সোমবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৪

মেজর জিয়া ১৯৭১ থেকে ১৯৮১




মেজর জিয়া ছিলেন একজন ভাগ্যবান। নইলে তার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কথা নয়, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করার কথা নয়। রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার তো কথা নয়ই। 


তিনি সামান্য এক মেজর ছিলেন, যাকে ৭১ এর মার্চ মাসেও সাধারণ মানুষ চিনতো না। কিন্তু মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ, স্বাধীনতার অগ্রদূত বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু মেজর জিয়ার আটপৌরে সৈনিক জীবনে সৌভাগ্যের অভাবনীয় দ্বার খুলে দিল। 
৭১ সনের মেজর জিয়াউর রহমান ৭২ সনের ফেব্রুয়ারিতেই কর্নেল পদ লাভ করেন। এরপর ৭৩ সালের মাঝামাঝিতে ব্রিগেডিয়ার, এই সনেই অক্টোবর মাসে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। ৭২ সনেই তাকে করা হয়েছিল সেনাবাহিনীর উপাধ্যক্ষ। ৭৫ সনে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের বেনিফেসিয়ারি হিসেবে জিয়া প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পান। এরপর নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সায়েমের কাছ থেকে বলপূর্বক প্রথমে মুখ্য সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ছিনিয়ে নেন, তারপর প্রেসিডেন্টের পদটিও। পৃথিবীতে জিয়াউর রহমানই একমাত্র ব্যক্তি,যিনি একই সময়ে রাষ্ট্রপতি, সামরিক আইন প্রশাসক, সেনাপ্রধান এবং মুখ্য সামরিক আইন প্রশাসক ---- এই চার পদ দখলে রাখেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘদিনের ত্যাগ তিতিক্ষা এবং নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দল মত নির্বিশেষে সমগ্র জাতিকে এক পতাকার তলে আনায়ন করেন। রাজনৈতিকভাবে স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দল বিপুল ভোটে সংখ্যা গরিষ্ঠা অর্জন করলেও ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে পাক সরকারের টাল বাহানা জাতিকে দ্রুত স্বায়ত্বশাসনের দাবী থেকে স্বাধীনতার দাবীর দিকে ধাবিত করে। বঙ্গবন্ধুরও আজন্ম ইচ্ছা ছিল স্বাধীনতার। জাতি এবং বঙ্গবন্ধু যখন একই দাবীতে একই সমান্তরালে চলে এলো তখনই ঘটলো মাহেন্দ্রক্ষণ। যার নাম ৭১ এর ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু সমগ্র জাতির সামনে অকুতোভয় কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তিনি যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে বললেন। এরই ফলশ্রুতিতে লড়াকু জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশের সর্বত্র প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
২৬ মার্চেই বাঙলাদেশের বেশির ভাগ শহরে প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল। কেউ কারো আদেশের উপর অপেক্ষা করেন নি। তবে ইপিআর এর হাবিলদার মেজর মুজিবর রহমান তার চুয়াডাঙ্গা ঘাঁটিতে বিদ্রোহ করেন ২৫ মার্চের রাতে। দিনাজপুরের একটি সীমান্ত আউট পোস্টে ২৫ মার্চের রাতেই ইপিআরের কম্যান্ডার ভুলু মিয়া তার সঙ্গীদের নিয়ে অবাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করেন এবং সেখানে উড়িয়ে দেন বাংলাদেশের পতাকা। কুস্টিয়ায় ২৬ মার্চ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন আবু ওসমান। সিলেটে খালেদ মোশাররফ এবং ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় শাফায়াত জামিল বিদ্রোহ করেন ২৭মার্চ।
ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম ২৫ মার্চ রাত পৌনে নয়টার মধ্যে ইপিআরের জওয়ানদের নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেন। তিনি চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের সর্বোচ্চ বাঙালি সেনাপতি লে. কর্নেল এম এ চৌধুরী এবং অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল এর মেজর জিয়াকে খবর পাঠান ক্যান্টনমেন্ট আক্রমন করতে। ক্যান্টনমেন্টে তখন পশ্চিমা সৈন্য ছিল পাঁচ ছয় শত, অপরপক্ষে বাঙালি সৈন্যের সংখ্যা ছিল প্রায় দুহাজার। রফিক দাবী করেন তিনি আওয়ামী লীগের দুজন নেতার মাধ্যমে খবর পাঠিয়েছেন, তারাও নয়টার মধ্যে খবর পৌছে দিয়েছিলেন। কিন্ত লে কর্নেল চৌধুরী বা জিয়া কেউই আগে আক্রমনের কথা ভাবেন নি। ওদিকে ২০তম বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা বসে ছিল না। তারা অতর্কিতে ক্যান্টনমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের উপর হামলা করে রাত সাড়ে এগারোটায়। এতে লে কর্নেল চৌধুরীসহ হাজার খানেক বাঙালি সৈন্য নিহত হন। বেলুচ রেজিমেন্টের আক্রমনের খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান ছুটে যান জিয়ার কাছে। ততক্ষণে তিনি জানজুয়ার নির্দেশে সোয়াত জাহাজের অভিমুখে রওনা দেন অস্ত্র খালাস করতে, যা বাঙালি নিধনের জন্য আনা হয়েছিল। খালিকুজ্জামান এ খবর পেয়ে তখুনি গাড়ি নিয়ে জিয়ার পিছনে ছুটতে আরম্ভ করেন। ভাগ্যক্রমে একটা ব্যারিকেডের কাছে জিয়ার গাড়ি থামলে খালিকুজ্জামান তাকে ধরে ফেলেন এবং বাঙালিদের উপর পাকসেনাদের আক্রমণের খবর পৌছে দেন। জিয়া সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ষোলোশহরে নিজ ঘাঁটিতে আসেন এবং তার অধীনস্থ পশ্চিমা সৈন্যদের নিরস্ত্র করেন। কমান্ডিং অফিসারকে গ্রেফতারের পর তাকে ব্যাটম্যান দিয়ে হত্যা করেন। কিন্তু তিনি যা করেননি তাহলো উত্তর দিকে এগিয়ে গিয়ে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করা। কেন ক্যান্টনমেন্ট বা শহরের দিকে গেলেন না তার ব্যাখ্যা তিনি করেন নি।
২৫ মার্চের আগেই মেজর রফিক সীমান্তে অবস্থিত ইপিআরের জওয়ানদের সাংকেতিক ভাষায় জানিয়েছিলেন যে, দরকার হলে তাদের চট্রগ্রামে আসতে হবে। সেই আদেশ অনুযায়ী চট্টগ্রামের দক্ষিণ এং পূর্বদিক থেকে ইপিআর এর শত শত জওয়ান যাত্রা করেন চট্টগ্রামের দিকে। কিন্তু মেজর জিয়া কালুরঘাটে তাদের থামিয়ে দেন। ফলে কালুরঘাটে কদিনের মধ্যে ইপিআরের হাজার খানেক জওয়ান সমবেত হন। ওদিকে চট্টগ্রাম শহরে জওয়ানের অভাবে রফিককে পিছু হটে আসতে হয়। রফিক লিখেছেন, জিয়ার এই কৌশল ছিল আত্মঘাতী ( রফিক ১৯৮৬)।
জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করারও ৪০ ঘন্টা আগে থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বাঙালি নিরাপত্তা কর্মী এবং ছাত্র জনতা স্বতস্ফূর্তভাবে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। তার ঘোষণাপাঠ শুনে কেউ সংগ্রাম আরম্ভ করে নি। তবে সে সময় একে অপরের সাথে যোগাযোগ করার মত কোন মাধ্যম ছিল না, ফলে কে কোথায় কী অবস্থানে আছে, এবং দেশের বর্তমান পরিস্থিতি কী তা জানার উপায় ছিল না, যোগাযোগ ও সমন্বয়ের অভাবে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে বাঙালীদের আক্রমণ প্রতিরোধ পর্যায়ে ছিলো। যারা বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তারা এ ঘোষণাপাঠের মাধ্যমে জানতে পারেন যে সারাদেশেই স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এতে সবাই মনোবল ফিরে পায় এবং নব উদ্যমে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধকে আরো সুসংহত করার জন্য পূর্ব রণাঙ্গনের বাঙালি কমান্ডারগণ সিলেটের একটি চা বাগানে মিলিত হন। এদের মধ্যে ছিলেন আবদুর রব, জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, সফিউল্লাহ, নূরুজ্জামান, নুরুল ইসলাম, মোমিন চৌধুরীসহ আরো অনেকে। তারা সবাই একজন নেতা খুঁজছিলেন। এসময় সাবেক কর্নেল ওসমানী গোঁফ কামিয়ে ঢাকা থেকে পালিয়ে এসে কুমিল্লায় খালেদ-শাফায়াতের সাথে মিলিত হয়েছিলেন। শাফায়াত জামিল লিখেছেন, "তিনি ঢাকায় মানুষ হতাহতের কথা কিছু বলেন নি। তবে তার পোষা কুকুর গুলিতে মারা যাওয়ায় তিনি বারবার দুঃখ প্রকাশ করছিলেন"। ওসমানী সবচেয়ে প্রবীন হওয়ায় মেজররা তাকেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে অনুরোধ করেন। ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসই প্রধান সেনাপতির দায়িত্বে ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ওসমানীর সাথে মেজর জিয়ার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। একাত্তরের ১১ জুলাই কোলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সভাপতিত্বে সেক্টর কমান্ডারদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যুদ্ধের সার্বিক রণকৌশল নির্ধারণ করাই এই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল। মেজর জিয়া এসময় একটা প্রস্তাব করেন যে, অবিলম্বে একটা যুদ্ধ কাউন্সিল গঠন করতে হবে। এই প্রস্তাবে কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। সুস্পষ্টই এটা ছিল যুদ্ধপরিচালনার ব্যাপারে সামরিক কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস। মেজর শফিউল্লাহ এবং খালেদ মোশাররফ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন, তারা বুঝতে পেরেছিলেন এটা জিয়ার কূটকৌশল। কারণ, ওসমানী অপসারিত হলে জৈষ্ঠ্যতা অনুযায়ী তখন জিয়াই হবেন সেনাপতি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ওসমানী তাজউদ্দিনকে তিনবার জিয়াকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিতে বলেন। ( মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী সরকারঃ মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি)।
জিয়াউর রহমান নিজে বলেছিলেন যে, তিনি ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের খেমকারানে যুদ্ধ করে প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। (জিয়াউর রহমান,১৯৭৪)। মুক্তিযুদ্ধে তিনি সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। যদিও মেজর রফিকুল ইসলামের মতে, তিনি তার অঞ্চলে ভ্রান্তভাবে পরিকল্পিত একটি অভিযান করতে যেয়ে একদিনে ৬৭ যোদ্ধা হারিয়েছিলেন। শাফায়াত জামিলও এই যুদ্ধের কথা লিখেছেন। গোটা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অন্য কোন সেক্টরে অভিযান চালাতে যেয়ে এ রকম অপূরণীয় ক্ষতি আর কারো দ্বারা সংঘটিত হয় নি। (রফিকুল ইসলামের সাক্ষাৎকার,২০/৯/২০০৯)। এই ঘটনা ঘটেছিল ৩১ জুলাই ভোর রাতে কামালপুর ঘাঁটিতে। এই যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিনসহ ৬৭জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন। তবে তার জেড ফোর্সের সহযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন অনেক নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক। এদের মধ্যে বীর উত্তম উপাধি পেয়েছিলেন সাতজন,বীর বিক্রম উপাধি সাতজন এবং বীর প্রতীক উপাধি পেয়েছিলেন ছয়জন।
স্মৃতিচারণ করে জিয়াউর রহমান বিচিত্রায় লিখেছেন," ৭মার্চ রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে একটা গ্রীন সিগন্যাল বলে মনে হলো। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দিলাম, কিন্তু কোন তৃতীয় ব্যক্তিকে জানালাম না"। (জিয়াউর রহমান,বিচিত্রা,স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা,১৯৭৪) । একটা কথা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, তা হলো তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে " আমাদের পরিকল্পনার চূড়ান্ত রূপ দিলাম" ভাষ্য মোতাবেক প্রতিরোধ তৈরি করেন নি বা স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার কাজটাও তার নিজস্ব মস্তিস্কপ্রসূত নয়। দুটো বিষয়ই অন্যের দ্বারা আরোপিত। ক্যাপ্টেন খালিকুজ্জামান তাকে রাস্তা থেকে ফিরিয়ে আনেন, যদি তাকে দৈবক্রমে রাস্তায় না পেতেন তাহলে কী যে হতো বলা মুস্কিল। অন্যদিকে বেলাল মোহাম্মদ পটিয়া থেকে জিয়াকে নিয়ে আসেন কালুর ঘাটে সম্প্রচার ভবনে এবং স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার প্রস্তাব করেন। বরং ২৫/২৬ মার্চে যখন বিভিন্ন স্থানে বাঙালি সৈনিকরা রুখে দাঁড়িয়েছেন, তখন তিনি যাচ্ছেন অস্ত্র খালাস করতে সোয়াত জাহাজের অভিমুখে। জিয়াউর রহমান নিজেই লিখেছেন "সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্রশস্ত্র খালাস করার জন্য নৌবাহিনীর সদর দপ্তরে গিয়ে কমান্ডিং অফিসারের কাছে আমার রিপোর্ট করার কথা। এজন্য ঘাঁটি থেকে রওনা দেই রাত এগারোটায়"। (জিয়াউর রহমান, বিচিত্রা, স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা,১৯৭৪)। অলি আহমদ লিখেছেন, জিয়া রওনা দিয়েছিলেন রাত পৌণে বারোটায়। (অলি আহমদ ২০০৪)। যাই হোক, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বাধীনতা ঘোষণাপাঠ এবং প্রথম বাঙালি সেনাকর্তা হিসেবে বিদ্রোহ করার জন্য জিয়া অবশ্যই কৃতিত্বের দাবীদার।

২য় পর্বে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয় নি। তবে ঘটনাক্রমে কিছু কথা আগ পাছ হয়েছে। এখানে কিছু কথা আমি বুদ্ধিমানের জন্য ঈঙ্গিত হিসেবে উপস্থাপন করেছিলাম। ভেবেছিলাম তারা মিলিয়ে দেখবে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে এখন তা আরো বিস্তারিতভাবেই বলতে হচ্ছে। প্রথম কথা হলো,তৎকালীন ইপিআর ক্যাপ্টেন রফিক দাবী করেছেন, তিনি চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট আক্রমন করার জন্য লে. কর্নেল এম এ চৌধুরী এবং জিয়ার কাছে আওয়ামী লীগের দুজন নেতার মাধ্যমে খবর পাঠান। তার মতে এই দুজন রাত নটার মধ্যে সে খবর পৌছেও দিয়েছেন। কিন্তু তারা পদক্ষেপ নেন নি। ফলস্বরূপ উল্টো ২০তম বেলুচ রেজিমেন্ট রাত সাড়ে এগারোটায় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ করে হাজার খানেক বাঙালি সৈন্যকে তাদের পরিবারসহ হত্যা করে। এই ঘটনায় লে কর্নেল চৌধুরীও নিহত হন। এখন কথা হচ্ছে এই অবস্থায় জিয়ার সোয়াত জাহাজে অস্ত্র খালাস করতে যাওয়া নিয়ে। এই বিষয়টাকে কাউন্টার দেয়ার জন্য জিয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের তিন বছর পর আত্মপক্ষ সমর্থন করে ১৯৭৪ সনে বিচিত্রায় একটা স্মৃতিচারণমূলক লেখা লিখেছেন। সেখানে বলেছেন তিনি পাক সেনাদের নির্দেশ ও আদেশ অনুযায়ী রাত এগারোটায় সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস কর্ম সম্পাদনের উদ্দেশে নিজ ঘাঁটি পরিত্যাগ করেছিলেন। অর্থাৎ বেলুচ রেজিমেন্টের আক্রমণের আগেই তিনি নিজ ঘাঁটি পরিত্যাগ করেছিলেন, অর্থাৎ তিনি বাঙালি সেনাদের উপর পাক বাহিনীর আক্রমণের কথা জানতেন না। কিন্ত তার এই দাবী নাকচ করে দিয়ে অলি আহমদ লিখেছেন, জিয়া সোয়াত জাহাজের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন রাত পৌণে বারোটায়। অর্থাৎ তিনি বুঝাতে চেয়েছেন বেলুচ রেজিমেন্ট দ্বারা চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট আক্রান্ত হওয়ার পর জিয়া সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের কাজে রওনা দেন। এখানে আমি প্রসঙ্গক্রমে কাদের সিদ্দিকি লেখা "স্বাধীনতা ৭১" বই থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি। তিনি লিখেছেন, জিয়া যাচ্ছিলেন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে আত্মসমর্পণ করতে। অলি আহমদ তাকে বলতে গেলে গুলি করার হুমকি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দিকে ফিরিয়ে আনেন। আরো তথ্য দিচ্ছি -----
"
রাত এগারোটায় অফিসার কমান্ডিং জানজুয়া আকস্মিকভাবে মেজর জিয়ার কাছে নির্দেশ পাঠালেন এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে বন্দরে যাবার জন্য। (বাঙালিদের উপর পাকিদের বিশ্বাস ছিল না, যতই তারা পাকিপ্রেমে বুঁদ হোক না কেনো), তাই জানজুয়া শুধু নির্দেশ দিয়েই নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না তাই রাত সাড়ে এগারোটায় নিজে এসে হাজির হলেন জিয়ার কাছে। তাকে নৌ বাহিনীর একটা ট্রাকে তুলে দিয়ে ষোলশহর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বন্দরের দিকে রওনা করিয়ে দেন। আগ্রাবাদে যখন বড় একটা ব্যারিকেডের সামনে বাঁধা পেয়ে তার ট্রাক দাঁড়িয়ে পড়ে তখনই খালেকুজ্জামান তার কাছে দৌঁড়ে আসেন। হাত ধরে তাকে টানতে টানতে নিয়ে যান রাস্তার ধারে। 'পশ্চিমারা গোলাগুলি শুরু করেছে,শহরের বহুলোক হতাহত হয়েছে'-- খালেকুজ্জামানের উত্তেজিত কণ্ঠ থেকে কথা কয়টি ঝরে পড়ে। কি করবেন জিয়া ভাই এখন? --- খালেকুজ্জামান দ্রুত ফিরে গেলেন ষোলশহরের দিকে আর জিয়া নিজের আস্তানায় এসে পশ্চিমা অফিসারকে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেন। এরপর চলে যান জানজুয়ার বাড়ি। সেখানে গিয়ে তাকে গ্রেফতার করেন"। (বাংলার সংগ্রামঃআবুল কাশেম ফজলুল হক)। জিয়া জেনেছেন বেলুচ রেজিমেন্ট ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ করেছে,মানে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তাহলে ফিরে এসে কেনো তিনি জানজুয়াকে হত্যা না করে গ্রেফতার করলেন? জিয়াকে লেখা জানজুয়ার একটা চিঠির লিংক এই ফেসবুকেই কোন এক বন্ধু পোস্ট করেছিলেন। এই জানজুয়ার মৃত্যুতে বেগম জিয়া বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে সমস্ত প্রটোকল ভেঙ্গে শোকে অভিভূত হয়ে জানাজায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।
এরপর স্বাধীনতা ঘোষণা প্রসঙ্গ। "শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে হান্নানের ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার পর বেতারকর্মীরা নিরাপত্তার অভাববোধ করেন। তাই বেলাল আহমদ ২৭ মার্চ পটিয়ায় যান সেখানে যে বাঙালি সৈন্যরা আছেন, তাদের বেতার ভবন পাহারা দেয়ার জন্য তাদের সাহায্য চাইতে। সেখানে গিয়ে শোনেন, সেখানকার সৈন্যদের মেজর জিয়া সবচেয়ে সিনিয়র। তিনি তাকে অনুরোধ করেন বেতার ভবন পাহারার জন্য কিছু সৈন্য দিতে। তিনটি লরীতে সৈন্য নিয়ে জিয়া নিজেই আসেন কালুর ঘাটে। সম্প্রচার ভবনে বসে বেলাল আহমদ জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার জন্য একটা প্রস্তাব দেন। ঘোষণা দেয়ার এই সুযোগটি জিয়া সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করেন। জিয়া প্রথমে নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে লিখলেও, অন্যদের পরামর্শে "জাতির সর্বোচ্চ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান" এর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা দিচ্ছেন বলে সংশোধন করেন।" (মুক্তিযুদ্ধ ও তারপরঃ গোলাম মুরশিদ)।এ প্রসঙ্গে বেলাল মোহাম্মদ তার "স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র" বইতে বিস্তারিত লিখেছেন। তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে লিখেছেন -- এ তথ্য গোলাম মুর্শিদের বই ছাড়াও আরো অনেক বইতে লেখা আছে। আগ্রহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন।
জিয়া সম্পর্কে আনিসুজ্জামান লিখেছেন,"আমরা সেখানে পৌছার পর পরই জিয়া এলেন টেলিফোন করতে বা অন্য কোন কাজে। পরিচয় পর্বের পর আমি তাকে বললাম,বেতারে আপনার আপনার ভাষণ শুনেছি। তিনি জানতে চাইলেন কোনটা ? বললাম, যেটায় শেখ মুজিবের নামে ঘোষণা করেছেন। জিয়া নিস্পৃহভাবে বললেন, পুওর শেখ।হি মাআস্ট বি রটিং ইন দি আটক প্রিজন নাউ। আমি চমকে উঠে জানতে চাইলাম, ডু ইউ নো ফর শিওর ?উনি বললেন, দিস ইজ মাই গেস"। (আমার একাত্তর,পৃঃ ৪৫)
এরপর আসি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কিছু কথায়।
"
এক প্রশ্নের উত্তরে তৎকালীন সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ জানাচ্ছেন, ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জিয়া একসময় ওসমানীকে কমান্ডিং চীফ থেকে সরিয়ে দেবার কথা চিন্তা করেন। এ ব্যাপারে তিনি আমাকে বলেন, জেনারেল ওসমানী বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। সুতরাং ইয়ংদের মাঝ থেকে দায়িত্ব নিতে হবে। আমি এই প্রস্তাবের প্রতিবাদ করি এবং এ ব্যাপারে আমার সাথে তাকে আর কোন কথা না বলার জন্য বলি। এমন আরো ঘটনাই আছে যা প্রমাণ করে তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও ক্ষমতালোভী ছিলেন"। (মেজর রফিকুল ইসলামঃ সামরিক শাসন ও গণতন্ত্রের সংকট। পৃঃ ৫২)
"
কলকাতার পাকিস্তানী হাই ডেপুটি কমিশনারের অফিসের পরিবর্তিত নাম হয় বাংলাদেশ মিশন, কিন্তু তা এটা শুধু নামেই। তখন এটা ছিল চক্রান্তকারীদের আড্ডাখানা। এর ভিতরে শিশু স্বাধীন বাংলাদেশকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, মহম্মদ খালেদ প্রমুখ হাফ লিডাররা সকাল সন্ধ্যায় সেখানে মিলিত হয়ে ফিসফিস শুরু করে দেন। সে আড্ডার অন্যতম সদস্য ছিলেন জিয়াউর রহমান"।(জ্যোতি সেনগুপ্তঃ বাংলাদেশঃ ইন ব্লাড এ্যান্ড টিয়ার্স)।
"
স্বাধীনতা যুদ্ধে তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ ঘোষণা, যুদ্ধকালীন সময়ে তার রহস্যজনক আচরণ, স্বাধীনতা উত্তর যুগে তার বিভিন্ন কার্যক্রম থেকে একথা প্রমাণিত যে, জিয়াউর রহমান একজন উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি ছিলেন। জিয়াউর রহমানের শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতার কথা কর্নেল তাহের তার জবানবন্দীতে লিপিবদ্ধ করে গেছেনঃ

জিয়া ব্যক্তিগত জীবনে পরিশ্রমী, কর্মঠ এবং সৎ ছিলেন। কিন্তু দুটো সুযোগ আর বাংলাদেশের রাজনীতি তাকে জীবনের মূলধারা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। স্বাধীনতা ঘোষণাপাঠ আর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুযোগ -- তাকে কর্ম দিয়ে সাফল্য অর্জনের চেয়ে সুযোগের সদ্বব্যবহারের দিকে আগ্রহী করে তুললো। এর সাথে যুক্ত হলো বাংলাদেশের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন রাজনৈতিক বিভক্তি আর ব্যক্তিস্বার্থ কেন্দ্রিক দলাদলি। তিনি এই বিষয়টিকে তার জীবনের ইতিবাচক দিক হিসেবেই গ্রহণ করলেন। তিনি যোগাযোগ রাখলেন এদের সাথে বিশেষ করে মোস্তাকপন্থীদের সাথে। মোস্তাক পাকিস্থানপন্থী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের একটা গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্বে থেকেও কীভাবে মুক্তিযুদ্ধকে বিনাশ করে পাকিস্তানের সাথে একটা কনফেডারেশন গড়ে তোলা যায় তার প্রচেষ্ঠা মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত চালিয়ে গেছেন। জিয়া এই গ্রুপের সদস্য ছিলেন। এর কারণ হিসেবে বলা যায় তিনি মুক্তিযোদ্ধা হয়েও পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন। শাফায়াত জামিল লিখেছেন," পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগে এমন বাঙালিদেরই নেওয়া হতো যারা সত্যিকার পাকিস্তানপন্থী এবং বাঙালি বিদ্বেষী। জিয়াউর রহমানও পাঁচ বছর কাজ করেছিলেন পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগে"। (জামিল ২০০৯)।
বাঙালি শংকর জাতি। শংকর আর মিশ্র এক কথা নয়। শংকর হলো তা-ই, যা একই মানুষের ভিতরে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। যেমন কোন বাঙালির চুল যদি হয় নিগ্রোদের মত, তবে আচরণে অষ্ট্রিক, আবার মননে সে দ্রাবিড়। এই দূরূহ বাঙালি সত্ত্বার জাতীয় জীবন যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বহুধায় বিভক্ত হলো। যেমন, যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, দালাল, মোসায়েব, ভারত ফেরত, পাকিস্তান ফেরত, পাকিস্তানপন্থী, ভারত বিদ্বেষী, অমুক্তিযোদ্ধা, আসল মুক্তিযোদ্ধা, নকল মুক্তিযোদ্ধা, (ভারতে ট্রেনিং পাওয়া এবং আঞ্চলিক বাহিনীর কাছে ট্রেনিং পাওয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা তিন লাখের বেশি ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিয়েছিল এগারো লক্ষ। তার মানে, আট লাখই ছিল ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। অ্যান্টনি, ১৯৮৬)। এমন অবস্থায় দেশের সেনাবাহিনীকে দেশ রক্ষার কাজে নিঃশর্তে নিবেদিতপ্রাণ হতে হয়। কারণ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার মত যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশকে গড়ে তোলাও তাদের কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। একদিকে যুদ্ধবিধস্ত বাংলাদেশ, অন্যদিকে আলাদীনের প্রদীপের মাধ্যমে পাওয়া স্বপ্নপূরণ আকাঙ্ক্ষী বুভুক্ষু জনগণ, তরুণ সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয়, তার উপর যুদ্ধের প্রয়োজনে বাঙালি সেনা উপরস্থ পাকসেনাদের হুকুম অমান্য করে শৃঙ্খলা ভাঙ্গলেও তা তাদের চেতনায় রয়ে গেলো আইন বা শৃঙ্খলা ভাঙ্গার মানসিকতা হিসেবে। এমন এক কঠিন ও জটিল অবস্থায় জিয়াউর রহমান সর্বনেশে খেলায় মেতে উঠলেন। জিয়াউর রহমানের গ্রহণযোগ্যতা মুক্তিযোদ্ধা, সেনাবাহিনী, পাকিস্তান ফেরত সেনাবাহিনী --- সবার কাছেই ছিল। তিনি এই বিশ্বাস আর আস্থাকে হীন উদ্দেশ্যে কাজে লাগালেন। জিয়া সেনাবাহিনীকে বঙ্গবন্ধুর নামে অপপ্রচার চালিয়ে ক্ষেপিয়ে তোলেন, অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তান ফেরত সৈন্যদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব লাগান।
বঙ্গবন্ধু জিয়াকে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই পদোন্নতি দিয়ে মেজর থেকে মেজর জেনারেল এবং উপাধ্যক্ষ করেন। তারপরেও জিয়া সফিউল্লাহ থেকে সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু জিয়াকে সেনাবাহিনীর প্রধান না করে সফিউল্লাহকে সেনাবাহিনীর প্রধান করেন। বঙ্গবন্ধুর তো কারো প্রতি আক্রোশ ছিল না, তিনি কত দালালকে ক্ষমা করেছেন, তার প্রতিপক্ষকে যথার্থ মর্যাদা দিয়েছেন। তা ছাড়া, তার চারপাশে সেই সব ক্ষতিকারক মোসায়েবরাই তো ছিল, যাদের সাথে জিয়ার যুদ্ধ চলাকালীন সময় থেকেই যোগ সাজস ছিল। তাহলে কেনো বঙ্গবন্ধুর ভালো খাতা থেকে জিয়ার নাম কাটা গেলো ? জিয়ার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুকে কান ভাঙ্গানি দিলো কে ? খুব সম্ভব মোশতাক। কারণ, তিনি নিজে একজন বিশ্বাসঘাতক ছিলেন, ঝানু রাজনীতিক ছিলেন। তিনি নিজের দর্পনে নিশ্চয়ই জিয়ার ভেতরের উচ্চাভিলাষী ক্রুর রূপটি দেখতে পেয়েছিলেন। যাই হোক, বঞ্চিত ক্ষুব্ধ জিয়া তার ব্যক্তিগত আক্রোশকে সেনা বাহিনীর শৃংখলা ধবংসে কাজে লাগালেন। "সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে বিশৃংখলা সৃষ্টি করার এবং অপপ্রচার চালানোর জন্য সে বিভিন্ন স্তরে কাজ শুরু করে। অফিসারদের মধ্যে কাজ করার জন্য ব্যক্তিগতভাবে তার অনুগত, এমন কিছু অফিসারকে সে নিয়োগ করে। অনুরূপভাবে জেসিও, এনসিও এবং সৈনিকদের মধ্যে কাজ করার জন্য কয়েকজন জেসিওকে নিয়োগ করে। সেনাবাহিনীতে অশুভ কিছু ঘটলে তার দায় পড়তো সফিউল্লাহর উপর, আর ভালো কিছু হলে সঙ্গে সঙ্গে প্রচার হতো যে, এটা জিয়ার জন্য হয়েছে। সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে মীর শওকত আলী, এম এ মঞ্জুর এবং নুরুল ইসলাম শিশু জিয়াউর রহমানের সাথে ষড়যন্ত্রে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন"। (ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস)।
পাকিস্তান ফেরত বাঙালি সৈন্য আর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে জিয়া কীভাবে দ্বন্দ্ব লাগাতেন তার একটা বিবরণ দিয়েছেন তার একসময়ের বন্ধু মীর শওকত আলী। তিনি লিখেছেন," সে (জিয়া) প্রত্যাগতদের সাথে সুসম্পর্ক রেখে চলতো। কিন্তু গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের উস্কিয়ে দিতো প্রত্যাগতদের বিরুদ্ধে। প্রত্যাগতদের মধ্যে কিছু অফিসারের আস্থা অর্জন করে অনুরূপভাবে তাদের ক্ষেপিয়ে তুলতো মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে। চুয়াত্তরের প্রথম দিকের কথা। পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত পুরাতন বন্ধুদের সাথে আমার বন্ধুত্ব অক্ষুণ্ন ছিল। তাদের সাথে মেলামেশা জিয়ার চোখ এড়ায় নি। একদিন সে তার অফিসে এক প্রত্যাগতের নাম উল্লেখ করে বলল, তার সাথে তোমার এত ঘনিষ্ঠতা কেনো ? বললাম, সে আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। ---- জিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, 'শওকত, কোন প্রত্যাগত অফিসার তোমার বন্ধু হতে পারে না। তোমার মত একজন মুক্তিযোদ্ধার পাকিস্তানীদের সাথে ঘনিষ্ঠ রাখা ঠিক নয়'হঠাৎ করে আমি যেন দিব্যদৃষ্টি পেলাম। সেনাবাহিনীতে তখন যে সকল ঘটনা ঘটেছিল আমার কাছে তার অনেক কারণ পরিষ্কার হয়ে উঠলো। অবশ্য আমি আগেও কিছু কিছু জানতাম। কিন্তু জিয়া আমার কাছে ধরা দেবে তা আশা করি নি। আমি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বললাম, 'স্যার, আমি দুঃখিত। আপনার সাথে একমত হতে পারছিনা।---- অনুগ্রহ করে আপনি খেলা বন্ধ করুন। জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করে সেনাবাহিনীতে বিভেদ সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকুন। আপনি সেনা বাহিনীর উপপ্রধান। আপনি যদি এ ধরণের ষড়যন্ত্রমূলক কাজে লিপ্ত হন, তাহলে আমাদের জুনিয়রগণ কী করবে' ? কথাগুলো বলে আমি চলে আসি। কড়া কথা ইচ্ছে করেই বলেছিলাম। এজন্য অবশ্য আমাকে ব্যক্তিগতভাবে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। খন্দকার মোশতাকের আমলে সেনাবাহিনীর প্রধান হয়ে জিয়াউর রহমান প্রথমেই আমাকে সেনাবাহিনী থেকে অবসর দেয়। পরবর্তীকালে ক্ষমতার শীর্ষে বসে জিয়াউর রহমান আমার বিরুদ্ধে যেসব হয়রানিমূলক পদক্ষেপ নেয়, তার জের এখনো চলছে।
বিভিন্ন কারণে সেনা অসন্তোষের ফলে বঙ্গবন্ধু সরকার অবিভক্ত বাংলার সিভিল সার্জেন্ট প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তানের সচিব এ রবকে প্রধান করে জাতীয় পে কমিশন গঠন করেন। কমিশনকে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বেতনের স্কেল নির্ধারণের পরামর্শ দেয়া হয়। কমিশন তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধির দলকে বুলগেরিয়া, যুগোশ্লোভিয়া ও পুর্ব জার্মানিতে সে দেশের পে পলিসি সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ করার জন্য প্রেরণ করেন। সে দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন জিয়াউর রহমান। কমিশন পরামর্শ প্রদান করেন এভাবে ----
Bangladesh should have pay policy involving sharing of hardship in an equitable manner.
(Group Interests And Political Change in Bangladesh Ibid,page no 236 37)

"
অথচ এই পে কমিশনের জন্য একজন প্রভাবশালী সদস্যরূপে জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর জন্য যে গ্রেড ও পে স্কেলের জন্য সুপারিশ করেন তা সেনাবাহিনীর বিক্ষোভকে আরো উত্তপ্ত করে তোলে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর মনোভাব আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর মাথা গরম করার জন্য এই কৌশল গ্রহণ করেছিলেন বলে দেশপ্রেমিক অফিসারদের কেউ কেউ মনে করেন"।
(
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডঃফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস,পৃঃ ৯৬ ৯৭
)
"
সেনাবাহিনীতে প্রচার হতে লাগল যে, রক্ষীবাহিনীতে আধুনিক অস্ত্র দেয়া হচ্ছে যা সেনাবাহিনীতে দেয়া হচ্ছে না।রক্ষীবাহিনীকে নতুন গাড়ি দেয়া হচ্ছে,তাদের রেশন ও বেতন সেনাবাহিনীর চেয়ে বেশি। এসব প্রচারণার কোনটাই সত্য ছিলনা। অনেকটা ছিল উদ্দেশ্যমুলক ও কিছু ভুল বুঝাবুঝির ফল। আর সেনাবাহিনীর কিছু উচ্চপদস্থ অফিসার এ প্রচারণার নেতৃত্বে ছিল। পয়লা নম্বরে ছিল সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপপ্রধান জিয়াউর রহমান"। (বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডঃফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস,পৃঃ ৯৬ ৯৭)

জাতীয় জীবনে সেনাবাহিনী একটা স্পর্শকাতর জায়গা। তাই সব দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী দল মত নির্বিশেষে রাজনীতির বাইরে থাকেন। সিভিল সমাজের সাথে এদের কোন সম্পৃক্ততা কোনভাবেই থাকার কথা নয়। কিন্তু জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর উপপ্রধানের মত একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও সব ধরণের মানুষ এবং বিশেষ রাজনৈতিক দল ও আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির সাথে তার যোগাযোগ ছিল। এটা যে বন্ধুত্ব বা সম্পর্কের খাতিরে তা নয়, এটা হলো তা-ই যা তার সুযোগসন্ধানী মনকে তাড়িত করেছে। উদ্দেশ্য হলো সবকিছু জেনে শুনে বুঝে নিজের গোপন ইচ্ছার একটা রূপরেখা দাঁড় করানো ও তা চরিতার্থ করা।

"
১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে জাসদ কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে বিপ্লবী গণবাহিনী গঠন করে। তাহেরের সাথে সংযোগ রক্ষা করে চলতেন সর্বহারা পার্টির মেজর জিয়া ও সেনাবাহিনীর ডেপুটি প্রধান জিয়াউর রহমান" (ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস)।
স্বনামধন্য লেখক মোহাম্মদ ইলিয়াস জানান," মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর-ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল সেক্টরে কর্নেল তাহের তদানীন্তন ব্রিগেডিয়ার জিয়ার ডেপুটি হিসেবে ময়মনসিংহ এলাকার সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। সেই থেকে তাদের নিবিড় যোগাযোগজিয়া তাহেরকে সেই সময় থেকেই ব্যবহার করতে থাকে"।

শীর্ষস্থানীয় বাস্তুকলাবিদ মাজহারুল ইসলাম অধ্যাপক আবু সাইয়িদকে জানান,
"
জিয়া মোশতাকের সাথেও যোগাযোগ রাখতেন মাহবুব আলম চাষীর মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, ক্যাপ্টেন জিল্লুর ও ক্যাপ্টেন মোখলেসের মাধ্যমে তোফায়েল আহমদের সাথেও তিনি যোগাযোগ রাখতেন"। (ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস)।

"
জিয়া এবং তাহের একে অন্যের প্রতি খুবই বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন। পঙ্গুত্বের কারণে তাকে সেনাবাহিনী থেকে অবসর দেয়ার পর জিয়া বরাবর তার সাথে সংযোগ রক্ষা করে চলেছেন। প্রকৃতপক্ষে তারা জিয়াকে সামনে রেখে চাইনিজ পদ্ধতির মাধ্যমে সেনাবিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলেন।(তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথাঃ লেঃ কর্নেল (অব) এম এ হামিদ পিএসসি)
পরেশ সাহা তার "বাংলাদেশঃষড়যন্ত্রের রাজনীতি বইতে লিখেছেন,
"
স্বাধীনতাযুদ্ধে বীরোত্তম কাদের সিদ্দিকীর যারা প্রতিপক্ষ তারা রটিয়ে দিয়েছিলেন, সশস্ত্র সংগ্রামের পথে তিনি সে কোন সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নেবার চেষ্টা করতে পারেন। এ রটনার কথা জিয়াও জানতেন। একদিন কী মনে করে কাদের সিদ্দিকীর বাড়িতে গিয়ে হাজির হলেন জিয়া। এ সম্পর্কে কাদের সিদ্দিকী আমায় বলেছেন, সে সময় জিয়া তার কাছে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অনেক কথা বলেন। কিন্তু সিদ্দিকী জিয়ার কথা উপর খুব একটা গুরুত্ব আরোপ করেন নি। তিনি ভেবেছিলেন,সেনাবাহিনীর প্রধান পদটি না পেয়ে জিয়ার মনে যে আঘাত লেগেছে, মুজিবের বিরুদ্ধে অভিযোগের পর অভিযোগ করে সেই জ্বালা কিছুটা প্রশমিত করার চেষ্টা করছেন।"
একাধিক বইতে লেখা আছে জিয়া উচ্চাভিলাষী, ক্ষমতালিপ্সু, প্রতিহিংসাপরায়ণ, চালাক ও ধূর্ত ছিলেন। এসব কথা লিখেছেন, গোলাম মুরশিদ, এ্যান্টনি ম্যাসকার্নহাস, শাফায়াত জামিল, লেঃ কর্নেল এম এ হামিদ, পরেশ সাহা, মেজর রফিকুল ইসলাম, মাহমুদুল বাশার প্রমুখ।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ফারুক ৭ নভেম্বরের ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, জিয়া তাহেরের চেয়ে অধিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও চালাক হওয়ায় তার উদ্দেশ্য সফল হয়।( তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথাঃ লেঃ কর্নেল (অব) এম এ হামিদ পিএসসি)।
বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর পর মোশতাকের অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফারুক রশীদের পীড়াপীড়িতে জিয়াকে প্রধান সেনাপতি করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে " মোশতাক, ওসমানী খলিলুর রহমান -- সবাই চাচ্ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী জিয়াকে সেনাপ্রধান পদ থেকে সরিয়ে দিতে।
"
তিনি ছিলেন খুব ধূর্ত ও বুদ্ধিমান। খুব ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। নিজের সত্যিকার ইচ্ছা কাউকে বুঝতে দিতেন না। নিজের লক্ষ্য হাসিলের জন্য পরম উপকারীকেও নির্দয়ভাবে খতম করে দিতে দ্বিধাবোধ করতেন না"। (মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর/গোলাম মুরশিদ)।
উচ্চাকাঙ্ক্ষার বাস্তুবায়ন ঘটাতেই জিয়া বিপরীত আদর্শ, নিষিদ্ধ দল, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ পোষণ করে এমন সব মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে। এই সূত্রেই যোগাযোগ হয় ঘাতক ফারুক রশীদের সাথেও।
এটা হলো তার ভিতরের অন্তর্নিহিত আসল রূপ। অথচ বাইরে তার প্রকাশ ছিল ভিন্ন ধরণের।
মীর শওকত আলী কারাগারের ডায়েরিতে লিখেছেন,একদিন সন্ধ্যার পর সফিউল্লাহ, জিয়া, আমি শাফায়াত বঙ্গবন্ধুর বাসায় একটা জরুরী বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়েছিলাম, আলোচনার শেষে হঠাৎ জিয়া বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্যে বলল, স্যার, আমার বুক বিদ্ধ না করে বুলেট আপনার গায়ে লাগতে পারবে না। জিয়াউর রহমানের বঙ্গবন্ধুবিরোধী ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপ সম্বন্ধে আমি অবহিত ছিলাম,বলে বঙ্গবন্ধু ও আমরা তিনজন জিয়ার কথাগুলো উপভোগ করছিলাম। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, জিয়ার সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া ১৫ আগস্টের তথাকথিত অভ্যুত্থান ঘটানোর সাহস কেউ পেতো না। জিয়ার এই কথাগুলো ছিল নিছক ভাওতা"।
"
বঙ্গবন্ধুও একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন,জিয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা ।এখনো ছেলে মানুষ। দেশের অবস্থাও ভালো না। তাই মাঝে মাঝে একটু আধটু ষড়যন্ত্র করে"। (ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস)
১৯৭৪ সালে বিচিত্রায় স্মৃতিচারণমূলক রচনায় জিয়া লিখলেন,," ১৯৬৫ সালের শেষদিকেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই ক্যাডেটদের শেখানো হতো -- আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওদের (পশ্চিম পাকিস্তানীদের) সবচেয়ে বড় শত্রু।" (জিয়াউর রহমান, বিচিত্রা, স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা,১৯৭৪) ।
জিয়া যখনকার কথা এখানে লিখেছেন আসলে তখনো শেখ মুজিব জাতির পিতা বা বঙ্গবন্ধুতে পরিনত হন নি। তাহলে কেনো লিখলেন এ কথা? কারণ, ১৯৭২ সালে জিয়া সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু তাকে প্রধান সেনাপতি না করে সফিউল্লাহকে করেছিলেন। সফিউল্লাহর মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ১৯৭৫ এর মে মাসে। এবার যাতে তাকে প্রধান সেনাপতি করা হয় সে উদ্দেশ্যেই এই মোসায়েবি। কারণ জিয়া জানতেন বঙ্গবন্ধু তোষণ আর মোসায়েবি পছন্দ করেন। এই জন্যই বাকশাল গঠিত হওয়ার পর অতি উৎসাহে জিয়া স্বাগত জানিয়েছিলেন। "এমন কি, প্রতিটি জেলার বাকশাল প্রশাসককে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন"।(আবু সাইয়িদ ১৯৮৮)
একজন পেশাদার সৈনিক হিসেবে তার রাজনৈতিক সংযোগ রাখার অথবা বাকশালের মত একটা রাজনৈতিক পদক্ষেপকে অভিনন্দন জানানো বা সমালোচনা করা তার প্রটোকলে পড়ে না।
এই ছিল জিয়ার ভিতরে একরূপ আর বাইরে আরেক রূপ। জাতীয় চরিত্র হিসেবে মৌলিক শংকরায়ন,তবে তা নেতিবাচক অর্থে।

"
বঙ্গবন্ধুর হত্যার সাথে জিয়াউর রহমান জড়িত ছিলেন, এ কথা অনেকেই বলেছেন। তার ব্যক্তিগত ক্ষোভ ছিল যে, তাকে প্রধান সেনাপতি করা হয়নি। এছাড়া তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন, তাও তাকে উস্কানি দিয়ে উদ্বুদ্ধ করে থাকতে পারে"। (মুক্তিযুদ্ধ ও তারপরঃ গোলাম মুরশিদ)

আত্মস্বীকৃত খুনীদের যতবার সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে ততবারই তারা বলেছে যে জিয়া এ ব্যাপারে অবগত ছিলেন। এমন কি ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড সংঘটিত হওয়ার পর জিয়ার যে প্রতিক্রিয়া তা বিশ্লেষণ করেও অনেকে বুঝাতে চেয়েছেন যে, এ খুনের সাথে তার পরোক্ষ সম্পৃক্ততা আছে।

এক সাক্ষাৎকারে স্বয়ং ফারুক এ্যান্টনি ম্যাসকার্নহাসকে বলেছেন, জিয়ার সাথে যোগাযোগ করার পর "জিয়া বলেছে ,আমি দুঃখিত। আমি এসব ব্যাপারে জড়াতে চাই না। যদি তোমরা কিছু করতে চাও তাহলে এটা জুনিয়র অফিসারদেরই কাজ"।
(Interview with lt ccls Farooq and Rashid broadcast by the ITV on 2 August 1976)

"
এ্যান্টনি কিছুকাল পরে জিয়ার সাক্ষাৎকার উপলক্ষে যখন এ কথা তাকে মনে করিয়ে দেন,তখন জিয়া হা বা না কিছুই বলেন নি" (এ্যান্টনি ১৯৭৬)।

ব্রিগেডিয়ার রউফেল বলেছেন, "কোরান ছুঁয়ে ফারুক আমাকে এ কথা বলেছে যে, তারা জিয়াকে সরকার পরিবর্তনের কথা বলাতে তিনি বলেছেন, 'তোমরা করতে চাইলে করতে পারো। কিন্তু আমি যোগ দিতে পারবো না"।

"
জুলাই মাসে ঢাকা এসে আমি জেনারেল জিয়াকে একথা ঠিক কী না জিজ্ঞাসা করি। তিনি বলেছিলেন যে, ভেবে দেখবেন আমার প্রশ্নের জবাব দিবেন কী না।" ( ব্রিগেডিয়ার রউফেলের বক্তব্য)।

আত্মস্বীকৃত খুনী রশিদ পরবর্তীকালে জিয়া সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেছে, "জেনারেল জিয়া আমাকে বলতেন,'রশীদ ঘাবড়িও না। যদি কিছু ঘটে তবে তা আমার মৃতদেহের উপর দিয়েই ঘটবে'আমার বিশ্বাস, হয় তিনি একজন কাপুরূষ অথবা অত্যন্ত চালাক লোক। তিনি ধারণা করে থাকতে পারেন যে,আমরা একে অপরকে খতম করবো আর সেই সুবিধাটা তিনি ভোগ করবেন। (বাংলাদেশ রক্তের ঋণঃ এ্যান্টনি ম্যাসহার্নকাস/অনুবাদ মোহাম্মদ শাজাহান,পৃ১০০)

"
১৯ আগস্ট সকাল ৯টা। সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ ব্রিগেড কমান্ডারদের মিটিং ডাকলেন। ফারুক রশিদও উপস্থিত ছিল। এই মিটিং শুরু হওয়ার আগে কর্নেল শাফায়াত সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর সাথে তার অফিসে আলাদাভাবে ব্যক্তিগত পয়েন্টে মিলিত হন। তার সাথে ছিল তার স্টাফ অফিসার ব্রিগেড মেজর হাফিজউদ্দিন। শাফায়ত উত্তেজিতভাবে সফিউল্লাহকে বলল, স্যার, আপনি জেনে রাখুন, এগুলো সমস্ত গন্ডোগোলের পিছনে রয়েছে জেনারেল জিয়ার হাত। তার কথা শুনে সফিউল্লাহ হেসে উত্তর দিলেন। শাফায়াত, এই কথা বুঝতে তোমার এত সময় লাগলো "? (তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথাঃ লেঃ কর্নেল (অব) এম এ হামিদ পিএসসি)

"
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর উল্লসিত হয়ে ডালিমকে জিয়া বলেছিলেন,' কাম হিয়ার! (আবেগের সাথে ডাক দিল) ইয়্যু হ্যাভ ডান সাস আ গ্রেট জব।কিস মি! কিস মি'! জিয়া গভীর আবেগে ডালিমকে জড়িয়ে ধরেন"।
(
মেজর রফিকুল ইসলামঃ বাংলাদেশ সসামরিক শাসন ও গণতন্ত্রের সংকট পৃঃ৫১;
ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস পৃঃ ১৩৭)

বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর "ব্রিগেড দপ্তরে যাওয়ার পথে জামিল যান জিয়ার বাড়িতে। জিয়া তখন দাঁড়ি কামাচ্ছিলেন। মুজিব হত্যার খবর শুনে একটুও বিচলিত হননি।" (জামিল ২০০৯)।

"
জেনারেল সফিউল্লাহ তখন সুইডেনের রাষ্ট্রদূত। সেই সময় ১৯৮৭ সালের ৭ মার্চ এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে বলেন, জিয়া সম্পূর্ণ সামরিক পোষাক পরে সরকারি ড্রাইভার চালিত গাড়িতে এসেছেন, আর খালেদ মোশাররফ এসেছেন সম্পুর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় নিজের গাড়ি চালিয়ে। জিয়াকে দেখে মনে হচ্ছিল যে, তিনি সব কিছুর জন্য রেডি (প্রস্তুত) ছিলেন। তাই হয়ত ১৫ আগস্টের এত সকালে সামরিক পোশাকে সম্পুর্ণ ফিটফাট,এমন কি ক্লিন সেভড অবস্থায় ছিলেন। তাই আমার প্রশ্ন জাগলো তিনি কী কারো আদেশের অপেক্ষা করছিলেন?"
(
পরেশচন্দ্র সাহাঃ বাংলাদেশঃষড়যন্ত্রের রাজনীতি পৃ ৯৬)।
উপপ্রধান সেনাপতি হিসেবে জিয়ার দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল অভ্যুত্থানের বা ষড়যন্ত্রের বা বিদ্রোহের খবর পেয়ে বা আঁচ করে তাৎক্ষণিক ষড়যন্ত্রকারী বা ষড়যন্ত্রকারীদের,বিদ্রোহী বা বিদ্রোহীদের গ্রেফতার বা আটক করা। এটা সামরিক আইনের ৩১নং ধারার অন্তর্ভুক্ত। তিনি এই ধারা বরখেলাপ করে নিজেই দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন।

সেনাবাহিনীর আইনের ৩১ ধারাঃ
এই আইনের এখতিয়ারভুক্ত কোন ব্যক্তি নিম্নলিখিত কোন অপরাধ করলে অর্থাৎ---

১। বাংলাদেশের স্থল,নৌ অথবা বিমান বাহিনীতে কিংবা তাদের সঙ্গে সহযোগিতাকারী যে কোন বাহিনীতে কোন বিদ্রোহ করতে বা বিদ্রোহে যোগ দিতে শুরু করা, উৎসাহিত করা, বিদ্রোহ করা কিংবা বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র করা অথবা
২। এ ধরণের কোন বিদ্রোহে উপস্থিত থাকা, এ ধরণের বিদ্রোহ দমনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা না করা অথবা
৩। এ ধরনের কোন বিদ্রোহের অস্তিত্ব অথবা এ ধরণের বিদ্রোহের কোন অভিলাষ কিংবা এ ধরণের কোন ষড়যন্ত্রের কথা জানা সত্ত্বেও বা অস্তিত্ব আছে বলে মনে করার কারণ থাকা সত্ত্বেও বস্তুত বিলম্ব না করে তার কমান্ডিং অফিসারকে অথবা অপর কোন উর্ধ্বতন অফিসারকে খবর না দিলে -----
কোর্ট মার্শালের বিচারে তার প্রাণদন্ড দেয়া হবে।

জিয়া রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত থেকে, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বেতন ভাতা ও সুবিধা গ্রহণ করে, রাষ্ট্রের অনুগত থাকার অঙ্গিকার করা সত্ত্বেও সে দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছেন, বিদ্রোহীদের উৎসাহিত করেছেন। তার এ কর্ম না ন্যায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য না ধর্মের কাছে।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর প্রহর না কাটতেই ক্ষমতার হালুয়া বন্টন শুরু হয়ে যায়। একটা ক্রান্তি লগ্নেই কোন জাতির জাতীয় চরিত্র ফুটে উঠে। সব দেশের সব মানুষের মধ্যে লোভ, লালসা, প্রতিহিংসা আছে। কিন্তু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে নৃশংসতা অন্য জিনিস, এটা একমাত্র সভ্যতা বিরোধী অমানবিক পৈশাচিক উল্লাস মুহূর্তেই ধরা পড়ে। ১৫ আগস্ট থেকে মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত ধানমন্ডি থেকে ক্যান্টনমেন্ট -- সৈন্যদের রক্ত পায়ে পায়ে রক্তাক্ত প্রান্তরে পরিণত হয়েছিল। থকথকে রক্ত মাড়িয়ে যারা শুধু ক্ষমতা কুক্ষিগত করার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়, তাদের দ্বারা আর যাই হোক মানবতার কল্যাণ হওয়ার কথা নয়। মানবতার সেবা করার জন্য মানবিক বোধের প্রয়োজন। ১৫ আগস্ট থেকে শুরু করে মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত যে রক্তের হোলিখেলা চলেছে তা গভীর অনুসন্ধান আর পর্যবেক্ষণের দাবী রাখে। এটাকে এত সহজে সমীকরণ করা যাবে না।
আপাতদৃষ্টিতে অনেকেই অনেকভাবে ঘটনার বিশ্লেষণ করেছেন, কিন্তু মূল সত্যের গভীরে আলোকপাত করা হয়নি উপযুক্ত তথ্যের অভাবে। তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজনীয় উৎস সমূহ ও আলামত নষ্ট করা হয়েছে ঘটনার সাক্ষীদের খুব অল্পসময়ের মধ্যে নির্বিচারে হত্যা করার মাধ্যমে। বাকি তথ্যও অনুক্ত থেকে গেছে, কারণ ঘটনার নায়কগণই তখন সময়কে নিয়ন্ত্রন করছিল। সে সময় সবাই কোন না কোনভাবে, কোন না কোন ঘটনার সাথে জড়িত ছিল বলে প্রকৃত সত্যকে ধামাচাপাও দেয়া হয়েছে। তবে পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট দু একজনের লেখাতে বা বক্তব্যের প্রেক্ষিতে অন্তর্নিহিত সত্যকে একটু হলেও আঁচ করা যায়। কিন্তু এ নিয়ে আজ পর্যন্ত কেউ নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে গবেষণা কর্মে এগিয়ে আসেন নি। ফলে যে যার মত করে ইতিহাসে ঠাঁয় নিয়েছেন।

১৫ আগস্টের পর প্রধান চারটি ঘটনা সামনে চলে আসে। এক, মোশতাকের সিংহাসনে আরোহণ, খালেদ -শাফায়াতের উত্থান-পতন, তাহেরর নাট্যমঞ্চে আগমন-নির্গমন, জিয়ার ক্ষমতা লাভ।

মোশতাককে নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। আমি শুধু ঘটনার ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে দু একটা বই থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি ঃ-
লেখক খন্দকার ইলিয়াস তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন," মোশতাক সেই ৪৯ সাল থেকেই আওয়ামী লীগের একনাম্বার যুগ্মসম্পাদক হতে চেয়েছিলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হতে চেয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্য পারেন নি। তিনি মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন, পারেন নি। তার সেই মনোবাঞ্চা পূর্ণ হলো দেশি বিদেশি চক্রান্তের মাধ্যমে ৭৫ সালে ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর।"

"
সেনাবাহিনীর সবচেয়ে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আনুগত্য ঘোষণার পর, নিশিন্ত মনে মোশতাক ক্ষমতা গ্রহণ করলেন। বেতারে ভাষণ দিলেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী তার রাষ্ট্রপতি হওয়ার কোন সঙ্গত কোন কারনই ছিল না। কারণ রাষ্ট্রপতি না থাকলে দায়িত্ব পালন করবেন উপ-রাষ্ট্রপতি। উপ-রাষ্ট্রপতি না থাকলে সে দায়িত্ব পালন করবেন সংসদের স্পিকার। মোশতাক এর কোনটাই ছিলেন না। আর সেদিন কোন সামরিক অভ্যুত্থানও ঘটে নি। সামরিক অভ্যুত্থান ঘটলে সামরিক অফিসাররাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণ করতো। এটা ছিল একটা নৃশংস হত্যাকান্ড। তাই,কয়েকজন মেজরের কাঁধে চড়ে মোশতাকের সিংহাসনে আরোহণ করা -- এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। আত্মস্বীকৃত খুনী ফারুক রশিদের পীড়াপীড়িতে মোশতাক জিয়াকে প্রধান সেনাপতি করেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও। তবে জিয়ার ক্ষমতা খর্ব করা হলো অন্য কৌশলে। মোশতাক জিয়ার উপরে বসালেন পাকিস্তান ফেরত খলিলুর রহমানকে। তার জন্য চীফ অব ডিফেন্স স্টাফ নামক নতুন পদ তৈরি করা হল। খলিলের উপরে বসানো হল মুক্তিযুদ্ধ সময়কার সেনাপতি জেনারেল ওসমানীকে। তিনি হলেন রাষ্ট্রপতির সামরিক উপদেষ্টা। জিয়ার সহকারী করা হল এরশাদকে। এরশাদ তখন দিল্লিতে ট্রেনিং অবস্থায় ছিল। সেখান থেকে এনে সিনিয়রিটি ভেঙ্গে কোন নিয়ম নীতির ধার না ধেরে ব্রিগেডিয়ার এরশাদকে ডাবল প্রমোশন দিয়ে মেজর জেনারেল করে উপ প্রধান পদে অভিষিক্ত করা হয়।
মোশতাক ক্ষমতায় ছিলেন ৮২ দিন। এর মধ্যেই জেলে চার জাতীয় নেতাকে খুন করা সহ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন। অর্থাৎ শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে সেনাবাহিনীর অধঃস্তন সদস্যরা রাষ্ট্রপতিসহ অতোগুলো লোককে মেরে ফেলার যে গুরুতর অপরাধ ঘটিয়েছে, বেসামরিক বা সামরিক আদালতে তাদের কোন বিচার করা যাবে না।" ( মুক্তিযুদ্ধ ও তারপরঃ গোলাম মুরশিদ)।

আত্মস্বিকৃত খুনী ফারুক রশিদ ১৫ আগস্টের পর থেকে এবং বিদেশে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বঙ্গভবনেই অবস্থান করতো। মূলত ওরাই মোশতাকের নামে রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী ছিল। রশিদ ছিল ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিলের অধীনস্থ কমান্ডার। এই অধস্তনদের মাতব্বরি জামিল কিছুতেই মানতে পারছিল না। অন্যদিকে খালেদ মোশাররফের আগে থেকেই প্রধান সেনাপতি হওয়ার ইচ্ছে ছিল। যেহেতু জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে দেয়ার কথা ছিল তখন খালেদ ভেবেছিলেন, সফিউল্লাহর মেয়াদ শেষ হলে তিনিই হবেন প্রধান সেনাপতি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যখন সফিউল্লাহর মেয়াদ বৃদ্ধির ঘোষণা দেন তখন খালেদ মোশাররফ হতাশ হন। তাই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তার সেই ছাইচাপা ইচ্ছা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠে।

জিয়াও তার মাথার উপর খলিলুর রহমানকে তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না।
"
মোশতাক জিয়াকে কোন পাত্তা দিত না। এমন কি সরাসরি জিয়ার সাথে কথাও বলতেন না। মোশতাক সামরিক ব্যাপারে ওসমানীকেই প্রাধান্য দিতেন। এতে জিয়া ভিতরে ভিতরে মোশতাকের উপর খুবই নাখোশ ছিলেন"। (তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথাঃ লেঃ কর্নেল অবঃ এম এ হামিদ পি এসসি)।
কর্নেল হামিদ তার বইতে লিখেছেন," যেহেতু আমি ছিলাম স্টেশন কমান্ডার। এই সুবাদের জিয়ার সাথে আমার সরাসরি কথা হতো, তা ছাড়া জিয়া ছিলেন আমার কোর্সমেট। বন্ধুত্বের এক পর্যায়ে ওর সাথে আমার তুই তোকারির সম্পর্ক ছিল। জিয়ার অফিসে গেলেই সে রাগে গরগর করতো। ওসমানী ও খলিলকে কড়া ভাষায় গালিগালাজ করতো। আমাকে কয়েকবার ওসমানীর কাছে যেয়ে সরাসরি বুড়োকে সরে দাঁড়াবার কথা বলতে বলতো। জিয়ার অবস্থা তখন ছিল খাঁচাবন্দী বাঘের মত।" (তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা। পৃঃ ৯৪)।

"
খালেদ-শাফায়াত সেনাবাহিনীতে চেইন অফ কমান্ড প্রতিষ্ঠার জোর দাবী জানিয়ে জিয়াকে চাপ দিতে থাকে। তারা জিয়াকে ওইসব উচ্চাকাঙ্ক্ষী মেজরদের বিরুদ্ধে এ্যাকশন নিতে বলে। কিন্তু জিয়া তো মেজরদের উপর কৃতজ্ঞ। কারণ, তারাই তো তাকে চীফ অব স্টাফ বানিয়েছে। অতএব জিয়া কৌশলে একূল ওকূল দুকূল রক্ষা করেই চলতে থাকেন। একদিকে ফারুক রশিদের পিঠ চাপড়ানো, অন্যদিকে শাফায়াত জামিলের কাঁধে হাত।
জিয়া তলে তলে আর একটি কাজ করছিলেন। তাহলো তিনি সবার অজ্ঞাতে জাসদের কর্নেল আবু তাহেরের সাথে গোপন কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। জাসদের আর্মস উইং ইতোমধ্যে আন্ডার গ্রাউন্ড রাজনৈতিক কর্মকান্ডে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। শেখ সাহেবকে উৎখাতের জন্য পূর্বে তারাও প্রস্তুতি নিয়েছিল। জিয়া সবার অজ্ঞাতে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে তার সুহৃদ কর্নেল তাহেরের সাথে গোপনে কথাবার্তা চালিয়ে যান"।
(
তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথাঃ লেঃ কর্নেল অবঃ এম এ হামিদ পি এসসি)।

কর্নেল হামিদ লিখেছেন,
"
রশিদ সাক্ষাৎকারে আমায় বলেছে, সেও জিয়াকে খালেদ আর শাফায়াতের সম্ভাব্য অভ্যুত্থান সম্পর্কে জিয়াকে সতর্ক করে দেয়। কিন্তু তিনি কোন এ্যাকশন নিতে চান নি। এতে তার তখনই জিয়ার সততা সমন্ধে প্রশ্ন জাগে। তার ধারণা হয় জিয়া নিজেই তলে তলে কিছু একটা ঘটাতে যাচ্ছেন। গভীর জলের মৎস জিয়া"। (তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথাঃ লেঃ কর্নেল অবঃ এম এ হামিদ পি এসসি)।

"
আসলে জিয়া সার্বিক ব্যাপারটা দেখছিলেন অন্যভাবে। মেজরদের ব্যারাকে ফিরিয়ে আনলেই তো আর তার সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। তার তো তখন মোশতাক-ওসমানী-খলিল চক্র সবচেয়ে বড় মাথা ব্যথার কারণ। অতএব তিনি তার আপন পরিকল্পনায়ই কাজ করছিলেন গোপনে, অত্যন্ত সন্তর্পণে। তাহের খালেদ শাফায়াতও বসে ছিলনা। সবাই তখন ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন। তারাও নিজ নিজ ছক অনুযায়ী কাজ করছিলো।
এই সময় জিয়ার সাথে আমার প্রায়ই কথাবার্তা হতো। আমি তাকে সেনানিবাসের আকাশে ঝড়ের সংকেত উপলব্ধি করতে বারবার অনুরোধ করি। কিন্তু বারবার তার একটাই জবাব, হামিদ,wait and see. এক মাঘে শীত যায় না। আমি তার এসব কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারি না। তাকে তার অফিসে গিয়ে বারবার বলি। তার একই উত্তর, হামিদ, বললাম তো এক মাঘে শীত যায় না। সে ঘাড় কাৎ করে অবহেলা ভরে কেবল মুচকি হাসে আর চোখ টিপে"। (তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথাঃ লেঃ কর্নেল অবঃ এম এ হামিদ পি এসসি)।

লেঃ হামিদ আরো লিখেছেন,
"
রশিদ আমায় বলেছে, জিয়া এই সময় সরাসরি দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। আমি তাকে কত বুঝালাম,স্যার, আপনি এখনো অনেক ইয়ং, এখন আপনাকে প্রেসিডেন্ট মানাবে না। একটু অপেক্ষা করুন। এখন চীফ আছেন ভালো আছেন। কিন্তু জিয়া অস্থির। অগত্যা আমি তাকে বলি, তাহলে স্যার এটা আমি পারবো না। আপনাকেই আপনার পথ করে নিতে হবে। আমি যতদূর পারি আপনাকে সাহায্য করবো"।

"
অক্টোবরের শেষের দিকে জিয়া এবং খালেদ গ্রুপের মধ্যে একটা মুখোমুখি সংঘর্ষ প্রায় অবশ্যভাম্বী হয়ে উঠলো। সেনাপ্রধান জিয়াকে বার বার বলা সত্ত্বেও তিনি প্রতিপক্ষ গ্রুপের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন না। এতে বঙ্গভবনে মোশতাক, ওসমানী, খলিল, রশিদ, ফারুক সবাই জিয়ার সততা নিয়ে সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়েন। মোশতাক, ওসমানী, খলিল তারা সবাই চাচ্ছিলেন উচ্চাকাঙ্খী জিয়াকে সেনাপ্রধান পদ থেকে সরিয়ে দিতে। কিন্তু রশিদ একমত হচ্ছিল না। জিয়াকে সরিয়ে খালেদ মোশাররফকে চীফ বানানোর পক্ষে সে পক্ষপাতী ছিল না। যদিও ফারুক চাচ্ছিল খালেদকে চীফ বানানো হোক। কিন্তু বঙ্গভবনে তখন ফারুকের চেয়ে রশিদের মতামতের ওজন বেশি। --- এক সময় সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন; জিয়া-খালেদ উভয়কেই সরিয়ে দেয়া উচিত। বঙ্গভবনে তারা এসব নিয়ে যখন আলাপ আলোচনা করছিলেন, তখন --- উত্তর পাড়া থেকে অভ্যুত্থানের দমকা হাওয়া বঙ্গভবনের দ্বারপ্রান্তে এসে আঘাত হানলো"। (তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও না বলা কিছু কথা)।
প্রকৃতপক্ষে, নভেম্বরের ৩ তারিখের অভ্যুত্থানে শাফায়াত জামিল আর খালেদ মোশাররফ দুই মেরু থেকে এক বিন্দুতে মিলিত হয়। শাফায়াত জামিল চাচ্ছিলেন সেনা বাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে এনে উর্ধতন অফিসারদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করা। তার কার্যক্রমও অবশ্য স্বচ্ছ নয়। শাফায়াত জামিল খালেদ মোশাররফের পাশাপাশি "জিয়ার সাথেও সমান সম্পর্ক রাখতো। তার নাখোশের কারণ ছিল রশিদ। ক্যু করার পর তার অধীনস্থ রশিদ 'বস'ক টেক্কা দিয়ে নিজেই বঙ্গভবনের মসনদে বসে পড়লো! চার হাজার সৈন্যের স্বাধীন পদাতিক ব্রিগেড নিয়ে সে ক্যান্টনমেন্টে বসে থাকবে ক্ষমতাহীন হয়ে আর বঙ্গভবনে চুনোপুঁটি মেজররা করবে দেশ শাসন -- এটা অসম্ভব"।( তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও না বলা কিছু কথা)।
অন্যদিকে খালেদ মোশাররফের আপাত লক্ষ্য ছিল প্রধান সেনাপতির পদ। এবং সেটা তিনি লাভও করেন। তার ক্ষমতার লোভ থাকলেও তিনি রক্তপাত চান নি। কিন্তু সে সময় তাকে ভারতপন্থী ও মুজিববাদী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কারণ তার ভাই রাশেদ মোশাররফ আওয়ামী লীগের ছিলেন, তার অভ্যুত্থানের পর খালেদ মোশাররফের মা,ভাই ৪ তারিখে আওয়ামী লীগের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। পরদিন সংবাদপত্রে ভাই ও মায়ের ছবি দেখে খুবই ভেঙ্গে পড়েন। মাকে ফোন দিয়ে বলে্ন, মা, তোমরা আমাকে শেষ করে দিলে। আমি এখন আর বাঁচবো না। উপরোল্লেখিত দুটো ইস্যুকে কেন্দ্র করে জাসদ ও মুসলিম লীগের একটি গ্রুপের পক্ষ থেকে প্রচারণা চালানো হয় যে, খালেদ মোশাররফ মুজিববাদী, তিনি ভারতের চর। আবার বাংলাদেশে ভারতের আগ্রাসন অত্যাসন্ন। এই প্রচারণার ফলে জনসমর্থন সম্পূর্ণ খালেদের বিরুদ্ধে চলে যায়। অথচ খালেদ মোশাররফ মুজিব সমর্থক ছিলেন না অথবা আওয়ামী লীগকে গদিতে বসানোর জন্যও এ অভ্যুত্থান ঘটানো হয় নি। তাই যদি হতো তাহলে তিনি রশিদ ফারুককে বিদেশে পাঠাতে সহযোগিতা করতেন না, অন্যদিকে জেল থেকে চার নেতাকেও মুক্ত করে আনতেন। তিনি এসব কিছুই করেন নি। এটা ছিল ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়া দুই সিনিয়র ক্ষুব্ধ কমান্ডারের ক্ষমতা দখলের একটা লড়াই। কাউন্টার ক্যু করে তারা ক্ষমতায় ফিরে আসার সশস্ত্র প্রচেষ্টা চালান।
এসময় খালেদ মোশাররফ উচ্চাকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। তিনি বিনা রক্তপাতে কৌশল প্রয়োগ করে ক্ষমতাও চাচ্ছিলেন, আবার চীফ অব স্টাফ হতেও চাচ্ছিলেন। অভ্যুত্থানের দায়ভাগ নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় প্রেসিডেন্টের যথাযথ অনুমোদনসহ চীফ অব স্টাফ হওয়ার জন্য মোশতাকের পিছনে সময় ক্ষেপণ করেন। ক্যান্টনমেন্টে যখন বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠেছে তখন তিনি বঙ্গভবনে তার প্রমোশন আর রাজনৈতিক আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন, যা ছিল চরম অদূরদর্শিতার পরিচায়ক। এদিকে বেতারে কোন ধরণের ভাষণ দিয়ে জাতি ও সৈন্যবাহিনীর কাছে তিনি নিজের উদ্দেশ্য পরিষ্কার করেন নি। অন্যদিকে সেনাবাহিনীর মধ্যেও খালেদের অবস্থান ভালো ছিলো না। শাফায়াতের বাহিনীও তার আস্থাভাজন ছিল না। ক্ষমতায় থাকার কয়দিন তিনি জনগণ ও সৈনিকদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। গণ-মিডিয়া বন্ধ থাকায় সর্বত্র সৃষ্টি হয় নানা গুজব ও বিভ্রান্তি, যা খালেদের সম্পুর্ণ বিপক্ষে কাজ করে। এভাবেই একটি অপরিকল্পিত অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তার জীবনাবসান ঘটে।
এ ব্যাপারে কর্নেল হামিদ লিখেছেন, --- " যতদূর জানা গেছে, সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াকে বন্দী করার কাজ অর্থাৎ প্রথম পর্বের অপারেশন ৪৬ ব্রিগেডের কিছু তরুণ অফিসার নিজেদের উদ্যোগেই সম্পন্ন করে। ব্রিগেড হাফিজউদ্দিন এতে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে। আসলে ফারুক-রশিদের সফল অভ্যুত্থান তরুণ মেজরদের এ্যাডভেঞ্চারাস অভিযানে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। জিয়াকে তার বাস ভবনে বন্দী করার পরই খালেদ মোশাররফকে খবর দেয়া হয়। তিনি তখন ঘুমুচ্ছিলেন। ঘুম থেকে উঠে তিনি সরাসরি ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট হেড কোয়ার্টারে ছুটে আসেন। ব্রিগেড শাফায়াত জামিলও একই সময়ে আসেন। তিনি আসার পর অবস্থা পরখ করে অপারেশনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। শুরু হয় অভ্যুত্থানের দ্বিতীয় পর্ব"। (তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও না বলা কিছু কথা)।
কর্নেল হামিদ আরো লিখেছেন,
"
অফিসে পৌঁছেই ফোন করলাম কর্নেল শাফায়াতকে। জিজ্ঞাসা করলাম,
ঃ তোমরা কী জিয়াকে আরেস্ট করেছো ?
ঃ না, ঠিক তা নয়। তাকে আমরা বাসায় হেফাজতে রেখেছি। হি ইজ অলরাইট"। ((তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও না বলা কিছু কথা)।
কিন্তু এ ব্যাপারে ফা্রুক-রশিদের দৃঢ় অভিমত," ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের নেপথ্য নায়ক হল জিয়াউর রহমান,খালেদ মোশাররফ নয়। অর্থাৎ জিয়া-শাফায়াতের গোপন সমঝোতায়ই ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। জিয়াকে তার বাসায় নিজের ট্রুপসের তত্ত্বাবধানে 'নিরাপদে' রাখা হয়। প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা দখলের ওই দিনগুলোতে বিভিন্ন গ্রুপ বিভিন্ন মতলবে ভয়ংকর খেলায় মত্ত ছিল,যা উদঘাটন করা বেশ কঠিন কাজ। পরবর্তীতে ঐ অভ্যুত্থানের বিদ্রোহীদের বিশেষ করে শাফায়াত জামিল ও হাফিজউদ্দিনের প্রতি জিয়ার সদয় ব্যবহার এই ধারণাকে বদ্ধমূল করে।
"
খালেদের অপারেশনের গোপনীয়তা বলে কিছুই ছিল না। ফলে তা সবাই জেনে যায়। এতে জিয়ার পক্ষে আগাম কাউন্টার এ্যাকশন পরিকল্পনা করা সহজ হয়। তিনি আগে থেকেই কর্নেল তাহেরের সাথে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করে গোপন সমঝোতায় আসেন। তাহেরও উচ্চাকাঙ্ক্ষী অফিসার ছিলেন। তিনি তার লালিত বিপ্লব ১২ দফার ভিত্তিতে জিয়াউর রহমানকে সাথে নিয়ে বাস্তুবায়নের স্বপ্ন দেখেন।" (তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও না বলা কিছু কথা)।

৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান এবং জিয়ার বন্দীত্ব নিয়ে পরবর্তী সময়ে কর্নেল ফারুক রশিদের ১৫ আগস্ট,১৯৮৩ এবং ৭ নভেম্বর ১৯৮৩ তে দেয়া নিন্মোক্ত সাক্ষাৎকারটি স্যাটারডে পোস্টে প্রকাশিত হয়।

"
প্রশ্নঃ ৩ নভেম্বরের বিদ্রোহ সংঘটনের পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণগুলো খোলামেলাভাবে বলবেন কি? সেই সময়কার চীফ অব স্টাফ হিসেবে জেনারেল জিয়ার ভূমিকা ও দায়িত্ব কী ছিল ?

জবাবঃ জেনারেল জিয়া চাননি যে বিপ্লবের পর পরই বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা বা পার্লামেন্ট সদস্যদের মধ্য থেকে কাউকে প্রেসিডেন্ট পদে নিয়োগ করতে। তিনি এটাও চাননি যে, দেশে তাড়াতাড়ি একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চালু করে তার সাথে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সম্পৃক্ত করতে। অতৃপ্ত বাসনা,উচ্চাভিলাষ এবং লোভ জেনারেল জিয়াকে এমনভাবে পেয়ে বসেছিল যে, তিনি চাইতেন যে কোন মূল্যে প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত হওয়া। যার জন্যে তিনি ৩ নভেম্বরের বিদ্রোহের জন্য কেবল দায়ীই নন, বরং সে বিদ্রোহের তিনিই ছিলেন প্রধান পৃষ্টপোষোক। এরজন্য তিনি জাসদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন।

প্রশ্নঃ আপনারা প্রেসিডেন্ট জিয়াকে সর্বদাই একজন ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তি ও ৩ নভেম্বরের বিদ্রোহের পৃষ্টপোষক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু দেশের প্রায় সর্বমহল এই মর্মে অবহিত যে, ৩ নভেম্বরের বিদ্রোহীরা তাকে আটক করে রাখে এবং ৭ নভেম্বরের সিপাহী জনতা তাকে বিপ্লবের মাধ্যমে মুক্ত করে আনে। এতদসংক্রান্ত কোন তথ্যগুলো সঠিক?

জবাবঃ প্রথম কথা হচ্ছে জিয়া তার সৃষ্ট স্টাইলে নিজের বাসভবনে আটক ছিলেন। দ্বিতীয়ত, তিনি তার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ও পদাতিক বাহিনীর একটি কোম্পানীর প্রহরাধীন ছিলেন। সেখানে তার ব্যক্তিগত স্টাফ অফিসাররাও ছিলেন। বিদ্রোহ দমনের জন্য তিনি কোন উদ্যোগই নেন নি। উপরন্তু প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক প্রেসিডেন্ট কর্তৃক এ ব্যাপারে তাকে বিদ্রোহ দমন করতে সুস্পষ্ট নির্দেশ প্রদান করা সত্ত্বেও তিনি বিদ্রোহ দমন করতে অস্বীকার করেন। তার বাসভবনে টেলিফোন বরাবরই সচল ছিল। তার স্ত্রী আমাদের এই মর্মে নিশ্চিত করেছেন যে, তিনি গ্রেফতার বা আটকাবস্থায় নেই। টেলিফোনে তার সাথে কথা বলতে চাইলে তার স্ত্রী জানান, তিনি কতিপয় সামরিক অফিসারের সাথে আলাপ করছেন। এরপর বঙ্গভবন থেকে তাকে যতবারই ফোন করা হয়েছে ততবারই তিনি ফোনে কথা বলতে অস্বীকার করেন। চীফ অব আর্মি স্টাফ এর পদবী অপব্যবহার করে জিয়া সর্বদাই মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জনগণ ও সৈনিকদের ধোঁকা দিয়েছেন।
কর্নেল আবু তাহের। সত্যিকার অর্থেই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বাংলাদেশকে ভালবেসেই সুদূর পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং সফলতার সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় ১১ নম্বর সেক্টর গঠিত হয় প্রধানত ময়মনসিংহ নিয়ে। এই সেক্টরে তিনি প্রধান ছিলেন। তার জন্যই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১১ নম্বর সেক্টর একটা গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চল কামালপুরে পাক বাহিনীর বিশাল ঘাঁটি ছিল। এখানে মেজর জিয়া হামলা চালাতে এসে ৬৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বলিদান করলেও কর্নেল তাহের যতবারই কামালপুরে অভিযান চালিয়েছেন,ততবারই সফলতা অর্জন করেছেন। এখানেই তিনি নিজের এক পা হারান। কামালপুর ছাড়াও তাহের কোদালকাঠি, চিলমারীতে অভিযান চালান। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে তিনি চিলমারীর উপর যে হামলা করেন, তাতে প্রায় একশ পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছিল। এই হামলাটি তিনি নিজেই পরিচালনা করেছিলেন। কর্নেল তাহের শুধু মুক্তিযুদ্ধই পরিচালনা করেন নি, মুক্তিযুদ্ধে রিক্রুট করা অনেক তরুনকেও ট্রেনিং দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে তার এক ভাইও ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে এ রকম আর একজন নিবেদিত দেশপ্রেমিক যোদ্ধা ছিলেন খালেদ মোশাররফ। তিনি ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছাড়াও "কে' ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন। ঢাকা থেকে যে ছাত্ররা পালিয়ে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্যে, তারা অনেকেই ছিলেন খালেদের কাছে ট্রেনিং প্রাপ্ত। এদের মধ্যে বদি,স্বপন,জুয়েল রুমী প্রমুখ বিখ্যাত বিচ্ছুর নাম উল্লেখযোগ্য।
যেহেতু তাহের দেশমাতৃকার টানে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছিলেন,যেহেতু তিনি জীবনের সব টুকু উদ্যম দিয়ে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন, সেহেতু স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশকে নিয়ে তার স্বপ্নটা একটু বেশিই উগ্র ছিল।
তাহেরের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিকদের কল্যাণ। কিন্তু তার মূল লক্ষ্য ছিল ক্ষমতা দখল। কারণ, তিনি হয়ত ভেবেছেন ক্ষমতা কুক্ষিগত না করতে পারলে তার স্বপ্ন সফল হবে না। তাই তিনি সেনাবাহিনীতে চাকরিরত থেকেও, রাষ্ট্র ও সরকারের দেয়া সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করেও, রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতি অনুগত থাকার শপথ নেয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রবিরোধী, সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। তিনি জাসদের সিরাজুল আলম খান, আ স ম আবদুর রব, মেজর জলিল, সর্বহারা পার্টির কর্নেল জিয়াউদ্দিন, চীনপন্থী মহম্মদ তোয়াহার সাথে জোট বাঁধেন। সৈনিক জীবন থেকে অবসর নেয়ার পর কর্নেল তাহের দেশে আসন্ন খাদ্য সংকটের মুখে ১৯৭৪ সনের জুলাই মাসে জাসদে বিপ্লবী গণ বাহিনী এবং সেনাবাহিনীর সাধারণ সেনা ও ননকমিশনড ছোট অফিসারদের নিয়ে বিপ্লবী সেনা সংস্থা গঠন করেন। এর পাশাপাশি সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমানের সাথেও ঘনিষ্ট যোগাযোগ রাখেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর-ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল সেক্টরে কর্নেল তাহের জিয়ার অধীনে ময়মনসিংহ এলাকার সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। সেই থেকেই তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিবিড়।
এখন কথা হচ্ছে, তিনি যাদের সাথে জোট বেঁধেছিলেন তারা কারা ? এবং তখন সময়টা কেমন ছিল ?
১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর আবদুর রবের নেতৃত্বে জাসদ গঠিত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে ৩১ অক্টোবরের দূরত্ব কতটুকু? কেনো তাদের বিভাজিত হতে হলো!
মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির দরুণ পৃথিবীর সব মুক্তিপ্রাপ্ত দেশকে স্বাধীনতার গোড়াতে ভুগতে হয়। বাংলাদেশেও তাই হচ্ছিল। পাক হানাদার কর্তৃক এবং তাদেরকে প্রতিরোধ করতে যেয়ে মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক রাস্তা-ঘাট-সেতু ধবংসের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অচল, রেল লাইন অকেজো। এমন কি লঞ্চ জাহাজ ডুবিয়ে জলপথকেও বন্ধ করে রাখা হয়েছে, অর্থনীতি বিধ্বস্ত, পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশ একটি প্রাদেশিক অঞ্চল ছিল বলে এখানে কোন শিল্প কারখানা তো দূরের কথা, কোন কেন্দ্রীয় অফিস পর্যন্ত ছিল না। এর উপর বিশাল উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী; যারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল তারাই শুধু উদ্বাস্তু নয়, দেশের ভিতরে থেকেও হাজার হাজার মানুষ পাকিদের নির্যাতনের ভয়ে নিজ এলাকা ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়েছিল -- এ অবস্থায় দেশের জনগণকে তো চূড়ান্ত অসুবিধার মোকাবেলা করতেই হবে। রুশ বিপ্লবের পর প্রায় ১৫/২০ বছর সে দেশের মানুষকে কঠিন দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সে সময় খাদ্যের অভাবে বহুলোকের প্রাণও গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চীন, ভিয়েতনাম ও পূর্ব ইউরোপের কম্যুনিস্ট দেশগুলোকে একই অবস্থার শিকার হতে হয়। একই ধরণের অসুবিধা ভোগ করে বিপ্লবোত্তর আলজেরিয়া, কিউবা প্রভৃতি দেশ। ফরাসি বিপ্লব হয়েছিল সাম্য, মৈত্রী, ভাতৃত্বের আদর্শে। তারপরও সে বিপ্লবের পর কয়েক বছর ধরে সেখানে চলছিল সন্ত্রাসের রাজত্ব। আর বাংলাদেশের মানুষ মনে করেছিল স্বাধীনতা হল এমন একটি যাদুমন্ত্র যার ছোঁয়ায় নিমেষে মরুভূমিতেও বুঝি দুধের নহর বয়ে যায়!
১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে আমার কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক বক্তব্য রাখতে যেয়ে একটু করুণ হাসি দিয়ে বললেন, "আমি তখন একাদশ শ্রেণীর ছাত্র। আমরা জানতাম দেশ স্বাধীন হলে আর আমাদের কাগজ, কলম বই কিনতে হবে না। এই আনন্দেই আমরা দেশের স্বাধীনতা চেয়েছি"।
আমার মনে আছে, আমাদের ভান ভানুনী (সে সময় 'রাইস মিল' ছিল না) দুইদিন যাবৎ ঢেঁকিতে ধান ভানতে আসছিল না। মা আমাকে বললেন তাকে ডেকে আনতে। আমি যেয়ে তাকে বলাতেই তেড়ে উঠে বলল, এখন দেশ স্বাধীন হয়েছে, এরপরও ধান ভেনে খাবো ? ডিসেম্বর মাসে দেশ শত্রুমুক্ত হয়। সে সময়টা ছিল ধান কাটার মরসুম। অনেক কামলাই সে সময় ফসল কাটতে আসে নি। একটাই কারণ, দেশ স্বাধীন হয়েছে আর তাদের কাজ করতে হবে না। শুধু তাই নয় তারা আশা করে থাকত, এই তো কিছুদিনের মধ্যেই ধনী জমি ওয়ালাদের কাছ থেকে জমি নিয়ে তাদের বিলিয়ে দেয়া হবে। এটাই ছিল সে সময়ের বাস্তবতা।
সে সময়ে এহেন অধিকাংশ মাগনা খাওয়া আর মাগনা পাওয়ার জনগণ ও তরুণদের প্রত্যাশাকে পুঁজি করেই ক্ষমতালোভী জাসদ মুক্তিযোদ্ধার লেবেল গায়ে এঁটে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে দেশব্যাপী সন্ত্রাসী তান্ডব শুরু করে। আর " স্বাধীনতা বৈরী পুঁজিপতি, শোষক শ্রেণী এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহ স্ব স্ব স্বার্থে জাসদকে অর্থ, সম্পদ, সাহায্য ও সহযোগিতা দিতে থাকে। মুজিব বাহিনী, মুক্তিযোদ্ধা, ও তরুণ সমাজের একটি বিরাট অংশ জাসদের কাতারে এসে সামিল হয়"। (ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস)
পরবর্তীতে জানা যায়, জাসদের নেতৃবৃন্দের কেউ কেউ সি আই এর এজেন্ট এবং ভারতের চর ছিল। ১৯৮১ সালের ২১ মে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে সাবেক নায়েক সুবেদার জালালউদ্দিন ( সহ সভাপতি- বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা (সাবেক গণবাহিনী), দপ্তর সম্পাদক- মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম পরিষদ, সদস্য জেলা জাসদ কমিটি,বগুড়া) এক লিখিত বক্তব্যে বলেন,
"
১৯৭১ সালে আমরাও জীবনকে বাজী রেখে লড়াই করেছিলাম। বিজয়ের পর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের হাতে ছেড়ে দিয়ে ব্যারাকে ফিরে গিয়েছিলাম।
আর ঠিক এমনি সময়ে ঝড়ের মত আবির্ভূত হলো জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ। এই দলের নামের সাথে হিটলারের ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টির নামের হুবহু মিল। জাসদের রাজনৈতিক নেতারা ভারতের সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা উবানের সৃষ্টি। আমাদের নজরে এল এদের তারুণ্য সমাজতন্ত্রের বক্তব্য আর ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দুঃসাহস। স্বভাবতই এদের সাথে ক্রমশ আমরা জড়িয়ে গেলাম। জাসদ কর্মীরা ৭৪ সালে ১৭ মার্চ তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৪৭টি থানা ঘেরাও করে অস্ত্র লুট করে। সিরাজুল আলম খান বলেন যে, আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক পর্যায় থেকে বিপ্লবে নিয়ে যেতে হবে। তারই নির্দেশে জাসদের কিছু সংখ্যক কর্মী হাত বোমা ফাটিয়ে, পুলিশের উপর বেপরোয়া গুলি চালিয়ে পুলিশকে গুলি বর্ষণে বাধ্য করে। ফলে দেশব্যাপী জাসদ কর্মীদের উপর নেমে আসে নির্যাতন। এই পরিস্থিতিতেই ৭৪ সালে গঠন করা হয় বিপ্লবী গণবাহিনী আর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। বীরোত্তম কর্নেল তাহের হলেন সৈনিক সংস্থার প্রধান। জাসদের পক্ষ থেকে যোগাযোগের দায়িত্বে থাকলেন হাসানুল হক ইনু।
৭৫ সালে বাকশাল গঠিত হলে অন্য সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। এমবস্থায় হীনবল ও উপায়ান্তরহীন জাসদ বাকশালে যোগদানের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পেশ করে। শেখ মুজিব তা অগ্রাহ্য করলে জাসদ নেতৃত্ব সেনাবাহিনীর কিছু বিক্ষুব্ধ তরুণ অফিসারের সাথে সংযোগ স্থাপন করে। গুলশানের এক বাড়িতে বসে রচিত হয় এক নীল নক্সা। সেই বৈঠকেই জাসদের পক্ষ থেকে মুজিবকে সপরিবারে হত্যার প্রস্তাব করা হয়। যুক্তি হিসেবে বলা হয়, সপরিবারে মুজিবকে হত্যা করলেই বাকশালের প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পূর্ণ ধ্বংস হবে, নইলে অভ্যুত্থানের ফলাফলকে ধরে রাখা মুস্কিল হয়ে পড়বে।
এই নীল নক্সা মোতাবেকই শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হন। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে কুরিয়ারদের পাঠিয়ে দেয়া হয়। নির্দেশ দেয়া হয়, এই অভ্যুত্থান জাসদের স্বপক্ষের অভ্যুত্থান এবং এখনকার বিপ্লবী দায়িত্ব হলো বিভিন্ন ফাঁড়ি, ট্রেজারি লুট করে অস্ত্র আর গোলা বারুদ সংগ্রহ করা। এই নির্দেশ অনুযায়ী মোহম্মদপুর ফাঁড়ি ও নারায়ণগঞ্জের একটি ফাঁড়ি প্রকাশ্যে লুট করে অস্ত্র তোলা হয় পিটার কাস্টারসের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায়। এখানেই কাস্টার্স অস্ত্রসহ ধরা পড়েন। ভারত থেকে ২৪ ঘন্টার নোটিশে বহিষ্কৃত পিটার কাস্টার্সের সাথে জাসদের কী সম্পর্ক ছিল তা জাসদ নেতারা কখনোই পরিষ্কার করে বলে নি। তবে জেলখানায় কাস্টার্স প্রকাশ্যেই বলে বেড়াতো যে,সে জাসদকে ৪০ লক্ষ টাকা দিয়েছে। জাসদের কেউই এ কথার প্রতিবাদ করতো না।
----
১২ নভেম্বর জাসদ সিপাহী বিপ্লবের সরকারকে উৎখাত করার বক্তব্য দেয়। ক্যান্টনমেন্টে বিলি করা হয় প্রচারপত্র। ২২ নভেম্বর জলিল,রব,ইনু গ্রেফতার হন। ২৪ নভেম্বর তাহেরকে গ্রেফতার করা হয়। পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ায় কর্মীদের কাছে মুখ রক্ষার জন্য এবং জনগণের মধ্যে জাসদ ভারতের দালাল বলে যে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল তার কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে ২৬ নভেম্বর ভারতীয় হাই কমিশনের উপর ব্যর্থ হামলা চালানো হয়।
৭৬ সালের ২১ জুলাই তাহেরের ফাঁসি হয়। বস্তুত স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনানী কর্নেল তাহের জাসদ নেতৃত্বের দ্বারা সম্পুর্ণরূপে ব্যবহৃত হয়েছিলেন। তাহেরের অনুসারীদের সান্ত্বনা দেয়ার জন্য জাসদ ৩০ জুলাই দেশব্যাপী হরতাল আহবান করে।
আর ভারতের সাথে এক গোপন রহস্যময় যোগাযোগ সর্বদাই রক্ষা করে এসেছেন জাসদের রহস্যপ্রিয় নেতা সিরাজুল আলম খান। তিনি দুএক মাস অন্তর অন্তরই অকস্মাৎ দিল্লিতে চলে যেতেন।
উচ্চাভিলাষী অথচ অস্থির চিত্ত নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত জাসদ কোন কর্মসূচীতেই লেগে থাকতো না বরং সর্বদাই চক্রান্তের পথ খুঁজে বেড়াতো। তাদের নৈরাজ্যবাদী উচ্চাভিলাষের জন্য শত শত কর্মীকে প্রাণ দিতে হয়েছে। কিন্তু জাসদ নেতৃত্ব এদের প্রতি কোন দায় দায়িত্ব কোনদিন স্বীকার করে নি।
কথা ও কাজের মধ্যেও জাসদ নেতৃত্বের কোন দিন কোন মিল ছিল না। তারা মুখে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলতো, কিন্তু কার্যত নেতারা বিলাসবহুলতার মধ্যে দিয়ে জীবনকে উপভোগ করতেন। সাধারণ কর্মীরা যে না খেয়ে থাকতো, তাদের যে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দুর্দশা, সেদিকে নজর দেয়ার ফুরসত মিলতো না জাসদ নেতাদের।

স্বাধীনতার পরপরই গণতান্ত্রিক অধিকারের সুযোগ নিয়ে জাসদ প্রকাশ্যে অনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালাতে থাকে। সমগ্র দেশে শুরু হয়ে যায় খুন ডাকাতি রাহাজানি হাইজাকিং। "১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু দেশের আইন-শৃঙ্খলার অবনতিকর পরিস্থিতি উল্লেখ করে বলেন, " তিন হাজার আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে চারজন জাতীয় সংসদ সদস্যকে"। (বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডঃ ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস --- অধ্যাপক আবু সাইয়িদ)।
অন্যদিকে "পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি, পুর্ববাংলা সাম্যবাদী দল, পূর্ববাংলা কমুনিস্ট পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান কমুনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যে ও গোপনে গেরিলা কায়দায় স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি তথা আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের খুন করে,শস্য লুট, ব্যাংক লুট, থানা লুট করে আইন-শৃংখলা ও জন জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
স্বাধীনতার পর পরই অতি উগ্র চীনপন্থী দলগুলো কখনো 'স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ' কখনো 'সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব' কখনো 'মুসলিম বাংলা'র শ্লোগান দিয়ে চীন-পাকিস্তান প্রদত্ত অস্ত্র দিয়ে বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাতের জন্য মরীয়া হয়ে উঠেতোয়াহা ও তার সহযোগী আব্দুল হক চীনের নীতি সমর্থক হিসেবে পাকিস্তানের অখন্ডতা বজায় রাখা তাদের পবিত্র কর্তব্য বলে ঘোষণা করে।
১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭৩ সালের জুন পর্যন্ত এক সরকারি হিসেবে দেখা গেছে ঐ সময়কালে ২০৩৫টি গুপ্ত হত্যা, ৩৩৭টি কিডন্যাপিং,১৯০টি ধর্ষণ, ৪৯০৭টি ব্যাংক ডাকাতি সংঘটিত হয়। ৪০২৫ ব্যক্তি ঐ সমস্ত উগ্রপন্থী দুস্কৃতিকারীর হাতে প্রাণ হারায়"। (বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডঃ ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস --- অধ্যাপক আবু সাইয়িদ)।
চাকরি বিধি অনুযায়ী রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ অনুগত থাকবেন, তারা এমন কিছু করবেন না, যা রাষ্ট্র ও সরকার বিপাকে পড়ে বা সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন বা গোপনীয়তা নষ্ট হয়। এর জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডও হতে পারে। এ সব নিয়ম-কানুন জেনে ও মেনেই কর্মকর্তা/কর্মচারীগণ রাষ্ট্র ও সরকার থেকে যাবতীয় সুবিধা ও বেতন ভাতাদি গ্রহণ করেন।
এ ছাড়া যে কোন দেশের প্রশাসন এবং প্রতিরক্ষা বাহিনী বড়ই স্পর্শকাতর বিষয়। এই দুই জায়গায় যদি দেশের স্বার্থবিরোধী শক্তি ওৎ পেতে থাকে তাহলে দেশ বা সরকারের বারোটা বাজতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে লেঃ কর্নেল আবু তাহের ও কর্নেল জিয়াউদ্দিন ( জাসদের মেজর জিয়াউদ্দিন নয়) সেনাবাহিনীতে কিছু শৃঙ্খলা বিরোধী কাজে লিপ্ত থাকে। এই দুইজনই এম এ মঞ্জুরের সাথে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি বলেই এরা জাত রোমান্টিক। হয়ত বয়সের তারুণ্য আর পালিয়ে আসার রোমান্স থেকেই তারা পরবর্তী সময়ে রোমান্টিক ভাবাবেগে তাড়িত হয়ে পড়ে। তাই, দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান করেও এরা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নামে দেশ ও জাতিকে চরম হঠকারিতা উপহার দেয়।
কর্নেল জিয়াউদ্দিন একটি বিতর্কিত নিবন্ধ প্রয়োজনীয় অনুমোদন ছাড়াই ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডে তে প্রকাশ করেন। তখন তিনি ঢাকাস্থ ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার। উক্ত নিবন্ধে তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বঙ্গবন্ধু এবং তার সরকারের সমালোচনা করেন। জিয়াউদ্দিনের নিবন্ধকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মহলে হৈচৈ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু তখন বিদেশে। দেশে ফিরে তিনি জিয়াউদ্দিনকে ডেকে বুঝানোর চেষ্টা করেন এই বলে যে, তার এ কাজটি সেনাবাহিনীর শৃংখলাভঙ্গের পর্যায়ে পড়ে। তবে জিয়াউদ্দিন যদি লিখিতভাবে দুঃখ প্রকাশ করে তাহলে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হবে। জিয়াউদ্দিন লিখিতভাবে দুঃখপ্রকাশ করতে অস্বীকার করলে বিধি মোতাবেক তিনি চাকরিচ্যুত হন। সেনাবাহিনীতে এটাই ছিল সর্বনিম্ন এবং ন্যুনতম শাস্তি। পরবর্তীকালে এই জিয়াউদ্দিন সিরাজ সিকদারের গুপ্ত সংগঠন পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টিতে যোগ দেয় এবং সুন্দরবন এলাকাকে দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন করে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করে।
মুক্তিযুদ্ধের আগে সিরাজ সিকদার লন্ডনে যান। সেখান থেকে ফিরে এসেই তিনি হয়ে উঠেন মার্কসবাদী চৈনিক কমুনিষ্ট হিসেবে দুরন্ত বিপ্লবী। কিন্তু এত দ্রুত তিনি কী করে শক্তিশালী হয়ে উঠলেন -- তা সত্যিই ছিল রহস্যজনক। অনেকে মনে করেন, এই দলের কোন কোন নেতার সাথে মার্কিন সি আই এ এর ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে রুখতে না পেরে চীনা প্রধানমন্ত্রী সখেদে বললেন, ঢাকার পতন ভারতের বিজয়ের পথে অগ্রগতির স্বাক্ষর নয়, বরং এশীয় উপমহাদেশে এক অন্তহীন যুদ্ধের সূচনামাত্র।
১৯৭১ সালে ১৭ ডিসেম্বর চৌ এন লাই পিকিং এ বলেন,ভারতীয়রাই পাকিস্তানের ঘাড়ে তথাকথিত বাংলাদেশের ক্রীড়ণক সরকারকে চাপিয়ে দিয়েছে।
ঠিক এ সময়েই অর্থাৎ ১৯ ডিসেম্বর পাকিস্তান থেকে ভুট্টো বললেন, এই অবস্থা চিরস্থায়ী নয়-- পুর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য ও অবিভাজ্য অঙ্গ।
এই ঘোষণার সাথে সাথেই সিরাজ সিকদারের পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি "স্বাধীনতার নামে বাংলাদেশ ভারতের পদানত হয়েছে " বলে উল্লেখ করে এবং স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পুর্ববাংলা কায়েমের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের আহবান জানায়। এ সময় হক, তোহা, আলাউদ্দিন, দেবেন শিকদা্র, শান্তি সে্‌ন, অমল সেন প্রমুখের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী চৈনিক দল; যাদের অনেকেই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দলের নামে পুর্ব পাকিস্তান কথাটা লাগিয়ে রেখেছিল তারা -- চীনা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে হিংসাত্মক ও সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির পথ বেছে নেয়।
এভাবে সদ্য স্বাধীন দেশে আইন শৃংখলার সংকট তৈরির জন্য সর্বহারা দল সশস্ত্র সন্ত্রাসের পথ গ্রহণ করে। জনমনে চরম আতংকের সৃষ্টি হয়। এদের দৌরাত্ম্যে পল্লী অঞ্চলের কোন কোন রাজনৈতিক দলের নেতারা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার স্বার্থে সর্বহারা দলের সাথে গোপনে বোঝাপড়া করে নেন। মফঃস্বলের অনেক পুলিশ অফিসারও নাকি এই দলের সাথে সংযোগ রক্ষা করে চলতেন।ফলে সর্ষের মধ্যেই ভুত থাকাতে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এই ভুত তাড়ানো দুরূহ হয়ে পড়ে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মেজর জলিল ছিলেন খুলনা জেলার নয় নম্বর সেক্টরের কমান্ডিং অফিসার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার তাকে গ্রেফতার করেন। তার কাছে কিছু কাগজপত্র পাওয়া যায়,তাতে যা লিখা ছিল সেগুলো মার্কিব গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এর নির্দেশ ।কিন্ত তার অনুরাগীরা এ সব অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেন, মেজর জলিলকে গ্রেফতার করা হয় ভারতের নির্দেশে।
পরেশ সাহার গ্রন্থ (বাংলাদেশঃ ষড়যন্ত্রের ইতিহাস থেকে) থেকে জানা যায়,
যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মেজর জলিল ১৯জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে এ্যাকশনে গিয়েছিলেন। এদের মধ্যে সবাই ধরা পড়েছে। তিনিই শুধু নিরাপদে ফিরে এসেছেন আশ্রয়ে।
মেজর জলিল গ্রেফতার হওয়ার পর দক্ষিণ বঙ্গে তার অনুসারীরা সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে। খুলনার এককালের মুসলিম লীগের ক্যাডাররাও রাতারাতি জার্সি বদল করে তাদের সঙ্গে যোগ দেন। ফলে খুলনা জেলার কোন কোন অঞ্চলে অরাজকতার সৃষ্টি হয়। মেজর জলিল একবছর আটক থাকার পর ছাড়া পান। ছাড়া পেয়ে তিনি জাসদে যোগ দেন এবং এক সময় তিনি দলের প্রেসিডেন্টের পদও লাভ করেন। তিনি পরিচয় দিতেন নিজেকে মার্কসবাদী হিসেবে। কিন্তু জীবনের শেষ দিকে এই মার্কসবাদী কট্টর মৌলবাদীর কোলে আশ্রয় নেন।
চীন-আমেরিকা পাকিস্তানের স্বার্থে এদেশের স্বাধীনতা চায় নি, সেজন্য স্বাধীন বাংলাদেশকে তারা মানতে পারে নি। মাও সেতুং এর তত্ত্ব ছিল "একটি মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে, তেমনি কোন জাতিকে ধবংস করতে হলে মাথা থেকেই শুরু করতে হবে"। এই তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে পাকিরা। এই মাওবাদী বাঙালি নেতারা স্বাধীন দেশে একই কায়দায় সন্ত্রাস শুরু করে। মননে মগজে এরা পাকিদেরই দোসর। কর্নেল তাহের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়ে পাকিদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে তার বিপরীত আদর্শের এসব স্বাধীনতা বিরোধী দল, প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তি, বিতর্কিত লোকদের সাথে মার্কসবাদের নামে গাঁট ছড়া বাঁধেন। থ্রিলার ফিকশনের মাদকতায় অতি বিপ্লবীরা এসব কর্মকান্ডে এক ধরণের অতি রোমান্টিক আস্বাদ গ্রহণ করে। কিন্তু তারা জানে না যে, বৈষ্ণব পদাবলী মুখস্ত করে যেমন প্রেমিক হওয়া যায় না, তেমনি সমাজ বাস্তবতা বোধরহিত অজ্ঞানতা দিয়ে শুধু ধার করা তত্ত্ব আর মধ্যযুগীয় রোমান্স দিয়ে বিপ্লবী হওয়া যায় না।
এক দেশের সমাজবাস্তবতার আলোকে দাঁড়ানো আদর্শ দিয়ে আর এক দেশের সমাজ বিপ্লব ঘটানো যায় না। কারণ সমাজবিভক্তি শুধু অর্থনীতির উপর নির্ভর করে না। অর্থনীতি যদি সমাজের উপরতলার একমাত্র নিয়ন্ত্রক হতো তাহলে আজকের সমাজের অনেক বিরোধের, অনেক জটিলতার সমাধান সহজেই হয়ে যেতো। তা হয় নি। কারণ,সমাজগড়ন, সমাজমানস এবং মানুষ কোনটাই পাটিগণিতের মত সহজ নয়। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক, মানুষের সাথে দেবতার সম্পর্ক, মানুষের সাথে সমাজের সম্পর্ক, সমাজের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক, রাজনীতির সম্পর্ক, সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিল্পকলার সম্পর্ক কোনটাই ইউনিলিনিয়ার নয়। সরল রেখার মত সম্পর্ক নয়, দুয়ে দুয়ে চার নয়। দুয়ে দুয়ে সাড়ে চার বা পাঁচ বলেই সর্বত্র এত প্রকারের অসামঞ্জস্য এত ঘটনার বৈচিত্র্য। গ্রন্থের সমাজ জীবন আর প্রকৃত সামাজিক জীবনের ফারাক অনেক। সে জন্য শুধুমাত্র অর্থতত্ত্ব প্রয়োগ করে সামাজিক আলোড়ন সৃষ্টি করা গেলেও প্রকৃত জীবন সত্য, সামাজিক ব্যবহার, ক্রিয়াকর্ম -- পরিবর্তনের কোন ঢেউএর আঘাতে বিচলিত হয় না।
চীনের সমাজগড়ন বৃত্তিগত, বাংলাদেশে মানসিক হীনম্মন্যগত। এখানেই দুস্তর ফারাক। এছাড়া চীনের সামাজিক স্তরবিন্যাসে এক নম্বরে আছে এলিটগোষ্ঠী,দুই নম্বরে কৃষিজীবী, তিন নম্বরে শাসকগোষ্ঠী, চার নম্বরে ব্যবসায়ী। আর বাংলাদেশে এক নম্বরে এলিটগোষ্ঠী, দুই নম্বরে শাসকগোষ্ঠী, তিন নম্বরে ব্যবসায়ী, সর্বনিম্নে কৃষিজীবী ও অন্যান্য বৃত্তিজীবী। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের উন্নয়ন ঘটাতে চাইলে কৃষককে বাদ দিয়ে কখনোই তা সম্ভব নয়। অথচ বাংলাদেশে কৃষকদের মাড়িয়ে শ্রমিক বা অন্যান্য বৃত্তিকেন্দ্রিক শ্রেণীকে পুঁজি করে শ্রেণীচেতনা লালনকারী নেতারা বিশেষ দলবিদ্বেষী, বিশেষ ব্যক্তিবিদ্বেষী আন্দোলনের নামে সমাজ বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেন।
কর্নেল তাহের বিপ্লবী হওয়া সত্ত্বেও যেখানে নিজেই অন্যের দ্বারা ব্যবহৃত হয়ে বেঘোরে প্রাণ দান করেন, সেখানে তিনি বিপ্লব রক্ষা করবেন কী ভাবে ?
জিয়া শাফায়াত জামিলের সৈন্য দ্বারা নিজ গৃহে বন্দী হন নভেম্বরের দুই তারিখেখালেদ মোশাররফ পরবর্তীতে এই অভ্যুত্থানের দায়ভাগ গ্রহণ করেন। অনেক বইতে বলা হয়েছে অফিসার পর্যায়ের কিছু সংখ্যক অতি উৎসাহী সেনা এই কর্ম করেন। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে ৮১ সালের চট্টগ্রামের ঘটনা। মঞ্জুরও চট্টগ্রামের জিয়া হত্যার পর অভ্যুত্থানের দায়ভাগ গ্রহণ করেন সৈন্যদের মধ্যে শৃংখলা আর পরবর্তীতে অহেতুক রক্তপাত বন্ধ করতে। কিন্তু তিনি দুর্ভাগ্যের শিকার হয়ে বন্দী হন এবং সেনাদের গুলিতে মারা যান। মঞ্জুর অনুরোধ করেছিলেন তাকে এরশাদের কাছে নিয়ে যেতে। খালেদও মঞ্জুরের মত ঘটমান ঘটনাকে সামাল দিতে এগিয়ে আসেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি ধৃত ও বন্দী হন। তিনিও বলেছিলেন তাকে জিয়ার কাছে নিয়ে যেতে। তাকেও মঞ্জুরের কায়দায় মেরে ফেলা হয়।
অথচ জিয়াউর রহমান ৭৫ এর ১৫ আগস্টের ঘটনার পর প্রধান সেনাপতির পদ দখল করলেন ঠিকই কিন্তু চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা করার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করলেন না। শাফায়াত জামিল তাকে অনুরোধ করলে তাকে গৃহযুদ্ধের ভয় দেখিয়ে থামিয়ে দেন। তার এই নিস্পৃহতার কারণে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষ তাকে নির্দেশ দিলেও তিনি তা পালন করেননি। এ ব্যাপারে তৎকালীন সময়ের সেনানিবাসের স্টেশন কমান্ডার কর্নেল এম এ হামিদ লিখেছেন, হত্যাকারী মেজরদের উৎখাত আর চেইন অব কমান্ড এর দাবী নিয়ে এবার এক প্লাটফর্মে এসে দাঁড়ালেন শাফায়াত-খালেদ, তারা প্রকাশ্যে হুমকি দামকি শুরু করলেন, তারা জিয়াকে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানান। তিনি বললেন, wait and see.
আমি তাকে সেনানিবাসের আকাশে ঝড়ের সংকেত উপলব্ধি করতে বারবার অনুরোধ করি। কিন্তু বারবারজিয়ার একই জবাব, হামিদ, wait and see. এক মাঘে শীত যায় না।" (তিনটি সেনা অভ্যুত্থান এবং কিছু না বলা কথা)
জিয়া বন্দী হলেন। বন্দী বলতে অন্যদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় নিজের ঘরেই অবস্থান করলেন। বসার ঘরের টেলিফোনের লাইন কেটে দিলেও শোবার ঘরের মূল লাইন সচল ছিল। তা দিয়ে খালেদা জিয়া জিয়ার ঘনিষ্ঠদের সাথে যোগাযোগ করেন। বঙ্গভবন থেকে রশিদ জিয়ার সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি কথা বলেন নি, অথচ জিয়া কর্নেল তাহেরের সাথে কথা বলেছেন নভেম্বরের পাঁচ তারিখে। ছয় তারিখে কর্নেল তাহের তাকে ঘরবন্দী দশা থেকে বাইরে বের করে আনেন। এসব ঘটনা মোটেই সহজ করে দেখার বিষয় নয়। এখানে ভাববার মত অনেক কিছুই আছে। ৭ নভেম্বর ২০০৫ এ বেগম জিয়ার ছোট ভাই সাইদ ইস্কান্দার টিভিতে ইন্টারভিউ এ বলেন, "৭ নভেম্বরের সার্বিক অপারেশন ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ইনটেলিজেন্স অপারেশন। এর আগে কখনও কেউ এত নিপুন দক্ষতায় এরকম জটিল অপারেশন করতে পারে নি। ভিতরের ব্যাপার আমি আরো অনেক কিছু জানি"। কী ছিল ভিতরের ব্যাপার ? 'অনেক কিছু' বলতে তিনি কী বুঝাতে চেয়েছেন ?
খুনী রশিদের টু ফিল্ডের সৈন্যরা জিয়াকে বন্দীদশা থেকে উদ্ধার করে। কর্নেল হামিদ লিখেছেন,
টু ফিল্ডে যেয়ে দেখি সর্বত্র অস্ত্রধারী সৈন্য গিজ গিজ করছে। বললাম জিয়া কই ? কর্নেল আমিনুল হক জিয়ার রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,স্যার, সেটশন কমান্ডারও এসে গেছেন। জিয়া হাসলো। বলল, হামিদ, কেমন আছ? তারপর ঘাড় কাত করে একটু নিচু স্বরে বলল, কথাটা মনে আছে? এক মাঘে----?" (তিনটি সেনা অভ্যুত্থান এবং কিছু না বলা কথা)
রাত আড়াইটায় কর্নেল তাহের আসেন জিয়ার কাছে। দুজনার মধ্যে একান্ত আলোচনা এবং উত্তপ্ত আলোচনার পর তাহের জিয়াকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যেতে চাইলো ভাষণ দেয়ার জন্য। জিয়া কিছুতেই ঘর থেকে বের হতে রাজি হলো না। বরং ঘরে বসেই তিনি ভাষণ রেকর্ড করলেন, যা ভোর বেলায় প্রচারিত হয়েছে। এই ভাষণে জিয়া বলেন, সেনাবাহিনীর অনুরোধে তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। তার এই স্বঘোষিত উচ্চাভিলাষ পরবর্তী সময়ে প্রবল আপত্তির মুখে বাতিল হয়। গোলাম মুরশিদ তার বইতে লিখেছেন," ৭১ এর ২৭ মার্চে জিয়া প্রথমে নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন পরে শুধরে নিয়েছিলেন। এবারেও তিনি নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা দেন। পরে উপ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছিলেন"। (মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর)
জিয়ার সাথে তাহেরর ১২ দফা ছাড়া আর কী চুক্তি ছিল সেটা তারাই ভালো জানেন, তাই মধ্যরাতে দুজনার বনিবনা না হওয়াতে কর্নেল তাহের হিংসাত্মক পথে অগ্রসর হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী কর্নেল হামিদ লিখেছেন, বিকাল আনুমানিক চারটায় টু ফিল্ডে গেলাম জিয়ার কাছে। বারান্দায় উঠতেই দেখি কর্নেল তাহের মুখ কালো করে বসে আছে। বললাম, কী ব্যাপার তাহের ! মুখ এতো গম্ভীর কেনো ? বলল, স্যার, আপনারা কথা দিয়ে কথা রাখবেন না, মন খারাপ হবে না? আমি তার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলাম না। কর্নেল আমিন মুচকি হেসে আমাকে বারান্দায় নিয়ে গেল। বলল, বুঝলেন না স্যার ? ব্যাপারটা তো সব তাহেরের লোকজনই ঘটিয়েছে। এখন জিয়াকে মুঠোয় নিয়ে বারগেইন করছে। এখন তো সে জিয়াকে মেরে ফেলতে চায়।
এখন বুঝতে পারলাম, আশেপাশে এলোমেলো গোছের উর্দিপরা লোকজন নিয়মিত সৈন্য নয়, এরা জাসদের বিপ্লবী বাহিনীর লোক। ভিতরে যেয়ে দেখি জিয়া সৈনিকদের দেয়া দাবি দাওয়ার একখানা কাগজ পড়ছে। তার মেজাজ মোটেই ভাল না। বলল, ব্যাটাদের আমি ভাল করে দাবি মিটিয়ে দেব। বুঝলাম, তাহের এবং জিয়ার মধ্যে বড় রকমের মত-বিরোধ হয়ে গেছে। ক্ষমতার সিংহাসনে বসার সন্ধিক্ষণে দুই বাদশাহ। এক সিংহাসন। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে দুজনই পরস্পরের মুখোমুখি। রক্তক্ষয়ী সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠলো।
তাহের জেনারেল জিয়ার কাঁধে বন্দুক রেখে তাকে ব্যবহার করে ক্ষমতার মসনদে আরোহন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু জিয়া তার চেয়ে অধিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও চালাক হওয়াতে তার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। চরম মুহূর্তে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে তাহের যখন দেখলেন, তার হাত থেকে ক্ষমতার মসনদ হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে, তখনই শুরু হয় অফিসার নিধন অভিযান, চরম ও সর্বশেষ পন্থা হিসেবে। ৭/৮ নভেম্বরের রাত ছিল বিভীষিকার রাত। এই নির্মম পদক্ষেপ সেনানিবাসে ব্যাপক ভয় ভীতির সৃষ্টি করলেও জিয়াকে ক্ষমতার আসন থেকে উৎখাত করতে ব্যর্থ হয় তাহের।" (তিনটি সেনা অভ্যুত্থান এবং কিছু না বলা কথা)।
"
৭/৮ নভেম্বরে আওয়াজ উঠলো, সেপাই সেপাই ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই, সুবেদারের উপর পদ নাই। শুরু হল সেনাবাহিনীতে রক্তপানের খেলা। ৭ নভেম্বরের রাতেই ১২জন সৈনিক অফিসার প্রাণ হারালেন। হায়রে! যারা ৭ নভেম্বরের সকালে মুক্ত জিয়াকে ঘাড়ে নিয়ে জিন্দাবাদ বলেছে তারাই এখন বলছে, বিশ্বাসঘাতক জিয়া, তার উৎখাত চাই। কারণ তিনি সৈনিকদের ১২ দফা মানতে চাইছেন না। এক সৈনিকের অভিমত" আমরা জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করেছি, খালেদকে মেরেছি, কিন্তু তিনি এখন আমাদের দাবী মানছেন না। তিনি কথা দিয়ে কথা ফিরিয়ে নিয়েছেন"। (তিনটি সেনা অভ্যুত্থান এবং কিছু না বলা কথা)
যাই হোক, সেদিন জিয়া যেখানে যে ভাবে বলা দরকার, যা করা দরকার তা বলে এবং করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং পরবর্তী এ্যাকশনে যান।
কর্নেল হামিদ লিখেছেন, ------
"
সেপাইদের চাপে পড়ে ইতোমধ্যে জিয়া বহু অপমান সহ্য করেছে, তারা তাকে হত্যা করতে চেয়েছে। বিপ্লবীদের সাথে যোগ দিয়ে সেপাইরা তাকে ১২ দফায় সই করতে বাধ্য করেছে, ইতোমধ্যে চাপ সৃষ্টি করে ব্যাটম্যানপ্রথা বিলোপসহ বেশ কয়টি সুবিধা আদায় করে নিয়েছে, আর নয়। এবার ১২ দফা দাবিদারদের শায়েস্তা করার পালা। ...একদিন জিয়া বলল, আমি ঢাকা থেকে সিগন্যাল ইউনিটকে অতিসত্ত্বর সরাতে চাই।
বললাম, এতে অসন্তোষ বাড়বে। এসব কাজ কিছুদিন পরে করলেও চলবে।
সে কিছুতেই শুনলো না। বলল, দেখো আমি কী ভাবে তাদের সোজা করি।
আর্মি হেড কোয়ার্টারের নির্দেশে সিগন্যাল ইউনিটকে ঢাকা থেকে কুমিল্লা যেতে বলা হলো। এ নিয়ে সেনানিবাসে বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি হলো। প্রথমে তারা যেতে অস্বীকার করল। শেষ পর্যন্ত সু-কৌশলে প্রীতিভোজ, চা-চক্র ইত্যাদির মাধ্যমে কাজ সেরে নেয়া হল। তারা অসন্তুষ্ট হলো বটে, তবে জিয়ার নির্দেশ মানতে তাদের ছলে বলে কৌশলে বাধ্য করা হলো। সৈনিকরা জিয়ার মতিগতি নিয়ে সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠলো।
এবার ল্যান্সার ইউনিটের সৈনিকদের নির্দেশ দেয়া হল ঢাকা থেকে বগুড়ায় মুভ করার জন্য। জিয়া এটাকে টেকনিক্যাল মুভ বললেও সৈনিকদের বুঝতে বাকি রইল না জিয়ার উদ্দেশ্য। তারা জিয়ার নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলো। ট্যাংকগুলো সচল করে আবার তারা লড়তে প্রস্তুত হয়ে গেল।
২২ নভেম্বর। ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা খুবই নাজুক। যে কোন মুহুর্তে গোলাগুলি শুরু হয়ে যেতে পারে। বেগতিক দেখে জিয়া সেনানিবাসের অডিটোরিয়ামে জরুরী সভা আহবান করেন। বক্তব্যের এক পর্যায়ে জিয়া বলেন, আপনারা আমায় মানছেন না। আমি আর আপনাদের চীফ থাকতে চাইনা। এই বলে সবার সামনে স্টেজে কোমর থেকে বেল্ট খুলে মেঝেতে ফেলে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হল। সামনের সারিতে বসা জেসিওরা ছুটে এলেন, স্যার করছেন কি, করছেন কি। তারা তাড়াতাড়ি মাটি থেকে বেল্ট তুলে আবার পরিয়ে দিল। সবাই হাত মেলালো, কোলাকুলি করলো। এই সুযোগে জিয়া একখানা কোরান শরীফ (যা আগে থেকে ব্যবস্থা করে রাখা ছিল) এনে সব জেসিওকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করালো যে তারা তার কথা মানবে, শান্তি শৃংখলা বজায় রাখবে। জিয়া নিজেও পবিত্র কোরান ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলেন।
জিয়ার চাতুর্যপূর্ণ এই নাটক টনিকের মত কাজ করলো। ল্যান্সার ইউনিটের সৈনিকরা বগুড়ায় মুভ করলো।
জিয়া এখন শক্ত প্লাটফর্মের উপরে দাঁড়িয়ে। এখন জিয়ার ভিন্ন মূর্তি। জিয়া কঠোরভাবে জাসদপন্থী বিপ্লবীদের ও বিপ্লবী সৈনিকদের দমন করতে নির্দেশ দিলেন। শুরু হল ধর-পাকড়। জাসদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী যে নিধন চালানো হয়, তাতে হাজার হাজার জাসদকর্মী গ্রেফতার হয়। সেনানিবাসেও বহু বিপ্লবী জাসদপন্থী সৈনিকদের আটক করা হয়। গ্রেফতার হন কর্নেল তাহের। ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলে প্রাণ বলি দিয়ে চুকিয়ে যান হিসাব-নিকাশ।

ক্ষমতায় আরোহন করার পর জিয়া সৈনিকদের প্রতি প্রদত্ত কোন প্রতিশ্রুতিই বাস্তুবায়ন করেন নি। বরং পরবর্তীতে তাদের উপর নৃশংসভাবে দমননীতির স্টিম রোলার চালিয়ে জিয়া হত্যা করেন দুই হাজারের অধিক সৈন্য ও বিমান সেনা। জেল জুলুম আর চাকরিচ্যুতি ঘটে আরো হাজার দুয়েক সৈনিকের।
ঢাকায় রহস্যময় বিমান সেনা বিদ্রোহে সরকারি হিসেবেই মাত্র দুইমাসে ফাঁসিতে ঝুলানো হয় ১১৪৩ জন সৈনিককে। পাঁচটি কারাগারে এক সাথে ৮/১০ জন করে পর্যায়ক্রমে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। ফাঁসি ছাড়াও এলোপাথারি ফায়ারিং এ মারা যায় শত শত সৈনিক। এ ছাড়াও অমানবিক নির্যাতনে বহু সৈন্যের মৃত্যু ঘটে। এ ব্যাপারে সেনা বা বিমান বাহিনীর কোন প্রতিষ্ঠিত আইন কানুন মানা হয়নি। হতভাগ্য সৈনিকদের লাশ পর্যন্ত দেয়া হয়নি তাদের আত্মীয় স্বজনকে। কোথায় এত লাশ গোপন করা হল, তাও এক রহস্য। এটা ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড নাকি অভ্যুত্থান তা এখনো নির্ণয় করা সম্ভব হয় নি।
হায় ৭ নভেম্বর! অসংখ্য স্বজন হারা সেনা পরিবারের কান্না বিজড়িত এক ঐতিহাসিক দিবস ৭ নভেম্বর। এক আবেগময় বিপ্লবের মাধ্যমে সৈনিকরা প্রতিষ্ঠিত করেছিল তাদের প্রিয় জেনারেলকে সিংহাসনে। কিন্তু প্রতিদানে তারা পেলো জেল জুলুম হত্যা ফাঁসি চাকরিচ্যুতি বিতাড়ণ, নিপীড়ণ।
হাজার হাজার নিরপরাধ আত্মার আর্তনাদ আজও কেঁদে ফিরে ঢাকা সেনানিবাসের আকাশে বাতাসে। তাদের স্বজনরা আজো খুঁজে ফিরে প্রিয়জনের লাশ। কেউ শুনেনি তাদের ফরিয়াদ, তারা পায়নি বিচার"।
(
তিনটি সেনা অভ্যুত্থান এবং কিছু না বলা কথা)।
 ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান এবং জিয়ার বন্দীত্ব নিয়ে পরবর্তী সময়ে কর্নেল ফারুক রশিদের ১৫ আগস্ট,১৯৮৩ এবং ৭ নভেম্বর ১৯৮৩ তে দেয়া নিন্মোক্ত সাক্ষাৎকারটি স্যাটারডে পোস্টে প্রকাশিত হয়।

প্রশ্নঃ এই মর্মে গুজব আছে যে, জিয়ার শাসন আমলে প্রায় ডজনখানেক ব্যর্থ অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল। এ ব্যাপারে আপনাদের কিছু বলার আছে কী ?
জবাবঃ এইগুলো সব গুজব এবং মিথ্যা। জিয়ার শাসন আমলে একমাত্র অভ্যুত্থান করেছে তারাই, যারা তার সামরিক ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী এবং সেই অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হন। তার ওইসব উত্তরাধিকারীদের একাংশ বর্তমানে বাংলাদেশের ক্ষমতা উপভোগ করছে। অতীতে যে সব অভ্যুত্থানের গুজব ছড়ানো হয়, তা ছিল আসলে পুর্ব থেকে উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবে পরিকল্পিত ব্যাপার। এইসব তথাকথিত অভ্যুত্থানের কথা জিয়া সেই সময়কার ডাইরেকটরেট এর সাহায্যে রটনা করিয়েছিলেন নিন্মোক্ত উদ্দেশ্যেঃ ১, প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ বিভিন্ন স্তরের জাতীয়তাবাদী শক্তিসমূহকে নিশ্চিহ্ন করার একটা ক্ষেত্র সৃষ্টি করা। ২, ভয় ভীতি ও ত্রাস সঞ্চার করে তার মাধ্যমে অর্জিত ফল তার রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি চরিতার্থ করার কাজে লাগানো এবং ৩, বাইরের জগতের সামনে নিজেকে খুব শক্তিশালী এবং স্বীয় অবস্থানকে অত্যন্ত সুসংহত প্রমান করা।

যদিও জিয়াকে বন্দীদশা থেকে উদ্ধারের ব্যাপারে কর্নেল তাহেরের প্ল্যান প্রোগ্রাম অনুযায়ীই অভ্যুত্থান ঘটে। তবে এতে শুধু জাসদের বিপ্লবী সৈনিকরাই অংশ গ্রহণ করে নি, সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট গুলোও এতে অংশ গ্রহণ করে। জিয়া অত্যন্ত সুকৌশলে ঘটনার মধ্যে নানা ঘটনার অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে ও জটিল করে সকলের বোধগম্যের বাইরে নিয়ে গেছেন এবং স্বীয় চরিতার্থ হাসিল করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় থেকে শুরু করে স্বাধীন দেশের পরবর্তী সময়ে তিনি সব ধরণের মত ও পথের মানুষের সাথে যোগাযোগ করে তাদের উদ্দেশ্য ও মনোভাব বুঝতে গিয়ে যে ফিল্ড ওয়ার্ক করেছেন, তাতে সবাইকে টেক্কা দিয়ে যে গোল করা যাবে --- তার মনে এই ধারণাটা হয়ত পাকাপোক্ত হয়েছিল। কারণ, তিনি তো জানেন, তিনি সবাইকে চিনলেও কেউ তাকে চিনে নাই।
গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, তিনি ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও ধূর্ত। খুব ঠাণ্ডা মাথায় সব সিদ্ধান্ত নিতেন। পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগে দীর্ঘদিন কাজ করার ফলে কোনো ঝুঁকি না নিয়ে অন্যের কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিতে পারতেন তিনি। নিজের সত্যিকার ইচ্ছা কাউকে বুঝতে দিতেন না। কালো চশমার আড়ালে চোখ দুটিকেও আড়াল করে রাখতেন। আর, প্রয়োজন হলে উত্তেজিত না হয়েই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন এবং পারতেন হুকুম দিতে। নিজের লক্ষ্য হাসিলের জন্য পরম উপকারীকেও নির্দয়ভাবে খতম করে দিতে দ্বিধাবোধ করতেন না। (মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর)।
মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম সেক্টরের তার এক সহযোদ্ধা জিয়া সম্পর্কে বলেছেন, 'জিয়া ছিলেন নৃশংস প্রকৃতির মানুষ। তিনি এক হাতে মানুষ খুন আর অন্য হাতে খাবার খেতে পারতেন'
(
এ্যান্টিনি মাসকারেনহার্সঃ বাংলাদেশঃ এ লিগাসি অব ব্লাড। পরেশচন্দ্র সাহাঃ বাংলাদেশঃ ষড়যন্ত্রের রাজনীতি)
৩ নভেম্বরে জিয়ার বন্দীদশা ঘটনা ঘটানো থেকে শুরু করে ৭ নভেম্বরের ঘটনা পর্যন্ত জিয়া বিভিন্নজনকে বিভিন্নভাবে যে ব্যবহার করেছেন তার একটা ধারণা পাওয়া যায় সাইদ ইস্কান্দারের সাক্ষাৎকার থেকে। তিনি সে সময়ে জিয়ার গৃহীত পদক্ষেপকে একদিকে " পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ইনটেলিজেন্স অপারেশন' বলে অভিহিত করেছেন, অন্যদিকে জিয়ার অশুভ পায়তারার ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, "এর আগে কখনও কেউ এত নিপুন দক্ষতায় এ রকম জটিল অপারেশন করতে পারে নি। ভিতরের ব্যাপার আমি আরো অনেক কিছু জানি"।
জিয়া অনেক আগে থেকেই সেনাবাহিনীতে অনুগত বাহিনী তৈরি করেন। এদেরকে তিনি ৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বরের ঘটনায় ব্যবহার করেন।
প্রতিটি বইতে লেখকরা বলেছেন, জিয়া সন্দেহপ্রবণ ছিলেন, তিনি কাউকে বিশ্বাস করতেন না। হয়ত এ কারণে ঘটনাকে জটিল করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য তিনি সেনাবাহিনীতে তার অনুগত অফিসারদের দিয়ে তাদের অধীনস্থদের নিয়ন্ত্রন করার নির্দেশ দেন, অন্যদিকে তিনি নিজে কর্নেল তাহেরকে এই কাজে সম্পৃক্ত করেন। যাতে পারস্পরিক একটা ভারসাম্য থাকে।
জিয়াকে বুঝা সাধারণ মানুষের কাজ নয়। এর জন্য চাই উচ্চ ধীসম্পন্ন শক্তিশালী মস্তিষ্ক। আমাদের দেশে খুব কম মানুষই কূট-কৌশল আর কুচিন্তার অধিকারী। অধিকাংশ মানুষই সহজ সরল আবেগপ্রবণ। তারা মানুষের বাহ্যিক রূপ দেখে অতি সহজেই মুগ্ধ হয়। কারণ তারা মস্তিষ্কজাত বুদ্ধি দিয়ে যাচাই করে না, আবেগপ্রসূত মন দিয়ে বিচার করে। সে জন্য দাঁড়ি টুপি আর জুব্বাওয়ালাদের তারা যেমন সন্দেহাতীতভাবে খোদাভক্ত বলে বিশ্বাস করে, তেমনি মানুষের মুখের সুন্দর সুন্দর বচন এবং আপাতদৃষ্টিতে বাহ্যিক ভালো কাজ দেখে বিগলিত হয়। এদের অনাহারী পেটে দানা না দিয়ে শুধু ভালো কথা আর পিঠ বুলিয়ে দিলেই এরা যার পর নাই খুশি হয়। এই সব মানুষকে বিশ্বাসই করানো যাবে না যে, তাদের ধারণা ভুল। বরং যারা বুঝাতে যাবে উল্টো তাদেরকেই ভুল বুঝবে। কুচক্রীরা অসৎ উদ্দেশ্যে মানুষের এই নিষ্পাপ আবেগী মনটাকেই ব্যবহার করে আসছে যুগ যুগ ধরে।
এ জন্যই ইসলাম ধর্মে কর্মের পাশাপাশি নিয়ত তথা দৃঢ়সংকল্প বা স্থির উদ্দেশ্যকে এত জোর দেয়া হয়েছে। কারণ এর মধ্যেই মানুষের কর্মের সু ও কু দিকগুলোর প্রতিফলন ঘটে।
জিয়ার উদ্দেশ্য ছিল কর্নেল তাহেরকে মেরে ফেলা। সেজন্য বিচারের নামে প্রহসন সাজানো হয়। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী ফারুক-রশিদ তাদের সাক্ষাৎকারে বলেন, "জেনারেল জিয়া কর্নেল তাহেরের মাধ্যমে জাসদের যোগ সাজশে তার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার ষড়যন্ত্র করেন। জিয়া ক্ষমতা দখল করার পর কর্নেল তাহেরকে নিঃশেষ করার পথ খুঁজে নেন। কেননা, তার মাধ্যমেই জাসদের সাথে তার যোগসূত্র রচিত হয়েছিল। তিনি এতদসংক্রান্ত সকল সাক্ষ্য প্রমান গায়েব করার সিদ্ধান্ত নেন। আর এই উদ্দেশ্যে জাসদের গণবাহিনীর হাতে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানো ও জাসদের সাথে রাজনৈতিক যোগসাজশ ধামাচাপা দেয়ার জন্য জেনারেল জিয়া হিংসাত্মক পথ বেছে নেন। কেননা এই দুটো বিষয় প্রমান হলে জিয়ার রাজনৈতিক মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠতো।"
জিয়াকে তথাকথিত বন্দীদশা থেকে উদ্ধার করলেও তাহেরকে জিয়া পুরোপুরি বিশ্বাস করেন নি। তাহেরের রাজনৈতিক আদর্শ এবং সেনাবাহিনীর কাছে তার জনপ্রিয়তা --- কোনটাই তিনি ভালো চোখে দেখেন নি। কাজেই তিনি তাহের এবং জাসদের অন্য নেতাদের কয়েকজনের বিচার করেন, বিচার করতে বাধ্য হন। তাহের এবং এই নেতাদের এগারজন সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন না। সেদিক থেকে তাদের বিচার হওয়ার কথা বেসামরিক আদালতে। কিন্তু সাধারণ আদালতের উপর জিয়ার ভরসা ছিল না। কারণ তিনি যা চান, যত তাড়াতাড়ি চান, সাধারণ আদালত হয়তো তাকে তা দিতে পারতো না। কর্নেল তাদের পঙ্গু ছিলেন, জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী কোন পঙ্গুকে ফাঁসি দেয়া হয় না। সেদিন তাহেরের ক্ষেত্রে এটাও মানা হয় নি।
১৯৭৬ সালের ১৫ জুন জিয়া একটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। আর এই অর্ডিন্যান্সের বলেই গঠিত হয় বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনাল। এই ট্রাইব্যুনালের বিচারেই তাহেরের ফাঁসি হয়।
কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে আনা হয় দেশদ্রোহের অভিযোগ। অভিযোগ আনা হয় তিনি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের আইনানুগ সরকারকে উৎখাত করতে চেয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালে ১৫ নভেম্বরের পর কোন সরকারই বৈধ ছিল না। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি না থাকলে, সে দায়িত্ব পালন করবেন উপ রাষ্ট্রপতি। উপ রাষ্ট্রপতি না থাকলে সে দায়িত্ব পালন করবেন সংসদের স্পিকার। মোশতাকসহ পরবর্তীর কেউই আইনানুগ সরকার নয়। আর যে সব অভ্যুত্থান ঘটেছে তা সত্যিকার অর্থে অভ্যুত্থানও নয়। এগুলো সবই কিছু সেনার উচ্ছৃঙ্গখলতা আর কিছু অফিসারের অপরিণামদর্শী উচ্চাভিলাষ মাত্র। সমগ্র সেনাবাহিনীর এখানে কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।
তারপরেও ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে অস্ত্র বলে, গায়ের জোরে গঠিত সরকারকে বলা হয়েছে আইনানুগ। তাই যদি হয়, তাহলে তো ঐ সালের ৩ নভেম্বর ও ১৫ আগস্টের সরকারকেও আইনানুগ সরকার বলে মেনে নিতে হয় জিয়াকে। তাহলে তো ৩ নভেম্বরে যারা হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে তাদেরও ফাঁসি দিতে হয়, ফাঁসি দিতে হয় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদেরও। কিন্তু তাতো হয় নি। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত অফিসারদের জিয়া বিনা বিচারে নিষ্কৃতি দিয়েছেন। তিনি পুরষ্কৃত করেছেন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে। এই খুনীদের পদোন্নতিও হয়েছিল। এখানেই শেষ নয়, মোশতাক বেআইনি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন ২৬ সেপ্টেম্বর। এটা বাতিল হয় ২৬ অক্টোবর। জিয়া ন্যায় বিচারক হলে খুনীরা যখন পরের বছর দেশে এসেছিল তার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটাতে তখনই তাদের গ্রেফতার করে বিচার করতে পারতেন। তার বদলে তিনি ১৯৭৭ সালের ২৩ এপ্রিল নতুন একটি অধ্যাদেশ জারি করে মোশতাকের ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ পুনর্বহাল করেন। এরপর, ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি এই অধ্যাদেশ সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করেন।
চট্টগ্রামে নিহত জিয়ার শরীরের বিভিন্ন অংশে আলাদা আলাদা ভাবে ছিল অন্তত ২০টি বুলেটের চিহ্ন। (এ্যান্টনি ১৯৮৬)।"
"
একজন মানুষকে হত্যা করতে এত বুলেট লাগে না। অনেক সময় মনে হয়, জিয়া যে উচ্ছৃঙ্খল মেজর এবং তাদের সাগরেদদের বেআইনি হত্যার বিচার করেন নি, তা-ই হয়ত অন্যদেরও বিদ্রোহ করতে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু করে থাকুক অথবা না-ই থাকুক, মুজিব হত্যা, সেরনিয়াবাত হত্যা, মণি হত্যা, এবং জেল হত্যাকে ক্ষমা করে জিয়া কোন সৈনিক বা সৎ লোকের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন নি"। ( গোলাম মুরশিদঃ মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর)।

নেমেসিস। যার নাম প্রকৃতির প্রতিশোধ। মানুষ না চাইলেও যা নেমে আসে নিয়তির অমোঘ নিয়মেই।

১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর চার ঘন্টার মধ্যেই জিয়া প্রধান সেনাপতি আর খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট পদ অলংকৃত করেন। কর্নেল তাহের মোশতাকের পরিবর্তে জিয়াকে প্রেসিডেন্ট করার জন্য ফারুক রশিদকে পীড়াপীড়ি করেছিলো, ওরা রাজী হয় নি। ফলে মোশতাকই প্রেসিডেন্ট পদে আসীন থাকেন। কিন্তু জাতীয় চার নেতাকে কারা অভ্যন্তরে নৃশংস হত্যা করার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ শাফায়াত মোশতাককে খুনী নামে অভিহিত করে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। এ পদে বসানো হয় বিচারপতি আবু সায়েম চৌধুরীকে। ৩ নভেম্বর পাল্টা সহিংস ঘটনার মধ্য দিয়ে আবার জঙ্গীবাদের বিজয় ঘটে। এবার ওসমানী প্রেসিডেন্ট সায়েমের পরিবর্তে মোশতাককে আবার প্রেসিডেন্ট পদে পুনবর্হাল করার প্রস্তাব করলে কর্নেল আবু তাহের ও জেনারেল খলি্লুর রহমান এর বিরোধিতা করেন। ফলে সায়েমেই প্রেসিডেন্ট পদে বহাল থাকেন। নাটকীয় বন্দীদশা থেকে নাটকীয়ভাবে মুক্ত হয়েই জিয়া নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এটাও খলিলুর রহমানের আপত্তির কারণে তা কার্যকর হয় নি। ফলে জিয়াকে উপ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েই থাকতে হলো। এখানেই জিয়ার বৈশিষ্ট্য। তিনি কোন কিছুতেই তাড়াহুড়া করতে রাজী নন। তার চলার মূলমন্ত্রই হলো wait and see. কারণ, তার মতে এক মাঘে শীত যায় না।
৬ নভেম্বরের পর থেকে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে জিয়া পুরোপুরি সামরিকতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যান। দৃশ্যত আবু সায়েম দেশের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হলেও বন্দুকের নলের মুখে তিনি ছিলেন অসহায়। পর্দার আড়াল থেকে সমস্ত ক্ষমতা নিয়ন্ত্রন করতেন সেনাবাহিনীর প্রধান জিয়াউর রহমান। প্রেসিডেন্ট সায়েম ক্ষমতায় বসেই ঘোষণা করেছিলেন যে, ছয় মাসের মধ্যে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু জিয়াউর রহমান ৭৬ সালের মে মাসে সায়েমকে এই নির্বাচন বাতিল করতে বাধ্য করেন। কারণ তখনো তার ক্ষমতা সুসংহত করার কাজ সম্পন্ন হয়নি।
৭৬ সালের ২৮ নভেম্বর। সন্ধ্যা সাতটা। জিয়া দলবল নিয়ে বঙ্গভবনে হাজির। সায়েম হকচকিত হয়ে বললেন, আপনারা ? জিয়া বললেন, হা, আমরা। প্রধান সামরিক আইন পদটি আপনাকে ছাড়তে হবে। ওটা আমার চাই। প্রেসিডেন্ট সায়েমের ব্যক্তিগত সহকারী বিচারপতি সাত্তার (পরবর্তী সময়ে জিয়া সরকারের রাষ্ট্রপতি) বললেন, ভাই, জিয়া সাহেব যখন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি চাইছেন,তখন দিন না তাকে সে দায়িত্ব।
এই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের ক্ষমতা বলপূর্বক দখল করার মধ্যে দিয়ে জিয়াউর রহমান একনায়কতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেন।
১৯৭৭ সাল। ২১ এপ্রিল। এবার জিয়া সায়েমকে বাধ্য করলেন প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়তে এবং তাকে সে পদে স্থলাভিষিক্ত করতে। দেশে কোন নির্বাচন নেই, অভ্যুত্থান নেই, ঝুঁকি নেই ---
পৈতৃক সম্পত্তির মত সহজেই জিয়া রাষ্ট্রপতির সিংহাসনে আরোহন করলেন। এর তিন সপ্তাহ আগে, "জিয়াউর রহমান আবু সাইদ চৌধুরীকে বলেন, আমরা এক বছর চালিয়েছি। আমাদের বয়সই বা কি, অভিজ্ঞতাই বা কি, আপনার মত লোকের এখন এ দেশের শাসনভার নেয়া উচিত। আপনি বললেই সায়েম সাহেব পদত্যাগ করবেন।
জিয়ার বক্তব্য শেষ হওয়ার পরপরই বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী বলেন,দেখুন, আমি ছিলাম নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি। দেশ শাসনের সকল দায়িত্ব ছিল বঙ্গবন্ধুর উপর।রাজনীতি আমার জন্য নয়।নির্বাহিক প্রেসিডেন্ট হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
তখন জিয়া বলে, আপনার তো কোন শত্রু নাই।
বিচারপতি চৌধুরী বলেন, আমারও শত্রু আছে। তারা আপনার নিকট পৌছাতে পারে না।
এটা জিয়ার কূট -কৌশলের আর একটা জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ।
যদিও অনেকে বলবেন, বিচারপতি চৌধুরী তো খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে জনাব চৌধুরীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, সেদিন যদি বলতে পারতাম,তোমরা আমাকে মেরে ফেলতে পারো, কিন্তু আমি মন্ত্রী হতে পারবো না, তাহলে সেটাই হতো আমার যথার্থ কাজ। কিন্তু সেটা আমি বলতে পারি নি। সেই না পারার ব্যর্থতার বোঝা আজও বহন করেছি, আজীবন বহন করতে হবে"। (স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালিঃ আবদুল মতিন)
আসলে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু আর খুনীদের নৃশংসতা দেখে সে সময় অনেকেই নির্বাক হয়ে গিয়েছিল, সুস্থ‍্যভাবে চিন্তা করার শক্তিও লোপ পেয়েছিল অনেকের। স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে বিচারপতি চৌধুরীর অবদানের কথা কারো ভোলবার কথা নয়। তিনি হয়ত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েই সেদিন সুস্থ্যচিন্তা করতে পারেন নি, তবে তিনি উচ্চাভিলাষী দালাল নন। জিয়া কৌশলে এই মহাপ্রাণ ব্যক্তিকে দালাল বানিয়ে জাতির কাছে ছোট করে তার আড়ালে একদিকে নিজের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চেয়েছিলেন, অন্যদিকে চেয়েছিলেন একজন স্বাধীনতা মুক্তিকামী মানুষকে ব্যবহার করে নিজের গ্রহণ যোগ্যতা বাড়াতে। এটা সম্পূর্ণ আইওয়াশ। বিচারপতি প্রথমবার ভীত হয়ে যে কাজ করেছিলেন, দ্বিতীয়বারে তা শোধরে নিয়ে শুভচেতনার পরিচয় দিয়েছেন।
"
জিয়া শুধু রাষ্ট্রপতি হলেন না, একই সাথে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সেনাপ্রধান এবং চীফ অব ডিফেন্স। অর্থাৎ একই সময়ে চারপদের অধিকারী।" ( গোলাম মুরশিদঃ মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর)।
কিন্তু এটা তো ষাটের দশক নয় যে, গায়ে উর্দি চাপিয়ে আন্তর্জাতিক অনুমোদন পাওয়া যাবে! তাই তাকে নজর দিতে হলো ভোট ব্যবস্থার দিকে। যদিও তিনি উর্দি খুলে সাফারি স্যুট পড়লেন, কিন্তু এতে বিদেশি সাংবাদিক কৌতুক করে লিখলেন, বাংলাদেশের সাফারি স্যুট পরা জেনারেল। (পরেশ সাহাঃ বাংলাদেশঃ ষড়যন্ত্রের রাজনীতি)
১৯৭৭ সালের মে মাসে জিয়া একটা লোক দেখানো গণভোট গ্রহণ করেন। তার পক্ষে যে জনগণ আছে তা তো দেখাতে হবে! তবে তিনি আগে থেকেই সব জায়গার কর্মকর্তাদের বলে দিয়েছিলেন, আর যাই হোক, ভোটদাতার সংখ্যা যেন মোট ভোটদাতার শতকরা ৭০% এর বেশি না হয়। কিন্তু অতি উৎসাহী কর্মকর্তারা নিজেদের দক্ষতা প্রমানের জন্য দেখালেন ভোট দিয়েছে শতকরা ৮৮.৫ ভাগ ভোটদাতা। আর জিয়া পেয়েছেন শতকরা ৯৮.৯ ভাগ ভোট। সাধারণ নির্বাচনের সময়েই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশের বেশি ভোটদাতা যেখানে ভোটকেন্দ্রে হাজির হয় না, সেখানে গণভোটের ক্ষেত্রে ভোটারদের এত সমাহার। সত্যি সেলুকাস! গিনেস বুকে স্থান পাবার মত রেকর্ড বটে!
৭৮ সালের ৩ জুন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দিলেন জিয়া। "এ ব্যাপারে সরকারি বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয় ৪০ দিন আগে। বিরোধী পক্ষ প্রচার কার্য চালানোর সময় পান মাত্র ২৩ দিন। আর ভোটার তালিকা? এক প্রস্থ ভোটার তালিকার দাম ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। তাদের তো আর সরকারি খাজাঞ্চি খানা নেই। জিয়া নিজে প্রেসিডেন্ট, নিজে প্রার্থী। তার তো টাকা পয়সা থেকে অন্য যে কোন সুযোগ সুবিধার কমতি নেই। জেনারেল খলিলুর রহমান অভিযোগ করে বলেছিলেন, ঐ সময় সেনা ছাউনির এক জেনারেল উচ্চ পদস্থ পুলিশ অফিসারদের কাছে দেয়া ভাষণে বলেন, যে কোন মূল্যে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে নির্বাচনে জয়ী করতে হবে। এখানেও ফলাফলের ব্যত্যয় ঘটলো না। প্রতিদ্বন্দ্বী ওসমানী পেলো শতকরা ২১.৭ ভাগ ভোট আর জিয়া পেলেন ৭৬.৭ ভাগ।" (পরেশ সাহাঃ বাংলাদেশঃ ষড়যন্ত্রের রাজনীতি)।
নির্বাচনে কারচুপির কথা লিখতে যেয়ে গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছিল বিকেল পাঁচটায়। আর কেরানীগঞ্জের একটি ভোটকেন্দ্রের ফলাফল বেতারে প্রচারিত হয়েছিল সাড়ে পাঁচটার আগেই।(মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর)।
এ নির্বাচন অবাধ হয়েছিল কী না, সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু বড় কথা হল, প্রসিডেন্ট পদে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতাই তো ছিল না জিয়ার । তিনি তখন চীফ অব আর্মি স্টাফ পদে সবেতনে চাকরি করছিলেন। চাকরিতে থাকা অবস্থায় সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট কেনো, সংসদ সদস্য পদেও দাঁড়ানোর নিয়ম নেই। সুতরাং তার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাটাই ছিল অবৈধ। এই অবৈধ কর্মকে বৈধ করার জন্য তিনি আর একটি অবৈধ কাজ করেন। তা হলো পরের বছর অর্থাৎ ৭৯ সালে ২৮ এপ্রিল মাসে back date দিয়ে ৭৮ সালে ২৯ এপ্রিল থেকে নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত দেখিয়ে একটি অধ্যাদেশ জারি করেন। (মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর)।
এবার নির্বাচিত হয়ে তার বিশেষ অনুগত বিচারপতি সাত্তারকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে মনোনীত করেন। এই সাত্তারের আবরণে তিনি তার রাজনৈতিক দল বিএনপি গড়ে তোলেন, মুক্তিযোদ্ধা জিয়া তার দলে অন্তর্ভুক্ত করেন স্বাধীনতা বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ডান এবং বাম দল গুলোকে। শুরু হল তার তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের যাত্রা।
পরের বছর তিনি এই দেশবিরোধী বহুজাতিক দলের চেয়ারম্যান পদ গ্রহণ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেন। অলৌকিক হলেও সত্য, সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২০৭টি আসন লাভ করে বিএনপি, যার বয়স তখনো এক বৎসর পূর্ণ হয়নি। এ নির্বাচনে নাকি ভোট দিয়েছিলেন শতকরা মাত্র ৪২ ভাগ ভোটদাতা। প্রেসিডেন্ট পদের মত এক পদের নির্বাচনের চেয়েও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটদাতার সংখ্যা কমে গেল যাদুবলে! (প্রেসিডেন্ট পদে ভোটদাতা ছিলেন ৫০ শতাংশ)। এ ধরণের আজগুবি নির্বাচনকেও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বিধ্বস্ত আওয়ামী লীগ বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেয় নি। আওয়ামী লীগের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান। কিন্তু তাকে বলপূর্বক পরাজিত করা হয়। তাকে প্রথমে বিজয়ী ঘোষণা করা হলেও দুইদিন পর পুনরায় ভোট গণনার নামে তাকে পরাজিত ঘোষণা করা হয়।

সব চেয়ে বড় কথা হলো, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় জিয়া বিরোধী দলগুলোর আপত্তি সত্ত্বেও সামরিক আইন প্রত্যাহার করেন নি। হয়ত তিনি মনে করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তার দল যদি সংখ্যা গরিষ্ঠতা না পায় তাহলে এই সামরিক আইনই তো তার রক্ষা কবচ। তখন তিনি এই আইনের বদৌলতেই নির্বাচনের ফলকে বাতিল করে আরো শক্ত হাতে শাসনদন্ড ধরতে পারবেন।
নির্বাচন হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেন, কিন্তু সংসদকে কার্যত কোন ক্ষমতা প্রদান করলেন না"পার্লামেন্ট কোন আইন আইন পাশ করলে তা তিনি মেনে নিতে বাধ্য ছিলেন না। যে কোন আইন ভেটো দেয়ার ক্ষমতা ছিল তার। সেই ভেটোর বিরুদ্ধে পার্লামেন্ট আবার নতুন করে আইন প্রণয়ন করলে, তা-ও মানতে বাধ্য নন তিনি। তখন করতে হবে গণভোট। সেই গণভোটে এই আইনের পক্ষে জণগণ রায় দিলে, তবেই সে আইন তিনি মেনে নিতে বাধ্য হবেন তিনি। এ ছাড়া, তিনি আরো একটি বিধান রাখলেন যে, পার্লামেন্ট যেমনই করুক না কেন, মন্ত্রীদের তিন ভাগের এক ভাগ নিয়োগ করবেন তিনি। এর জন্য তাদের যে পার্লামেন্টের সদস্য হতে হবে, এমন কোন কোন কথা নেই। জাতীয় স্বার্থে তিনি পার্লামেন্টকে না জানিয়ে চুক্তি সই করতে পারবেন। তিনি পারবেন ইচ্ছে মত জাতীয় সংসদ ডাকতে, স্থগিত রাখতে এবং বাতিল করতে। এভাবে জিয়া পার্লামেন্টকে একটি ক্ষমতাহীন বিতর্ক সভায় পরিণত করে যে ক্ষান্ত হলেন, তা নয়, নিজের হাতে রেখে দিলেন অনেকগুলো মন্ত্রণালয় "। (এ্যান্টনিঃ বাংলাদেশঃ এ লিগেসি অব ব্লাড)
(
গোলাম মুরশিদঃ মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর)।

স্বার্থসিদ্ধি এবং ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে জিয়া বিশ্বাসী ছিলেন একাধিক শক্তির আপাত বিচ্ছিন্নতা অথচ সমান্তরাল, জটিল বিন্যাসিক সহাবস্থান এবং দমন-পীড়ন-নিধন আর পালাক্রমিক সংস্থাপনমূলক কার্যক্রম।

জিয়ার ক্ষমতার উৎস ছিল বন্দুকের নল। সে জন্য তিনি সামরিক বাহিনীকে ঢেলে সাজালেন। নতুন সৈন্যদের নিয়ে নতুন পাঁচটি ডিভিশন করেন। যে ১২ দফাকে কেন্দ্র করে কর্নেল তাহের ফাঁসির আসামি হন, সেই বার দফার কিছু দাবী পুরণ করে নিচুতলার সৈনিকদের সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করেন। এর ফলে প্রতিরক্ষা খাতে বাজেটের পরিমান দাঁড়ায় ২০৬৩ মিলিয়ন টাকায়। যা মুল বাজেটের ২৯ শতাংশ। বঙ্গবন্ধুর আমলে প্রতিরক্ষা বাজেট ছিল ৭৫০ মিলিয়ন টাকা। ( মূল বাজেটের ১৩ শতাংশ)। সামরিক বাহিনীর এই বিপুল ব্যয়ভার মেটাতে জিয়াকে অন্য দপ্তরের বরাদ্দ অর্থও টেনে আনতে হয়।
সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি প্যারা মিলিটারি বাহিনী যেমন,আনসার,পুলিশ বিডিআর ইত্যাদিকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি এগুলোর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করেন।
বিশেষ করে তিনি ঢাকার পুলিশ বাহিনীকে ঢেলে সাজালেন। সাড়ে বারো হাজার লোককে ঢোকানো হলো তার ভেতরে। এদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে রক্ষীবাহিনীর আদলে গড়ে তোলা হলো। প্রয়োজনে যেন এদের বাংলাদেশের যে কোন অঞ্চলে পাঠানো যেতে পারে।

তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অথবা যে সৈন্যরা একত্রে দীর্ঘদিন কাজ করেছিল তাদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেন বিভিন্ন ডিভিশনে ও বিভিন্ন জায়গায়। প্রবীণ অফিসারদের মধ্যে যারা তাকে আপৎকালীন সময়ে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন তাদের সরিয়ে দেন ঢাকা থেকে অনেক দূরে। যেমন যশোরে মীর শওকত আলী, কুমিল্লায় নুরউদ্দিন এবং চট্টগ্রামে মঞ্জুরকে। সে সময় স্টেশন কমান্ডার কর্নেল হামিদ যিনি সার্বক্ষণিকভাবে জিয়াকে সহযোগিতা করে এসেছেন তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। প্রধান সেনাপতি করে কাছে টেনে নেন মুক্তিযুদ্ধে অনভিজ্ঞ পাকিস্তান ফেরত এরশাদকে। শোনা যায় এরশাদ মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে রংপুরে বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান না করে আবার পাকিস্তান চলে যান।

জাতীয় সংসদেও তিনি সামরিক সদস্যদের নিয়ে আসেন। মন্ত্রীদের মধ্যেও সামরিক ব্যক্তিরা ছিল। শুধু তাই নয়, জিয়া তার প্রশাসনিক কাঠামোতেও নিয়ে এসেছেন বহু সামরিক সদস্য। এর ফলে একদিকে গণতন্ত্র ব্যাহত হয়, অন্যদিকে সামরিক বাহিনীর এই সদস্যদের দুর্নীতির দিকে ঠেলে দেয়া হয়।

এ ভাবে জিয়া সেনাবাহিনীর চাপ জনগণের ঘাড়ের উপর রেখে, গণতন্ত্রের শ্বাসরূদ্ধ করে সামরিকীকরণের মাধ্যমে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। যার ফলে তার সুযোগ্য উত্তরাধিকারী জেনারেল এরশাদ প্রায় এক দশক দাপটের সাথে রাজত্ব করতে পেরেছিলেন।
জিয়ার স্বৈরতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রকে সমালোচনা করে জেনারেল ওসমানী বলেন, 'ক্ষমতার পরিপূর্ণ কেন্দ্রীয়করণের ফলে প্রেসিডেন্ট জিয়া স্বৈরাচারী শাসকে পরিণত হন'
খন্দকার মোশতাক আহমেদ বলেন, 'জিয়াউর রহমানের গণতন্ত্র একনায়কতন্ত্রের চেয়েও ভয়ংকর।। জনগণকে বিপথে চালিত করার জন্য তিনি সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্রের কায়েম করেছিলেন।'

I will make politics difficult for the politicians.
জিয়ার রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন তত্ত্ব।
(
যার নাম বহুদলীয় গণতন্ত্র)
জিয়ার রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন তত্ত্বের সূত্রপাত ঘটে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধীশক্তি, পাকিস্তানপন্থী, ভারতবিরোধী, বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষীদের নিয়ে বিএনপি নামক দল গঠনের মধ্য দিয়ে। এবার কাজ হল এদের জাতীয় ভাবে পুনর্বাসন করা।

এ রকম কিছু ব্যক্তিকে এনে তিনি জাতীয় সংসদ অপবিত্র করেন। এদের মধ্যে একজন শাহ আজিজুর রহমান। শাহ আজিজুর রহমানকে জিয়া প্রধানমন্ত্রী বানালেন। অথচ এই শাহ আজিজুর রহমান ৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জাতিসংঘে যেয়ে বলেন, 'পাকিস্তানি সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানে হামলা চালিয়ে অন্যায় কিছু করে নি। স্বাধীনতা নামে সেখানে যা চলছে, তা হলো ভারতের মদদপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের উচিত সেটাকে পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার হিসেবে গ্রহণ করা"।
জিয়ার মন্ত্রীসভায় আরো পাঁচজন রাজাকার ছিলেন। এরা হলেন, ১। মসিউর রহমান ২। সামসুল হুদা ৩। মির্জা গোলাম হাফিজ ৪। শফিউল আলম ৫। আব্দুল আলিম।

মসিউর রহমান পাকিস্তান সরকারের ঠিকাদার ছিলেন। সামসুল হুদা ছিলেন পাকিস্তান বেতারের একজন প্রযোজক। সে সময় তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে পাক বেতার থেকে কতগুলো অনুষ্ঠান প্রচার করেছিলেন।

মির্জা গোলাম হাফিজ ছিলেন পাকিস্তান চীন মৈত্রী সমিতির সভাপতি। তিনি বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে স্বাধীনতা বিরোধী প্রচার চালাতেন। তিনি তার বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের এই তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধ আসলে একটা ভারতীয় ষড়যন্ত্র।
বাংলাদেশেরর স্বাধীনতার পর আব্দুল আলিম, মসিউর রহমান, শাহ আজিজুর রহমানকে পাকিস্তানের দালাল হিসেবে জেলে পাঠানো হয়েছিল।

১৯৭৮ সালের ১১ জুলাই পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে গোলাম আজম ঢাকায় আসেন তিন মাসের ভিসা নিয়ে। তার মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও জিয়া সরকার তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। গোলাম আজম আড়ালে থেকে জামাত দলের কাজ চালিয়ে যান। এক সময় গোলাম আজমকে জামাত দলের আমির বলে ঘোষণা দেয়া হয়।

জিয়া জাতীয় সংসদে যেমন মুক্তিযোদ্ধা আর পাকিস্তানী দালালদের একই আসনে বসান তেমনি একদিকে গোলাম আজমসহ জামাতকে পুনর্বাসন করে অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসনের নামে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের দলীয়করণ করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রণোদনা স্বরূপ জয় বাংলা ধ্বনিকে জিন্দাবাদে পরিণত করার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মুল চেতনাকে ধ্বংস করে দেন।

এবার দমন-পীড়ন- নিধন পালা।
জিয়া একদিকে অভ্যুত্থানের নামে, বিদ্রোহের নামে হাজার হাজার সৈন্য ও সৈনিক অফিসার নিধন করেন অন্যদিকে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেও শক্ত হাতে দাবিয়ে রাখেন। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ১৯৭৭ সালের এপ্রিলের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ঐ সময় বাংলাদেশে রাজনৈতিক বন্দীর সংখ্যা ছিল ১০ থেকে ১৫ হাজার। বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলির মতে এই সংখ্যা আরো বেশি। প্রায় ৬২ হাজার।

এইসব বন্দীদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক ছিলেন সাংবাদিক, লেখক ও অন্যান্য শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী। এদের মধ্যে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য পদার্থবিজ্ঞানী ডঃ মতিন চৌধুরীর নাম অন্যতম। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় সাতটি মামলা। পশ্চিম বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি ডঃ চৌধুরীর মুক্তি দাবী করে জিয়া সরকারকে চিঠি দেন। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয় নি। ডঃ চৌধুরীর অপরাধ তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রিয়পাত্র ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য।
জেলে ডঃ চৌধুরীর স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। ৮১ সালের ২৪ জুন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান।

money is no problem -----
জিয়ার সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন তত্ত্ব

প্রেসিডেন্ট জিয়া রাষ্ট্রীয় টাকার বিপুল অপচয় ঘটিয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন কৌশলে দুর্বৃত্তায়নের কাজটি সম্পন্ন করেন।

১। ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এক প্রস্থ ভোটার তালিকার দাম ছিল ৬০ হাজার মার্কিন ডলার।
২। তিনি জানেন, বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস। বন্দুকের নলের রাজনীতির সাথে তিনি অষ্টেপৃষ্টে জড়িত ছিলেন। তাই ক্ষমতায় বসেই প্রতিরক্ষা খাতে খরচ বাড়িয়ে দেন। বঙ্গ বন্ধুর আমলে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় হতো মূল বাজেট বরাদ্দের ১৩ শতাংশ, জিয়ার আমলে সেটা হল ২৯ শতাংশ।
৩। কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলে সেনাবাহিনিতে নতুন নতুন ডিভিশন তৈরি করেন. নজর দেন বাংলাদেশ রাইফেলস,আনসার বাহিনির দিকেও। এ ছাড়াও নয় লক্ষ স্বচ্ছাসেবক সেবিকা নিয়োগ করেছিলেন। এসব করার উদ্দেশ্য যত না প্রতিরক্ষার কারণে তার চেয়েও বেশি ছিল আভ্যন্তরীন সুরক্ষা। অথচ দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে।
৪। দেশের নদী হল পানির উৎস। তিনি ভরাট নদী খনন না করে খাল কাটলেন, নদীতে পানি না থাকলে খালে পানি আসবে কোত্থেকে ? এ শুধু কাজের নামে, উন্নয়নের নামে, নতুন ধারার নামে হুজুগে বাঙালিকে মাতিয়ে রাখা।,এটা প্রথমে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বিনা পারিশ্রমিকে কেউ কাজ করছে না, তখন কাজের বিনিময়ে খাদ্য এবং অন্যান্য সূত্র থেকে এই কর্মসূচীর অর্থ যোগান দেয়া হয়। এসব টাকা পয়সার সিংভাগ চলে যায় বিএনপির কর্মীদের পকেটে। খাল খনন অসমাপ্ত ভাবে পড়ে থাকে। অথচ এই কর্মসূচিতে সরকারকে কোটি কোটি টাকা গচ্ছা দিতে হয়। নষ্ট হয় মানুষের স্বতস্ফূর্ত শ্রম।
৫। দেশের যুবকদের তিনি টাকা দিয়ে কিনেছিলেন যুব কমপ্লেক্সের নামে। কারণ বিরোধী দলকে শায়েস্তা করতে, নির্বাচনে তার দলের হয়ে কাজ করতে এই সব যুবকদেরই প্রয়োজন। মাত্র তিন বছরে বাংলাদেশে তিন হাজার ছয় শ সত্তরটি যুব কমপ্লেক্স করা হয়। এই যুব কমপ্লেক্সের আয়ের উৎস ছিল দেশের হাট বাজার ও মেলা থেকে আদায়কৃত টাকা। ১৯৭৯ -- ৮০, ৮০-৮১ এই দুই অর্থ বছরে বাজার ও মেলা থেকে আয় হয়েছিল বার কোটি চুয়াত্তর লক্ষ সাতাশি হাজার দুশত টাকা। এসব টাকা গেছে যুব কমপ্লেক্সের অন্তর্ভুক্ত সমবায় সমিতির পান্ডাদের পকেটে, জিয়া চোখ বন্ধ করে ছিলেন, কারণ ওরাই তো তার রাজনৈতিক সমর্থক। (এ্যান্টনিঃ বাংলাদেশঃ এ লিগেসি অব ব্লাড)
৬। গ্রাম সরকারের নামেও আর একটা দুর্নীতির আখড়া তৈরি হয়, গ্রাম সরকারদের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা নয় ছয় হয়। জিয়া কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন নি, কারণ তারা ছিল তার দলের স্তম্ভ।
৭। রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংক ও জীবনবীমা প্রতিষ্ঠানসমূহ বিরাষ্ট্রীয়করণের নামে জিয়া দেশি পুঁজিপতিদের দেশের ব্যাংক ও জীবন বীমার টাকা লুটপাটের সুযোগ করে দিলেন। এই বিরাষ্ট্রীয়করণের ফলে দেশের লাভজনক দশটি ব্যাংকও জলের দামে বিক্রি হয়ে যায়।
এ সম্পর্কে সাপ্তাহিক হলি ডে পত্রিকার মালিক সি আই এর এজেন্ট এনায়েতউল্লাহ খান জিয়াচক্রের সমর্থক হয়েও সমালোচনা করে বলেন, এই সিদ্ধান্ত হলো বাংলাদেশের মূল অর্থনীতির উপর সরাসরি আঘাত। জিয়া জনগণের অনুমোদন না নিয়েই এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। কেননা, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে তিনি তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে এ সম্পর্কে কোন কথা বলেন নি। ( ১৯৭৮,২৫ জুন সংখ্যা)
৮। বাণিজ্যিক ব্যাংক ও জীবনবীমা প্রতিষ্ঠানসমূহ বিরাষ্ট্রীয়করণ করায়, বিদেশি পূঁজিপতিদের নজর পড়ে বাংলাদেশের উপর। তারা মোটা অংকের টাকা কামানোর আশায় মোটা পুঁজি নিয়ে বিনিয়োগ করতে ছুটে আসে বাংলাদেশে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জিয়াউর রহমান একটি বেসরকারি বিমান কোম্পানি পচাত্তর শতাংশ শেয়ার কেনার জন্য সৌদি আরবের এক রাজপুত্রকে আমন্ত্রণ জানান। নতুন কোম্পানির নাম হয় এয়ার বাংলাদেশ লিমিটেড। এই চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল এই নতুন বিমান কোম্পানীর সাথে বাংলাদেশ বিমান কোন রকম প্রতিযোগিতায় নামতে পারবে না।
৯। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের যেসব সম্পত্তি জাতীয়করণ করেছিলেন তা জিয়া এসে তাদের ফিরিয়ে দেন। যাদের ফিরিয়ে দিতে পারেন নি তাদের ক্ষতিপূরণ দেন।
১০। ১৯৮০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সরকারি পরিসাংখ্যানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, মুজিব আমলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম যতটুকু এগিয়েছিল, জিয়ার আমল তার কাছাকাছিও যেতে পারে নি।
পশ্চিমা ভাষ্যকারদের মত সমর্থন করে ঐ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে,'বাংলাদেশ কঠিন অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য দিয়ে ঐ প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে,বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন দ্রুত কমতির দিকে।'
১১। পাকিস্তানের পাঁচজন নামকরা সাংবাদিক জিয়া হত্যার মাত্র মাস খানেক আগে বাংলাদেশে বেড়াতে এসে দেশের রাজনীতি আর দুর্নীতির এক করুণ চিত্র তুলে ধরেন।
মারকাস ফ্রান্ডা তার 'জিয়াউর রহমানঃ বাংলাদেশ' নামক সমীক্ষা গ্রন্থে বলেন, একটি ক্ষুদ্র নব্য ধনী শ্রেণীর হাতে বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্ত অর্থের নিয়ন্ত্রন চলে যাওয়ায় দেশে পরস্পর বিরোধী দুই ধরণের অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর ফলে, একদিকে ঢাকাকেন্দ্রিক একটি শ্রেণী দিন দিন উন্নত ও ধনবান হচ্ছে, অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলের অবস্থা খারাপ থেকে অধিকতর খারাপ হয়ে পড়ছে।'
১২। মুজিব আমলে দেশে দারিদ্র্য সীমার নিচে থাকা মানুষ ছিল মোট জনসংখ্যার ৮২.৫। আর তার মৃত্যুর পর মাত্র চার বছরে এর সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৬ শতাংশে।
১৩। ভূমিহীনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বেকারের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। ফলে মানুষ কাজের সন্ধানে গ্রাম থেকে উন্মূল ও উদ্বাত্তু হয়ে ঢাকা শহরে এসে বস্তীবাসীতে পরিণত হয়।
১৪। জিয়ার পুঁজিবাদী অর্থনীতির ফলে ৭৫ সালে যেখানে ছিল একজন কোটিপতি (জহিরুল ইসলাম), জিয়ার আমলে তার সংখ্যা দাঁড়ালো ৬২জন এ। (বাংলাদেশ ব্যাংকের তথানুযায়ী)। ঢাকা শহরের রাস্তা ভরে গেলো সুন্দর সুন্দর জাপানি প্রাইভেট গাড়িতে। দোকানে দোকানে শোভা পেল বিদেশি সিগারেট, ঘড়ি।
১৫। জিয়া স্বনির্ভরতার নামে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে উলসি প্রকল্প গ্রহণ করে বলেন, এ রকমের ৬৫ হাজার উলসি গড়ে তুলতে পারলেই বাংলাদেশ স্বনির্ভর হতে পারবে। কিন্তু ৬৫ হাজার গ্রামের প্রতিটি গ্রামে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করার মত বাংলাদেশে টাকাই ছিল না। এটা ছিল নিতান্তই মানুষের মন ভুলানো শ্লোগান ( মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর)
১৬। বাংলাদেশের অর্থদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, 'প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একটা প্রজন্মকেই দূর্নীতিগ্রস্থ করে তুলেছেন। এটা করেছেন তিনি বিভিন্ন পন্থায়। গ্রাম্য যুবকদের একাংশ তিনি হাট বাজারের ইজারার অধিকার দিয়ে দলীয় ক্যাডারে পরিণত করেন। অন্যদিকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মেধাবী ছাত্রদের সংবর্ধনার নামে ছাত্রদের কাছে তেনে নেন। কারণ, এর আগে ঢাকা ভার্সিটিতে তাকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। এমন কি নানা কৌশল করেও ছাত্রদের কাছে টানতে পারেন নি। এর প্রতিশোধ হিসেবে জিয়া ছাত্রদের নিয়ে এম ভি হিজবুল বাহার নামক এক বিলাসবহুল জাহাজে প্রমোদ ভ্রমণে যাত্রা করেন। সেখানে তাদের উদ্দেশ্যে সুন্দর সুন্দর কথা বলে তাদের প্রলুব্ধ করেন। এভাবেই জিয়া মেধাবী ছাত্রদের রাজনীতির পঙ্কিল পথে টেনে আনেন। এর ফলেই সৃষ্টি হয় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। এই সব মেধাবী ছাত্ররা লেখাপড়া ভুলে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে টেন্ডারবাজি, তদবিরবাজি, হলের সিট ভাড়া ইত্যাদি বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হয়। দেশ স্বাধীনের পর, পাকিস্তানী কোলাবরেটর গমিরুদ্দিনের পুত্র সর্হারা পার্টির সদস্য শফিউল আলম প্রধান ছাত্র লীগের অন্তর্ভুক্ত হয়ে ছাত্রলীগের ভাঙ্গন ধরানো ও বঙ্গবন্ধুর শাসনামলকে কলংকিত করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত খুনের লোমহর্ষক ঘটনা ঘটালেও, ছাত্র রাজনীতিতে অপকর্ম সীমিত ছিল। কিন্তু জিয়া প্রমোদ ভ্রমণের মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্মদের দূর্নীতি পরায়ন করে জাতির যে ক্ষতি করেছেন তার কোন পরিমাপ নাই।
১৭। জিয়া ব্যক্তিগত জীবনে দূর্নীতি করেন নি সত্য। কিন্তু দূর্নীতিকে জাতীয় চারিত্র্যে পরিণত করেছেন। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে যে দূর্নীতি বঙ্গবন্ধুর জীবনকে অতিষ্ট করে তুলেছিল, যার জন্য তিনি ক্ষোভে আক্রোশে দূর্নীতিবাজদের চোর আর চাটার দল বলে আখ্যায়িত করেছেন, জিয়া সেই দূর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দিয়ে দূর্নীতিকে স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে মওদুদ আহমদ তার গ্রন্থে লিখেছেন," জিয়া রাজনৈতিক দূর্নীতি ছাড়াও অন্য কিছু দূর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন।" সম্ভবত পরে তাদের ভয় দেখিয়ে অনুগত রাখার জন্য। কারণ, তার ইচ্ছা ছিল ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা।

বাংলাদেশের মুল চারটি স্তম্ভ ঃ- গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ,ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র,-- জিয়া সুপরিকল্পিত ভাবে এগুলোর মূলে কুঠারাঘাত করেছেন।

জিয়া অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা লাভ করে, অকার্যকর রাবার স্ট্যাম্পরূপী সংসদ আর তার উপর ফৌজি সরকার চাপিয়ে দিয়ে প্রথমেই ধ্বংস করেন সংবিধানের প্রথম স্তম্ভ গণতন্ত্র।

সংবিধানের দ্বিতীয় স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষতা স্তম্ভ ধ্বংস করেন কলমের এক খোঁচায়। মুক্তিযোদ্ধা জিয়া জানতেন, মুক্তিযুদ্ধে মুসলমান-অমুসলমান সবাই নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করেছিল। ৪৭ এর পর থেকে এদেশে হিন্দু সম্প্রদায় যত নির্যাতিত হয়েছে তা অবর্ণনীয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গণহত্যা চলে, তাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যাই অধিক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অন্তত তাদের একটু স্বস্থি পাওয়ার কথা ছিল। তা হয়নি। এ দেশটি তাদের হয়নি। জিয়া সংবিধানে 'পরম করুণাময় আল্লাহয় পূর্ণ বিশ্বাস রেখে' সংযুক্ত করে অমুসলিমদের এদেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করেন। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে তো ধর্মহীনতা নয়, ধর্ম তো আর কলমের খোঁচায় টিকে না, ধর্ম টিকে থাকে কর্মে।

এরপর জিয়া বাঙালিকে বাংলাদেশিতে পরিণত করে ধ্বংস করেন সংবিধানের তৃতীয় স্তম্ভ জাতীয়তাবাদ। বাঙালি জাতীয়তাবাদের দাবীতেই এ দেশ স্বাধীন হয়। এ জাতীয়তাবাদ বাঙালির বাংলাভাষা ভিত্তিক। জিয়াউর রহমান নিজেই লিখেছেন সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকায়,' পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীতে মিঃ জিন্নাহ যেদিন ঘোষণা করলেন উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, আমার মতে, ঠিক সেদিনই বাঙালি হৃদয়ে অঙ্কুরিত হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ, জন্ম হয়েছিল বাঙালি জাতির'এ কথা বলার ১৭ মাস পরে ক্ষমতা লাভ করে তিনি সেই জাতীয়তাবাদকে হত্যা করে প্রবর্তন করেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এতে জাতি সুসংহত না হয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। জিয়ার প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানী দালাল শাহ আজিজুর রহমান জাতীয় সংসদে বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশি ভাষা বলে উলেখ করেন। শুধু তাই নয় জিয়া ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের পতাকা পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। ১৬ ডিসেম্বরে সরকারি ভবনে যেসব পতাকা উড়ানো হয়, তার পটভুমি সবুজ থাকলেও লাল বৃত্তটি হয় কমলা। ঐদিন বাংলাদেশ টিভির এক অনুষ্ঠানেও ঐ বৃত্তের কমলা রঙের কথা উল্লেখ করা হয়। প্রতিবাদের মুখে শাহ আজিজের বাংলাদেশি ভাষা আর জিয়ার কমলা রঙ বর্জিত হয়।
জিয়া জাতীয় সঙ্গীতও পরিবর্তন করতে চেষ্টা করেন স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির চাপে। কারণ ওটা সহরোওয়ার্দীর প্রিয় গান। এ জন্যই বঙ্গবন্ধু এই গানটাকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর অবদান মুছে ফেলার জন্য ধুঁয়া তোলা হয় ওটা এক হিন্দুর রচিত গান। তাই তিনি রচনা করলেন, প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ। তার আমলে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এ গানই সমধিক প্রচারিত হয়।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর মুজিব সরকার যে সংবিধান গ্রহণ করেন তার ৫৫ ধারায় সুস্পষ্ট লেখা আছে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে উদযাপিত হবে। জিয়া সংবিধানের সুস্পষ্ট নির্দেশ অমান্য করে বাংলাদেশের বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বরকে স্বাধীনতা দিবসরূপে চালু করার চেষ্টা করেন। তিনি চেয়েছিলেন ২৬ মার্চকে জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করতে।

বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিকরা তাকে পিঠে, ঘাড়ে চড়িয়ে ক্ষমতায় বসালেও তিনি সমাজতন্ত্রের দিকে এক পা-ও অগ্রসর হননি। বরং তাদের কাউকে তিনি ফাঁসি দেন, কাউকে দেন দীর্ঘমেয়াদি কারাদন্ড। বঙ্গবন্ধুর আমলের অনেক রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক, বীমা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বিরাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে সংবিধানের সমাজতন্ত্র স্তম্ভটি ধ্বংস করে জিয়া প্রকৃতপ্রস্তাবে বাংলাদেশকেই ধ্বংস করে দেন।

সাধারণ মানুষ গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ,সমাজতন্ত্র বুঝে না। তাই মুক্তিযোদ্ধা জিয়া যখন এগুলো সমূলে উৎপাটন করলো তাতে তাদের কিছু আসে গেল না। বরং তারা দেখলো, সংবিধানে বিসমিল্লাহ সংযুক্ত হয়েছে, জিন্দাবাদ উচ্চারিত হচ্ছে তারা স্বস্থি পেলো এই ভেবে যে, যাক ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ছাত্রদের নিয়ে খেলাধূলা শুরু করলো, পুরস্কার দিল, জাহাজে চড়ে আমোদ প্রমোদ করলো, টাকা কামানোর উৎসের সন্ধান দিল, ছাত্ররা খুশি। গ্রাম্য যুবকদের হাট বাজারের ইজারাদারী দিল, কড়কড়ে নোট বিনা পরিশ্রমে হাতে পেয়ে তারা খুশি। দূর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেলো, দূর্নীতিবাজরা খুশি। দলবল নিয়ে খাল কাটলো, জনগণ খুশি। জিয়া তো আর বঙ্গবন্ধু নন, যে যা চাইবো তা-ই দিতে হবে! উনি ইচ্ছে করে দেয়ার নামে যা দেন তাতেই খুশি। খুশি আরো এই কারণে যে, জিয়া মুক্তিযোদ্ধা, জিয়া স্বাধীনতার তথাকথিত পাঠক, সবাই শুনেছে তার কণ্ঠ, তিনি কী আর মানুষের, জাতির অকল্যাণ করতে পারেন ?
জিয়া সব চেয়ে ক্ষতি করেন সাম্প্রদায়িক চেতনা এবং পাকিস্তানিজমকে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করে। বাঙালির মননে সাম্প্রদায়িক চেতনা আর পাকিস্তানিজমের ইতিহাস অনেক লম্বা কাহিনির অন্তর্ভুক্ত। এর জন্য চাই পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। সময়ের স্বল্পতার জন্য আমি এখানে সারসংক্ষেপ করছি।
বাঙালি জাতিতে শংকর, ধর্মে শংকর, সংস্কৃতিতে শংকর, চেতনায় শংকর। কৌম মানসিকতার কারণে তারা রাজনৈতিকভাবেও শংকর। কোম আর গোত্র এক কথা নয়। কৌম সমাজে তাদের কিছু আচার,বিশ্বাস বা টোটেম আছে, যা দিয়ে তারা পরিচালিত হয়। যেমন বর্তমানে বাংলাদেশের চাকমা গারো ইত্যাদি সম্প্রদায় তারা ধর্মীয় দিক থেকে বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান যা-ই হোক না কেন, তাদের নিজ নিজ সমাজ পরিচালিত হয় তাদের নিজস্ব স্বাতন্ত্রিক ধারায়। প্রাগৈতিহাসিক কালে ভূপ্রকৃতির কারণে বাংলাদেশের এক একটা জনবসতি ছিল দূর্গম ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আবার কৌম সমাজ ব্যবস্থার কারণে পড়শির সাথেও তাদের মেলামেশা ছিল না। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই এদের মধ্যে একটা বিচ্ছিন্নতাবোধ গড়ে উঠে। তা ছাড়া আজ যা বাংলাদেশ সে সময় তা সামগ্রিক অর্থে ছিল না। এটা একটা অঞ্চল মাত্র। গাঙ্গেয় উপত্যকার এ ভুখন্ড অঙ্গ, বঙ্গ সুহ্ম,রাঢ়, পুন্ড্র, হরিকেল ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল। এসব অঞ্চল কখনোই এক শাসকের অধীনে দীর্ঘদিন শাসিত হয়নি বলে বাঙালি মননে সামগ্রিক জাতীয়তাবোধ গড়ে উঠেনি। পাল আমলেও সমগ্র বঙ্গ তাদের অধীনে ছিল না। ফলে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাবের উপর পাকিস্তানী রাজনীতির বিভক্তিকরণ নীতি আরোপিত হয়।
ভারত উপমহাদেশে মুসলমান দুই ধরণের। এক ভারতীয় মুসলমান, দুই বাঙালি মুসলমান। এই ভারতীয় মুসলমানদের অনেকেই বহিরাগত এবং ভারতের অন্য প্রদেশের অধিবাসী। আর বাঙালি মুসলমানরা শতকরা ৯৮ ভাগ ধর্মান্তরিত। ভারতীয় মুসলমানরা সিরাজদ্দৌলার শাসনাবসানে মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় চলে আসে। আর ধর্মান্তরিত মুসলমানদের বেশির ভাগ মানুষই যেহেতু পূর্ববঙ্গের অধিবাসী গ্রামের প্রান্তিক জনগণ, তাই তাদের জন্মগতভাবে বসতি পূর্ববঙ্গেই। ভারতীয় মুসলিম লীগ এই ভারতীয় বুর্জোয়া মুসলমানদের তৈরি। পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগের শাখায় শেরে বাংলা, শেখ মুজিবের মত কিছু বঙ্গীয় মুসলমানদের পদচারণা ঘটে। পাকিস্তান আন্দোলনে পশ্চিম বঙ্গের মুসলমানদের অংশগ্রহণ ছিল বেশি। অথচ তারা ভাগ্যক্রমে ভারত অধিবাসী হয়ে যায়। এদের মধ্যে ছিটে ফোঁটা কিছু ভারতীয় মুসলমান পাকিস্তান হওয়ার পর পূর্ববঙ্গে চলে আসে।
যেহেতু পূর্ববঙ্গের মুসলমান ধর্মান্তরিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, তাই উচ্চবর্ণের হিন্দু এবং ভারতীয় মুসলমানরা এদের হেয় চোখে দেখে। সাম্প্রদায়িকতা শুধু হিন্দু মুসলমানে নয়, সাম্প্রদায়িকতা মুসলমানে মুসলমানেও। তারা আশরাফ আতরাফ নামে ভারতীয় ও পূর্ববঙ্গীয় মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদের রেখা টেনে দেয়।
পুর্ববঙ্গের মুসলমানদের মধ্যেও ভাগ আছে। ইরান থেকে ভারতে আগত কিছু সুফি দরবেশ সিলেট এবং চট্রগ্রামে আসেন। চট্রগ্রাম সমুদ্র বন্দর হওয়াতে আরব থেকে কিছু ব্যবসায়ী আসেন। এভাবে কিছু আরবীয় এবং সুফী দরবেশদের প্রভাবে প্রভাবিত সিলেট চট্রগ্রাম এবং তদসংলগ্ন কুমিল্লার অধিকাংশ মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের প্রতি দূর্বলতা থাকলেও তা বাঙালি হিসেবে মুক্তমানের না হয়ে এক ধরণের বদ্ধ মানসিকতা তৈরি করে। এই বদ্ধ মানসিকতা তৈরি হয় নদীভাঙ্গন এলাকার জনগণের মধ্যেও। তার মধ্যে নোয়াখালি অন্যতম। এদিক থেকে পুর্ববঙ্গের মুসলমানরা অনেকটাই মানসিকভাবে সেক্যুলার। কারণ উর্বর জমিতে ফসল ফলাতে তাদের খুব বেশি ভাগ্যান্বেষী হতে হয়নি। ভাগ্যান্বেষী মানুষই দায়বদ্ধ থাকে। এগুলো হল বাংলাদেশের মুসলমানদের মানসিক বিভাজনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপ দিক।
বৃটিশ আমলে বৃটিশদের দমন নীতি আর নিজেদের ভুল পদক্ষেপের কারণে ভারতীয় মুসলমানরা শিক্ষা-দীক্ষা,আয় রোজগার থেকে পিছিয়ে পড়েঅন্যদিকে ইংরেজদের আনুকুল্যে অর্থনৈতিক ও শিক্ষা দীক্ষার দিক থেকে হিন্দু সম্প্রদায় অনেক এগিয়ে যায়। এর ফলে এই দুই সম্প্রদায়ের মননে, চেতনায় দূরত্বের সৃষ্টি হয়। বৃটিশরাও ডিভাইড এ্যান্ড রোল প্রয়োগ করে এটাকে কাজে লাগায়। ফলে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান জন্ম লাভ করে। পৃথিবীতে একমাত্র পাকিস্তানই ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র। ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান হওয়াতে বাঙালি জনগণের এক অংশের কাছে ইসলাম ধর্ম আর পাকিস্তান সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়।
এর কারণ আছে। জাতপাতকেন্দ্রিক ও বর্ণাশ্রমভিত্তিক হিন্দু সমাজব্যবস্থার চূঁড়ায় ছিল অকর্মণ্য অথচ ভোগী বাঙালি ব্রাহ্মণ্য সমাজ। তারা বাঙালি প্রান্তিক হিন্দু জনগোষ্ঠীকে শোষণ করার মানসে তাদের অবজ্ঞা ও ঘৃণা করে মেরুদন্ডহীন ও হীনম্মন্য করে তোলে। পরবর্তীতে এদেরই একটা বৃহৎ অংশ মুসলমান হয়। এরা প্রান্তিক হিন্দু থেকে মুসলমান নামক যবন হওয়াতে উচ্চবর্ণের হিন্দুদ্বারা আরো নিগৃহীত উপেক্ষিত হয়। ভারতীয় মুসলমান আর ভারতীয় হিন্দুদের পাস্পরিক দ্বন্দ্বের প্রভাব পুর্ববঙ্গের একশ্রেণীর মুসলমানদের উপরেও পড়ে। গ্রামের হিন্দু মুসলমান এসব বিবাদে ছিল না। কারণ তারা উভয়ই নিপীড়িত ও বঞ্চিত ছিল। পাকিস্তানী শাসকরা জাতীয় পর্যায়ের এই ভারতীয় হিন্দু মুসলমানের দ্বন্দ্বকে বাংলাদেশে ভারতবিদ্বেষী রাজনীতিতে পরিণত করে।
বাংলাদেশের ধর্মান্তরিত মুসলমান অশিক্ষিত হওয়ায় ইসলাম সম্পর্কে এদের ধারণা নাই বললেই চলে। কারণ ইসলামের বাণী কোরান ও শরিয়তের কথা সবই আরবি ভাষায় রচিত।
ফলে রাজনৈতিকভাবে ইসলামকে ব্যবহৃত করে সহজেই এদেরকে বিভ্রান্ত করা গেছে এবং আজো যাচ্ছে। ইসলামের জেহাদ এর অর্থ বিকৃত করে, বিধর্মীদের উপর অত্যাচার জায়েজ করে তাদের কায়েমি স্বার্থবাদীরা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করছে। অথচ মানুষ জানে না যে, নবীজী কি আদেশ দিয়ে গেছেন। নবীজী বলেছেন, নিজের মত ও ধর্মকে কারো উপর জোর করে চাপিয়ে দিও না। কারণ, এই প্রবণতা পৃথিবীতে অনেক রক্তপাট ঘটিয়েছে, অনেক সভ্যতা ধ্বংস করেছে। তারা জানে না, পবিত্র কোরানে পড়শি আর অন্য ধর্মাবমম্বীদের সাথে কেমন সুসম্পর্ক স্থাপনের কথা বলা আছে।

নিজেরা কিছু জানে না বলে পূর্ববঙ্গে মুসলিম সমাজব্যবস্থায় মোল্লাতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। কারো মৃত্যুতে, বিপদে আপদে মোল্লা ডেকে এনে ঘটা করে দোয়া পড়ানো, মানত করা, মাজার পূজা, পীরের দরগায় শিরনি দেয়া এসবই পরমুখাপেক্ষী লৌকিক ধর্ম। ইসলাম ধর্মে এসবের স্থান নেই। ইসলাম কর্মবাদী ধর্ম, পরমুখাপেক্ষী নয়। পরের উপর নির্ভরশীলতা মানে নিজের উপর আস্থা হারানো, বিশ্বাস হারানো। আস্থাহীন, আত্মবিশ্বাসহীন বাঙালির মুসলিম চেতনায় পাকিস্তানীদের ইসলাম ভীতির রাজনীতির ফলন তাই সার্থকভাবেই ফলিত হয়েছে।
ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির এক অংশের হিন্দুবিদ্বেষ পাকিস্তানবিদ্বেষে পরিণত হয়। ফলে হিন্দু-মুসলিম বিরোধ কিছুটা হলেও কমে যায়।
তবে জনমনে তখনো দেশের স্বাধীনতা কী জিনিস তা দানা বাঁধে নি। এজন্য তারা স্বাধীনতার প্রয়োজনও মনে করে নি। কারণ শোষণ কী জিনিস তা সাধারণ জনগণ বুঝে নি। এটা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী আর রাজনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
গ্রামীন সমাজ ব্যবস্থা সামন্তভিত্তিক ছিল না, কৃষিভিত্তিক ছিল। এখানে ধনী কৃষক আর গরীব দিনমজুরের শোষণের সম্পর্ক ছিল না। মালিক ভৃত্যের সম্পর্ক ছিল না। এ সম্পর্ক অনেকটা মানবিক। বহু ধনী কৃষক অভাবের দিনে গরীব মানুষকে সাধ্যমত সাহায্য করতো।
৭০ দশকে শহরের তুলনায় গ্রামে বসবাসকারী জনসংখ্যা বেশি ছিল। এরা রাজনীতি সচেতন ছিল না। গ্রাম আর শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রাজনৈতিক দাবী স্বাধীকার বা স্বাধীনতার মানে বুঝা এদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ এটা বুঝার জন্য চেতনার যে স্তরে স্বাধীনতাকামী বোধ জন্ম গ্রহণ করে, সাধারণ মানুষের সে স্তরে যাবার মত পরিবেশ সৃষ্টি হয় নি। মানুষের দারিদ্র্য থাকলেও তাতে তারা অভ্যস্থ ছিল। যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত জনগণ তা নিয়তি হিসেবেই মেনে নিয়েছিল।
তাই, জিডিপির বৃদ্ধি বা হ্রাস, মৌলিক অধিকার,গণতন্ত্র, সমানুপাতিক আসন, বৈদেশিক নীতি, বাণিজ্য নীতি, রাষ্ট্রভাষা উর্দু কী বাংলা হবে অথবা রোমান হরফে বাংলা লেখা -- এসবের সাথে জনগণের সংশ্রব ছিল না। এখনো নেই।
এদেরকে কম টাকায় বেগুন কেনা থেকে শুরু করে চার আনায় চিনি খাওয়ানোসহ ধনীদের জমি কেড়ে নিয়ে তাদের মধ্যে বিলি করা হবে বলে লোভ দেখানো হয়। এই কাজটা শুরু করেছিল ভাসানীসহ বামপন্থীর রাজনৈতিক কর্মীরা। গণ আন্দোলনের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুও বলেন, সোনার বাংলা শ্মশান কেনো ?
যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব রূপটি জনগণ বুঝতে পারেনি, তাদের বোঝানোও হয় নি। তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই সোনার বাংলায় চকিতে দুধের নহর বইতে না দেখে মানুষ বঙ্গবন্ধুর উপর নাখোশ হয়। তারা মনে করতো বঙ্গবন্ধু মানেই সব সমস্যার সমাধান। তারও যে সীমাবদ্ধতা আছে এ কথা কেউ বুঝতে চায় নি। বরং তিনি কেনো আলাদীনের চেরাগ হলেন না এটাই তার বড় ত্রুটি হয়ে দেখা দিল। এই বিপর্যয়ের সন্ধিক্ষণে বঙ্গবন্ধু্র পাশে এসে কেউ দাঁড়ায়ও নি, বরং তার সীমাবদ্ধতাকে পূঁজি করে প্রতিক্রিয়াশীলরা রাজনীতি করেছে। অন্যরা আত্মসিদ্ধি চরিতার্থে ব্যস্ত ছিল। লুটপাট আর দূর্নীতিতে দেশ জর্জরিত হয়। ন্যায়বোধ নয় বরং মহানুভবতা দিয়ে দেশ চালাতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বিপদগ্রস্থ হলেন।
যে ভাসানী পাকিস্তান আমলে বলতেন, পচা বাইগন (বেগুন) কে খায় ? কিন্তু তাও এখন সের দরে কিনতে হয়, সে-ই ভাসানী জাতির ক্রান্তি লগ্নে মানুষের কল্যাণে এগিয়ে না এসে তিনি স্বাধীনতা বিরোধীদের দ্বারা ব্যবহৃত হলেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কখনোই একমতে স্থির থাকতে পারেন নি। তিনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে ভিয়েতনাম বানাতে চাইলেন, দায়িত্ব নিয়ে গড়তে চাইলেন না। ভিমরোলের মত, ছত্রভঙ্গ মৌমাছির মত চারদিক থেকে বঙ্গবন্ধুকে সবাই হুল ফোটাতে থাকলো। পর পর দু বছর প্রচন্ড বন্যা, অনাবৃষ্টি, প্রাকৃতিক দূর্যোগ,দেশি ও বিদেশি চক্রান্তের ফলে খাদ্যাভাব দেখা দিল। রাশিয়া যা সাহায্য পাঠালো তা প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য। পাকিস্তান আগেই মুসলিম দেশগুলোকে জানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশে হিন্দু শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। শেখ মুজিব একজন হিন্দু। তারা চুপ। মার্কিন খাদ্যশস্য সরবরাহকারী কোম্পানীগুলি বাংলাদেশে পৌছানোর জন্য স্থিরীকৃত দুটো বড় চালানের বিক্রয় হঠাৎই বাতিল করে দেয়। বাতিলের কারণ, বাংলাদেশ কিউবা নামক সমাজতান্ত্রিক দেশে পাট বিক্রয় করেছে। যদিও ওই একই সময়ে মিশর কিউবায় তুলা রপ্তানী করেছিল, তারপরও মিশরকে আমেরিকা সাহায্য করতে কুণ্ঠিত হয় নি। দূর্ভিক্ষ নিয়ে দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীলরা রাজনীতি করলো, কিন্তু মানবতার সেবায় বঙ্গবন্ধুর পাশে এসে কেউ দাঁড়ালো না।
বঙ্গবন্ধুর একটা শ্রেণীগত অবস্থান ছিল। (তেমন সবারই আছে। মানুষ শ্রেণীর উর্ধ্বে নয়। সেদিনের হত্যাকারীদেরও একটা শ্রেণী ছিল, তা হলো তারা হত্যাকারী শ্রেণী)। তার রাষ্ট্রনৈতিক পদ, দায়িত্ব এবং ক্ষমতা ছিল। তার কর্মকাণ্ডে, চিন্তা ভাবনায়, পদক্ষেপের বাস্তবতা অবাস্তবতায়, চিন্তার গভীরতা অগভীরতায়, সমস্যা মোকাবেলায় পারদর্শিতা অপারদর্শিতায় সীমাবদ্ধতা নিশ্চয়ই প্রকাশ পেয়েছে। তার আদর্শের সাথে অন্যদের দ্বিমত থাকতেই পারে, বিতর্ক থাকতেই পারে। বিপরীত মতালম্বীদের কাজ ছিল, তাদের যুক্তির জোর দিয়ে কর্মের ব্যাপকতা ও গভীরতা দিয়ে সেই মতকে পরিবর্তিত করে নিজেদের মতের দিকে নিয়ে আসা। অবশ্যই এটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার। কিন্তু খুনীরা সে পথে গেলো না। কারণ, এখানে ব্যক্তি মুখ্য নয়, মুখ্য হলো আর্দশ। একটা আদর্শকে হত্যা করে নিজেদের ক্ষমতা লোভের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাই এত ধৈর্য্যধারণের সময় ওদের নেই।
যাই হোক, বিদ্যমান অবস্থায় অসহায় মানুষ সঙ্গত কারণেই ভাবলো, পাকিস্তান আমলই ভালো ছিল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর জিয়া এই পাকিস্তানিজমকে সুকৌশলে কাজে লাগালেন।
জিয়া আর একটা বিষয় কৌশলে কাজে লাগালেন তা হলো মানুষের দেশপ্রেমের অভাব এবং সাম্প্রদায়িকতা।
৪৭ সনে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী সুপরিকল্পিত ভাবে উপুর্যপরি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে, সন্ত্রাসী তান্ডব চালিয়েও যেহেতু বঙ্গীয় হিন্দুদের কাঙ্খিত পরিমানে তাড়াতে পারলো না, তখন তাদের উদ্বাস্তু করার একটা নীল নকশা প্রণয়ন করে। ১৯৬৫ সনে পাক-ভারত যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান ভারতকে শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। তারই প্রেক্ষিতে রচিত হলো শত্রু সম্পত্তি আইন। অর্থাৎ বাংলাদেশের যে সব হিন্দুদের সম্পদ শত্রুরাষ্ট্র ভারতে থাকবে বা আছে তাদের বাংলাদেশের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি আইনের আওতায় বাজেয়াপ্ত করা হবে। হিন্দু সম্প্রদায় পড়লো মহাবিপদে। এদেশে তাদের জান মালের বিন্দুমাত্র নিরাপত্তা নেই, আবার অর্জিত সম্পদ নিরাপদেও রাখা যাবে না। (এখন সব লুটেরাদেরই বিদেশে বাড়ি আছে, তাদের গচ্ছিত টাকা পয়সার বৌদলতে অনেক দেশ ঝলমল করছে। এর জন্য কোন আইনের দরকার নেই)। এর ফলে হিন্দু সম্প্রদায় মানসিকভাবে উন্মূল হয়ে পড়ে। এদেশে জন্ম গ্রহণ করেও তারা এদেশের দাবীদার নয়। অতএব, নিরাপত্তার কারণেই ভারতের প্রতি তাদের মনোযোগ বেড়ে যায়, ফলে কমে যায় নিজ দেশের প্রতি মমত্ববোধ। অন্যদিকে বাঙালি মুসলমানরা মনে করলো বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি, বাঙালিত্ব এগুলো হিন্দুদের, এগুলো হিন্দুয়ানী। এতদিন তারা হিন্দুস্তানে ছিল বলে হিন্দুদের কাছ থেকে এ গুলো তারা শিখেছে। এখন মুসলমান হিসেবে পাকিস্তান তাদের নিজের দেশ। এই যে, পাকিস্তান তাদের নিজের দেশ, এই বোধের মধ্যে যে গভীরতা আছে, বাঙালি বা বাংলাদেশি হওয়ার মধ্যে তা নেই। এটাই পাকিস্তানিজম। এ জন্য অনেকেই পাকিস্তান ও বাংলাদেশের যুদ্ধটা ভাইয়ে ভাইয়ের গন্ডগোল মনে করে ভালো চোখে দেখে নি। বেশির ভাগ মানুষ এখনো মুক্তিযুদ্ধকে গন্ডগোলের বছর বলে অভিহিত করে।
বাংলাদেশ নামক একটি দেশে বাস করলেও একশ্রেণী্র মানুষ ভালবাসার অধিকারই পেলো না, আর একশ্রেণীর মানুষ ভালবাসতে পারলো না। এই দুই শ্রেণীর মানুষই বাস করল বাংলাদেশে, খেলো, নিলো বাংলাদেশের, কিন্তু বুকে ঝুলিয়ে রাখলো অন্য দেশের লকেট। এমন পরকীয়া জাতি পৃথিবীর অন্য কোথাও আছে? হতভাগ্য বাংলাদেশ !!
জন মানসের এই দেশ প্রেমের অভাবজনিত শূন্যতাই দেশপ্রেমিক বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর কারণ, অন্যদিকে এটাই জিয়াকে একটা প্লাটফর্মে দাঁড়ানোর অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে জিয়া ও প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলো বঙ্গবন্ধুকে ভারতের দালাল, ষড়যন্ত্রকারী, ইসলামের শত্রু নামে আখ্যায়িত করে জনগণের একাংশের সমর্থন পেয়েছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে, এ যুদ্ধে তাদের হাজার হাজার সৈন্য মারা গেছে, এটা মানুষের কাছে বড় হয়ে দেখা দিল না, বড় হয়ে দেখা দিল, ভারতীয় সৈন্যরা অনেক জিনিস লুটপাট করে নিয়ে গেছে। অসাধু বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা এবং চোরা কারবারীরাই যে ভারতে পাট থেকে শুরু করে অনেক কিছু পাচার করছে, এর জন্য এরা দোষী সাব্যস্ত হলো না, দোষী হল ভারত আর বঙ্গবন্ধু।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের 'ভারত-বাংলা শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা' নামের ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তিকে জিয়া এবং তার সহযোগী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী নাম দিল গোলামির গোপন চুক্তি। অথচ আন্তর্জাতিকভাবে প্বার্শবর্তী দুটো দেশ পারস্পরিক স্বার্থ সংরক্ষণে চুক্তি করতেই পারে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়ার সমর্থন আদায়ের জন্য ভারত-রাশিয়াও ২৪ বছরের চুক্তি করেছিল। ভারত-বাংলাদেশের চুক্তি তো প্রকাশ্যই। গোপন কোথায় ? উভয় সরকারের পক্ষ থেকেই চুক্তির বিশদ বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। তারা তো আর আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে এটা আবিস্কার করে নি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ওরা ক্ষমতা ভোগ দখল করেছে, ভারত বিরোধী শ্লোগান দিয়েছে, কিন্তু চুক্তি বাতিল করে নি। এ চুক্তি মেয়াদান্তে আপনা আপনি বাতিল হয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি আর পরাজিত শক্তি এ গুলোকে কাজে লাগিয়ে, কুৎসা রটিয়ে জনমনে ভারতবিদ্বেষী মনোভাবকে বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষী মনোভাবে পরিণত করে।

নিজেকে ভারত বিদ্বেষী প্রমাণ করলে জনগণ খুশি হবে, এ জন্য জিয়া দক্ষিণ তালপট্টিতে ভারতের বিরুদ্ধে তিনটি গানবোট পাঠিয়ে দেন। ভারত সেখানে নৌবাহিনির জাহাজ পাঠিয়ে দেয়। জিয়া এটাকে বাংলাদেশ আক্রমণের সামিল বলে ঘোষণা করে বলেন 'যে কোন মূল্যে বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্যদের হটিয়ে দেয়া হবে'জনগণ খুশি। অথচ তার সমর্থকরাও জানেন, এটা জিয়ার জনগণের মন রঞ্জিত করার কৌশল মাত্র। কেননা এই ঘটনার মাত্র কয়েক মাস আগে সরকার সমর্থক সাপ্তাহিক পত্রিকা ইত্তেহা্দের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ ও মুজিব কন্যার সাথে গোলমাল মিটিয়ে নেবার জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়াকে পরামর্শ দিয়েছেন। ইত্তেহাদের মতে, এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ দুটো শর্ত আরোপ করেছে। তা হলো বঙ্গবন্ধুকে সসম্মানে জাতির পিতা ঘোষণা করা, এবং বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন দিয়ে মুজিব হত্যার তদন্ত করানো ও মুজিব ঘাতকদের উপযুক্ত শাস্তি দান। ঐ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, "ইত্তেহাদ" বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়েছে যে, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আওয়ামী লীগের ঐ দুটো শর্তই মেনে নিতে সম্মত হয়েছেন।
জিয়া তো ঘটনার মধ্যে ঘটনা তৈরি করতে সিদ্ধ হস্ত। কী জানি, তিনি হয়ত ভাবতে পারেন, ভারতের চাপে ভারতীয় দালাল মুজিবের কন্যাকে দেশে ফিরিয়ে আনলে জনগণ তার নতজানু নীতিকে আবার কী জানি কী চোখে দেখে ! সে জন্যই হয়ত এই দক্ষিণ তালপট্টির নাটক।
যেদিন শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এলেন, সেদিন ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে দশ লাখ মানুষ তাকে সংবর্ধনা জানাতে বিমান বন্দরে গিয়েছিল। সব স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, ভাড়াটে নয়। জিয়া প্রমাদ গুনলেন। দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তার উপর চাপ সৃষ্টি করলো। শুরু হল দেশে গুপ্তহত্যা।
১৯৮১ সালের মে মাসে ঘটানো হল হত্যাকান্ড। জাতীয় শ্রমিক লীগ ( মিজান গোষ্ঠী) এর বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা আব্দুর রহমান ও বা স স এর সিনিয়র রিপোর্টার ফেরদৌস আলমকে ঢাকার কেন্দ্রীয় আইন কলেজের সামনে প্রকাশ্যে হত্যা করা হলো। অনেকেই বললেন এটা সরকারের সুপরিকল্পিত হত্যাকান্ড।

বঙ্গবন্ধুবিরোধী সকল শক্তিই জিয়ার ছত্রচ্ছায়ায় ছিল, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জনগণের সমর্থনও ছিল, মুসলিম দেশসহ দেশি বিদেশি যে চক্রগুলো বঙ্গবন্ধুকে বিপদগ্রস্থ করেছিল, তারাও তার হাতকে শক্তিশালী করেছিল, তারপরও কেনো তাকে উন্নয়নমূলক কাজ থেকে সরে দাঁড়াতে হলো ? জিয়াউর রহমান উন্নয়নের জন্য যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, তা বাস্তুবায়িত হলে দেশের জন্য সুফলই বয়ে আনতো, কিন্তু বাস্তুবায়ন হতে পারে নি বিদেশি প্রভুদের চাপে। কারণ, পরাশক্তি চায় না পরনির্ভরশীল দেশগুলো স্বনির্ভর হোক। তাই, যে পেন্টাগন তার পিছনে দাঁড়িয়ে ক্ষমতা লাভে সহযোগিতা করেছে, সে-ই পেন্টাগণের দেশ আমেরিকাকে তিনি চটাতে চান নি শুধু ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার লোভেই। শুধুই ক্ষমতার লোভে তিনি দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছিলেন। পক্ষান্তরে, বঙ্গবন্ধু এমন শক্তি অর্জন করতে পারলে,সবাই তাকে এমন সহায়তা দিলে তিনি কীই না করতে পারতেন! এখানেই খুঁজতে হবে সহায়হীন বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের আপেক্ষিক ব্যর্থতা।

এতো আয়োজন করে, ঘটা করে দেশের মানুষকে খুশি করেও, প্রভুদের খুশি করেও, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি, পরাজিত শক্তির বাহুবলে বলীয়ান হয়েও শেষ পর্যন্ত জিয়া আত্মরক্ষা করতে পারলেন না।
জিয়াউর রহমান সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন, দেশে আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে। তিনি জানান, এ ধরণের গুপ্ত হত্যার তদন্ত করা হয়েছে। রিপোর্ট এখনো প্রকাশ করা হয়নি। প্রশাসনকে আরো শক্তিশালী না করা পর্যন্ত, অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। তা নিতে সময় লাগবে'
বিএনপির কার্যনির্বাহী সভার অধিবেশনে জিয়া বলেন, উপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠীর কাছ থেকে আমরা যে সব আইন কানুন পেয়েছি, তা দিয়ে বিপ্লবকে সফল করা যাবে না। আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী আইন কানুন পাল্টাতে হবেআমরা সে পথেই চলেছি।
মৃত্যুর কয়েক মাস আগে আপদকালীন সময়ে হয়ত বঙ্গবন্ধুকে তার মনে পড়েছিল। সে জন্য তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদলে একটা বাকশালী বিপ্লবী পরিষদ গঠন করবেন। এ ব্যাপারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জাফরউল্লাহ জিয়া নিহত হওয়ার পর এক বিদেশি সাংবাদিককে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হওয়ার মাত্র মাস দেড়েক আগে তার সাথে আমার সাথে দেখা হয়। তখন তার সাথে আলোচনা করে বুঝেছিলাম, তিনি শিগগিরই কঠোর কোন ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছেন। (এ্যান্টনিঃ এ লিগেসি অব ব্লাড। পরেশচন্দ্র সাহাঃ বাংলাদেশঃ ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। টিভি সাক্ষাৎকারঃ ডাঃ জাফরুল্লাহ)

কিন্তু মৃত্যু জিয়ার এই কালো দিকটা মানুষকে দেখতে দিলো না।
তবে একটা কাজ জিয়া ভাল ভাবেই করে যেতে পেরেছেন, তাহলো, ইতিহাস বিকৃতি করে,বঙ্গবন্ধুর নামে ক্রমাগত বিরতিহীন অপপ্রচার চালিয়ে একটা প্রজন্মকে মুজিব বিদ্বেষী করে তার অবদানকে অস্বীকার করতে শিখিয়েছেন, ঘৃণা করতে শিখিয়েছেন। তারাও শিখেছে, কারণ তাদের সামনে অনুসরণযোগ্য কোন আদর্শ নেই বলে।
প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের কড়া সমালোচক গোলাম মুরশিদ তার বইতে লিখেছেন,
"
গত হাজার বছরে বঙ্গবন্ধুর চেয়ে প্রতিভাবান বাঙালি জন্মেছেন অনেকেই। কিন্তু তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মদাতা হিসেবে সর্বকালের ইতিহাসে একজন শ্রেষ্ঠ নেতা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি বাংলা মায়ের চিরকালের এক শ্রেষ্ঠ সন্তান। তার পরে যারা এসেছেন, গায়ের জোরে অথবা তথাকথিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, তারা তার তুলনায় খর্বকায় মাত্র। তার বাংলাদেশকে আদর্শচ্যুত করেছেন তারা। তা সত্ত্বেও বাঙালিরা একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে মাথা উঁচু করে আজও বিশ্ব সভায় দাঁড়িয়ে আছেন"। ( মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর)।

বঙ্গবন্ধুর এ অবদানের কথা বিশ্ববাসীও জানে। তাই তো সবাই তাকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে স্মরণ করে। সবার ভালবাসায় তিনিই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, আর কেউ নয়।
স্বাধীনতাত্তর দেশে জিয়ার এহেন আগ্রাসী ভূমিকা দেখে স্বাভাবিক ভাবেই একটা প্রশ্ন মনে জাগে, জিয়া কি তাহলে আসলেই কোনো অসত্ উদ্দেশ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ছিলেন ?
{
মেজর থেকে ডিক্টেটর -(কার্টেসি),কথা কবিতা}
সহায়ক গ্রন্থঃ
 
মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর/একটি নির্দলীয় ইতিহাস।
-----
গোলাম মুরশিদ ।
 
মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী সরকার
-----
মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি।
 
মুক্তিযুদ্ধে জয়দেবপুর
----
এ এস এম সামছুল আরেফিন।
 
বাংলাদেশঃ ষড়যন্ত্রের রাজনীতি
------
পরেশ সাহা।
 
বাংলাদেশের ইতিহাস
-------
ডঃ মোঃ মাহবুবুর রহমান।
 
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড,ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস
...........
অধ্যাপক আবু সাইয়িদঃ
কারাগারের ডায়েরিঃ
...............
কর্নেল (অব) শওকত আলী
তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথাঃ
............
লেঃ কর্নেল অবঃ এম এ হামিদ পি এসসি পৃঃ ৯৯
(
বিচিত্রা, সমসাময়িক সংবাপত্র, বিভিন্ন ডকুমেন্টস)




















তথ্য সংগৃহীত

1 টি মন্তব্য:

কামাল উদ্দিন বলেছেন...

লেখকের নামটি কি জানতে পারি?