিলে  পেয়ার্সে পিপড়া বা বিটলের আক্রমণ হবে না। তা ছাড়া গবেষণায় দেখা যায় যে, সরিসার খৈলের পরিবর্তে নীমের খৈল ব্যবহার অথবা জমিতে নীমপাতা গুঁড়া ব্যবহার করলে ফিউজারিয়াম রট কমে হয়।

অ্যাসপারাগাস আমাদের দেশে খুবই অপ্রচলিত হলেও এর পুষ্টিগুনের জন্যে এর প্রসার খুবই জরুরী। অ্যাসপারাগাস এখন উত্তরাঞ্চলেই চাষ হচ্ছে। বিশেষ করে বগুড়া অঞ্চলে এই সবজির আবাদ হচ্ছে বেশি। সেই এলাকার গৃহস্থ ও কৃষক বাড়িতে তা দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। রাজধানী ঢাকায় পাঁচ তারকা হোটেলগুলোতে এই সবজি আসছে বগুড়া থেকে। চাহিদা অনুযায়ী অ্যাসপারাগাস সরবরাহ করা এখনও সম্ভব হচ্ছে না। তবে আশার কথা, এক জনের দেখাদেখি অন্যরা এই সবজি আবাদ করায় শীঘ্রই চাহিদা পূরণ করে এ্যাসপ্যারাগাস বিদেশেও যাবে।  অ্যাসপারাগাস যেমন খাবারের পুষ্টিমান বাড়ায় তেমনি ডিস সাজানোতে আনে শৈল্পিক সৌন্দয্য কারুময়তা। নিত্য দিনের খাবার মেন্যুতে অ্যাসপারাগাস রেখে আমরা কিন্ত আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি অনায়াসে। সংসারের প্রতিদিনের অ্যাসপারাগাস নিজেই বাড়ির আঙ্গিনায়, ব্যালকনিতে বা ছাদে বড় বড় টবেই উৎপাদন করে নেয়া যায়।




1 টি মন্তব্য:

Unknown বলেছেন...

বাংলায় এই সবজিটার নাম...??