সোমবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৪

জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মইনুল হোসেন






জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মইনুল হোসেন ১৯৫২ সালের ৫ মে মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ীর দামপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করে মইনুল হোসেন। তার বাবা মুজিবুল হক ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ইতিহাস পড়াতেন। ছেলেবেলায় মইনুল চেয়েছিলেন প্রকৌশল বিষয়ে পড়তে। ঢাকা তখন গণঅভ্যুত্থানে উত্তপ্ত। ওই সময় মইনুলকে ফরিদপুর থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়। ১৯৭০ সালে তিনি ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগে।




১৯৭১ সালে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়। মইনুল মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ীর দামপাড়া গ্রামে আশ্রয় নেন। খুব কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধকে অনুভব করেন তিনি। ১৬ ডিসেম্বরের পর ফিরে আসেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী ছাত্রাবাসে।
১৯৭৬ সালে মইনুল প্রথম শ্রেণীতে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক হন। ১৯৭৬ সালের এপ্রিল মাসে EAH Consultant Ltd-এ জুনিয়র স্থপতি হিসাবে যোগ দেন। কয়েক মাস পর চাকরি ছেড়ে ওই বছরের আগস্টে যোগ দেন বাংলাদেশ কনসালট্যান্ট লিমিটেড’-এ। তার কর্মজীবন বেশ বৈচিত্র্যময়।
সৈয়দ মইনুল হোসেন ছিলেন ঘুমিয়ে আছেন শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরেপ্রবাদবাক্যে রূপ পাওয়া এ কবিতার লেখক, বিশ্বনবীর রচয়িতা কবি গোলাম মোস্তফার নাতি ছেলে। এ কবির বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকুপার মনোহরপুর গ্রামে। বিটিভির নন্দিত শিশুতোষ অনুষ্ঠান নতুন কুঁড়ির থিম সং এর সুরকার ও গীতিকার ছিলেন গোলাম মোস্তফা।
কবি গোলাম মোস্তফার ছোট মেয়ে রাশিদা হকের ছেলে স্থপতি সৈয়দ মইনুল হোসেন। আর তাঁর মামা প্রখ্যাত শিল্পী, ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক একের ভেতর বহু গুণের অধিকারী মুস্তাফা মনোয়ার। আরেক মামা প্রখ্যাত স্কেচ শিল্পী মুস্তাফা আজিজ। যার শিল্পকর্ম জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে, গ্রামেও আছে চিত্রশালা, দুর্ভিক্ষকবলিত আর অনাহারী মানুষের মুখ দু এক টানেই তুলে আনতেন নিজের ক্যানভাসে। আনোয়ার হোসেন নামে তাঁর এক মামা ছিলেন পাইলট। খালা হাসনা, হেনা সহ অন্যরাও ছিলেন স্ব স্ব গুণের অধিকারী, ঢাকার মৌচাকে মনিমুকুর নামে গানের স্কুল রয়েছে। সৈয়দ মইনুলের খালাত বোন ফাহ্মিদা মজিদ মঞ্জুও কবি, আরেক বোন নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির লেকচারার, তিনিও কাজ করেন প্রতিবন্ধীদের নিয়ে। অর্থাৎ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বিভিন্ন প্রতিভার অধিকারী এই পরিবার।


 



১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের গণপূর্ত বিভাগ মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এরপর নকশা আহ্বান করা হয়। তখন ২৬ বছরের তরুণ স্থপতি মইনুল স্মৃতিসৌধের নকশা জমা দেন।

মোট ৫৭ জন প্রতিযোগী স্মৃতিসৌধের ডিজাইন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন এবং তার মধ্যে স্থপতি মইনুল হোসেনের ডিজাইনটি শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয়। নিচের মূল ভিত্তি থেকে ওপরের দিকে উঠে-যাওয়া সাতটি দেয়ালসদৃশ ত্রিকোণ কলাম। কলামগুলো বিভিন্ন উচ্চতার ও আলাদা-আলাদাভাবে পাশাপাশি ওপরের দিকে উঠে গেছে, যার সবচেয়ে উঁচু কলামটি ১৫০ ফুট। বিভিন্ন দিক থেকে এটি ভিন্ন ভিন্ন আকারে দৃশ্যমান হয়। সামনের দিক থেকে দেখলে মনে হবেযেন একক-শুভ্র এক শৈল্পিক স্থাপনা আকাশ স্পর্শ করার জন্য মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে গর্বিত ভঙ্গিমায়; সামনের লেকের পানিতে তার ছায়া এক অপূর্ব দৃশ্য তৈরি করেছে। আবার পাশ থেকে দেখলে মনে হয়, আকাশে ডানা মেলে-দেয়া একঝাঁক শুভ্র-বলাকা যেন! বিজয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত সমগ্র বাংলাদেশের প্রতিভূ জাতীয় স্মৃতিসৌধ।
১৯৭৬ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সৈয়দ মইনুল হোসেন ৩৮টি বড় বড় স্থাপনার নকশা করেন। এর মধ্যে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, IRDP ভবন কাওরানবাজার, ভোকেশনাল টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ভবন, চট্টগ্রাম ইপিজেড, বাংলাদেশ চামড়াজাত প্রযুক্তির কর্মশালা ভবন, উত্তরা মডেল টাউন, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার খাদ্য গুদামের নকশা, কফিল উদ্দিন প্লাজা, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস ভবন, ঢাকা শহরের বিভিন্ন বেসরকারি আবাসন প্রকল্পের নকশা করেছেন তিনি।
এরপর অবসর জীবনে চলে যান তিনি। অনেকটা নিভৃতে জীবনযাপন করছিলেন।
সোমবার বেলা আড়াইটার দিকে রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, মাইনুল হোসেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রোববার সেখানে ভর্তি হন। তাঁর ডায়াবেটিস ছিল মারাত্মক অনিয়ন্ত্রিত। রক্তচাপও ছিল খুব কম। প্রাথমিকভাবে তাঁর শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও ডায়াবেটিক ও বার্ধক্যজনিত কারণে সার্বিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। পরে ১০-১১-২০১৪ সোমবার দুপুরে তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর।









কোন মন্তব্য নেই: