শনিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৪

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৮৯২ থেকে ১৯৬৩







হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারে সেপ্টেম্বর ১৮৯২ সালে জন্ম গ্রহন করেন


 তিনি ছিলেন বিচারপতি স্যার জাহিদ সোহরাওয়ার্দির কনিষ্ঠ সন্তান। জাহিদ সোহরাওয়ার্দি কলকাতা হাইকোর্টের একজন খ্যাতনামা বিচারক ছিলেন। তার পরিবারের সদস্যবর্গ তৎকালীন ভারতবর্ষের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের প্রথা অনুসারে উর্দু ভাষা ব্যবহার করতেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দি নিজ উদ্যোগে বাংলা ভাষা শিখেন এবং বাংলার চর্চা করেন। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবন শুরু করার পর যোগ দেন সেইন্ট জ্যাভিয়ার্স কলেজে। সেখান থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে তিনি স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর তিনি তার মায়ের অনুরোধে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে আরবি ভাষা এবং সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯১৩ সালে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক অর্জন করেন। এছাড়া এখানে তিনি আইন বিষয়েও পড়াশোনা করেন এবং বিসিএল ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯১৮ সালে গ্রে'স ইন হতে বার এট ল ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর ১৯২১ সালে কলকাতায় ফিরে এসে আইন পেশায় নিয়োজিত হন এবং মাত্র ২৯ বছর বয়সে বেঙ্গল আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন খিদিরপুর শিল্প এলাকা থেকে।
১৯২০ সালে তিনি বেগম নেয়াজ ফাতেমাকে বিয়ে করেন। বেগম নেয়াজ ফাতেমা ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আবদুর রহিমের কন্যা।

ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের জন্য বেত্রদ- বিল সংসদে পেশ করলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিরোধী দলের সদস্য হিসেবে এই বিলের তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, ‘ভারতীয়রা পশু নয়, তাদের সাদা চামড়ার প্রভুদের মত্যেই মানুষ। ক্ষমতার দাপটে বিট্রিশ সরকার মনোনীত সদস্যদের সহায়তায় এই বিল পাস করিয়ে নেওয়া যাবে তবে তা হবে মানবতাবিরোধী। আমরা ক্রীতদাস নই। আমরা ব্রিটিশ পশুশক্তির কাছে হয়ত হার মেনেছি; কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, সভ্যতার মাপকাঠিতে অন্যান্যের তুলনায় উন্নততর ছিলাম।এই সময় তিনি দেশবন্ধুর সংস্পর্শে আসেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ কংগ্রেস ত্যাগ করে ১৯২৩ সালে স্বরাজ পার্টি গঠন করেন।

১৯২৪ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ কলকাতা কর্পোরেশন প্রথম মেয়র ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী ডেপুটি মেয়র নির্বাচিত হন। উভয় নেতাই বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেন। দেশবন্ধু ১৯২৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯২৬ সালের মে মাসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় কলকাতার ২২ শতাংশ মুসলিম অধিবাসীর জীবন রক্ষার জন্য সোহরাওয়ার্দীর তৎপরতা ছিল খুবই উল্লেখ্যযোগ্য। ১৯২৭ সালে সোহরাওয়ার্দী পদত্যাগ করেন। ১৯২৮ সালে সর্বভারতীয় খিলাফত সম্মেলন এবং সর্বভারতীয় মুসলিম সম্মেলন অনুষ্ঠানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মুসলমানদের মধ্যে তার ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব থাকলেও ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত মুসলিম লীগের সাথে তিনি জড়িত হননি। ১৯৩৬ সালের শুরুর দিকে তিনি ইন্ডিপেন্ড্যান্ট মুসলিম পার্টি নামক দল গঠন করেন।  

 তিনি এই সময় বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাদের মধ্যে রেল কর্মচারী, সি-ম্যান, জুট কটন মিল শ্রমিক, রিকশা শ্রমিক, ঠেলাগাড়ী শ্রমিক, খানসামা প্রভৃতি পেশাজীবীসহ প্রায় ৩৬টি সংস্থার তিনি কর্ণধার ছিলেন। ১৯৩৫ সনে জিন্নাহ স্বেচ্ছানির্বাসন থেকে ভারতে এসে মুসলিম লীগের (প্রতিষ্ঠা ১৯০৬) নেতৃত্ব গ্রহণ করলে তার অনুরোধে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগে যোগদান করেন । এই সুবাদে তিনি বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল মুসলিম লীগ তথা বিপিএমএল এর সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ সালের শেষ দিক পর্যন্ত এই পদে ছিলেন। । ১৯৩৫ সনে ভারত শাসন আইন প্রবর্তন হলে ১৯৩৭ সনে বেঙ্গল প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে তিনি মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসাবে দুটি নির্বাচন কেন্দ্রে নির্বাচিত হন। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিচক্ষণতার ফলে মুসলিম লীগ ও কেএসপি যৌথভাবে শেরে বাংলার নেতৃত্বে ১৯৩৭ সালের এপ্রিল মাসে মন্ত্রিসভা গঠনে সমর্থ হয়। এই মন্ত্রিসভায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে যোগদান করেন। মন্ত্রিসভার প্রধান কাজ ছিল দুর্ভিক্ষের মোকাবেলা করা। কাজটি ছিল অত্যন্ত কঠিন। একেতো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে প্রধান চাল রফতানিকারক বার্মা তখন শত্রুপক্ষ জাপানীদের দখলে; অপরদিকে অন্যান্য প্রদেশ যেমন: আসাম, বিহার, উড়িষ্যা এবং অভ্যন্তরীণ জেলাসমূহ থেকে খাদ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হয়; কেননা, সব ধরনের রেল ও নৌপথে সেনাবাহিনীর সরবরাহকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছিল। এছাড়া নৌযানসমূহ ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল জাপানী অবরোধের ভয়ে। এতদসত্ত্বেও শহীদ সোহরাওয়ার্দী সম্ভাব্য সবকিছুই করেছিলেন লঙ্গরখানা চালু, রেশন সরবরাহ ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল।


১৯৪৩ সালে শ্যমা-হক মন্ত্রীসভা পদত্যাগের পরে গঠিত খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রীসভায় তিনি একজন প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রীসভায় তিনি শ্রমমন্ত্রী, পৌর সরবরাহ মন্ত্রী ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৬ এর নির্বাচনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের বিপুল বিজয়ে তিনি এবং আবুল হাশিম মূল কৃতিত্বের দাবীদার ছিলেন।  ১৯৪৬ সালে বাংলার মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তান আন্দোলনে তিনি ব্যাপক সমর্থন প্রদান করেন।পূর্ব বাংলা মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে ১৯৪৬ সালে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি তার সমর্থন এবং সহযোগিতা প্রদান করেন। স্বাধীন ভারতবর্ষের ব্যাপারে কেবিনেট মিশন প্ল্যানের বিরুদ্ধে জিন্নাহ ১৯৪৬ সালের আগস্ট ১৬ তারিখে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দেন। বাংলায় সোহরাওয়ার্দির প্ররোচনায় এই দিন সরকারী ছুটি ঘোষণা করা হয়। মুসলমানদের জন্য আলাদা বাসভূমি পাকিস্তানের দাবীতে এই দিন মুসলমানরা বিক্ষোভ করলে কলকাতায় ব্যাপক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বেঁধে যায়। পূর্ব বাংলার নোয়াখালিতে এইদিন বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ চলে। সোওহরাওয়ার্দী এসময় তার নীরব ভূমিকার জন্য হিন্দুদের নিকট ব্যাপক সমালোচিত হন। তার উদ্যোগে ১৯৪৬ সালে দিল্লী সম্মেলনে মুসলিম লীগের আইন প্রণেতাদের নিকট লাহোর প্রস্তাবের একটি বিতর্কিত সংশোধনী পেশ করা হয়। এই সংশোধনীতে অখন্ড স্বাধীন বাংলার প্রস্তাবনা ছিল। কিন্তু কলকাতায় হিন্দু মুসলমান রায়টে তার বিতর্কিত ভূমিকার কারণে হিন্দুদের নিকট তার গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। ফলে শরৎচন্দ্র বসু ছাড়া কংগ্রেসের আর কোন নেতা তার অখণ্ড বাংলার ধারণার সাথে একমত ছিলেন না।

১৯৪৬ সালের নির্বাচনটি ছিল পাকিস্তান ইস্যুতে গণভোট। জিন্নাহ সাহেব একবার বাংলা প্রদেশের মধ্যদিয়ে ট্রেনে সিলেট গেলেও এই অঞ্চলের নির্বাচন প্রচারে অংশগ্রহণ করেননি। লিয়াকত আলী খান গফরগাঁওয়ের (ময়মনসিংহ) যে আসনে নির্বাচনী প্রচার করেন সে আসনে মুসলিম লীগ প্রার্থী পরাজয় বরণ করেন। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নির্বাচনের দায়িত্ব ছিল শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ওপর এবং তিনি সে দায়িত্ব পালনে এক রেকর্ড সৃষ্টি করেন। নির্বাচনে অপর প্রতিদ্বন্দ্বী শেরেবাংলা ও তার দল কেএসপি পাকিস্তান ইস্যুর বিরোধিতা করেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ফলে মুসলিম লীগ ১১৯টি আসনের মধ্যে ১১৪টি (যার মধ্যে শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মিসেস আনোয়ার খাতুন, মিসেস হাকিম ও খান বাহাদুর ফজলুল কাদেরসহ ১০ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত) আসন লাভ করে। শেরেবাংলা নিজে বাগেরহাট ও পটুয়াখালীর দুটি আসনে নির্বাচতি হলেও দলগতভাবে পান মাত্র ৭টি আসন এবং স্বতন্ত্র ১ জন। আবুল হাশিম বর্ধমান জেলা কমিউনিস্ট পার্টি সম্পাদককে ২৬৭০২ ভোটে পরাজিত করেন। ১৯৪৬ সালের ২ এপ্রিল শহীদ সোহরাওয়ার্দী খাজা নাজিমুদ্দিনকে পরাজিত করে সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন এবং ২৪ এপ্রিল মন্ত্রিসভা গঠন করেন।
শেরেবাংলা কংগ্রেসের সঙ্গে বিরোধী দলে যোগ দেন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে অপর মুসলিম-অধ্যুষিত প্রদেশ পাঞ্জাব, সিন্ধু এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের জনগণ পাকিস্তান ইস্যুর বিরুদ্ধে ভোট দেয়। যার ফলে জিন্নাহ সাহেব ব্রিটিশ ও কংগ্রেসের সঙ্গে পাকিস্তান দাবি নিয়ে বিব্রত অবস্থায় পড়েন। কেননা, ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে যে স্টেটসকথাটি ছিল তাতে তৎকালীন পাকিস্তান ইস্যুতে যে নির্বাচন হয়েছিল তার ফলে একমাত্র বেঙ্গলইপাকিস্তান হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। কিন্তু জিন্নাহ চেয়েছিলেন সিন্ধু, পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ ও বেঙ্গলকে নিয়ে এক পাকিস্তান। তাই জিন্নাহর জন্য ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের স্টেটসশব্দের পরিবর্তন ছাড়া কোন বিকল্প না থাকায় ১৯৪৬ সালের ৯ ও ১০ এপ্রিল দিল্লীর এ্যাংলো এরাবিক কলেজে মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক কমিটির সদস্যদের কনভেনশন আহ্বান করেন। এই কনভেনশনে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রস্তাব করেন যে, ‘যেহেতু ১০ কোটি মুসলমানদের দৃঢ় বিশ্বাস, মুসলিম ভারতকে হিন্দু পরাক্রমের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এবং তাকে নিজস্ব প্রতিভা অনুসারে বিকশিত হবার পূর্ণ সুযোগদানের জন্য উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বাংলা ও অসম এবং পশ্চিম অঞ্চলের পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান নিয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করা একান্ত প্রয়োজন।অথচ ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে একাধিক রাষ্ট্র (স্টেটস’) গঠনের প্রস্তাব ছিল। দিল্লী প্রস্তাবনামে খ্যাত এই প্রস্তাব মওলানা ভাসানী ও আবুল হাশিম প্রমুখ বিরোধিতা করলে আবুল হাশিমকে জিন্নাহ সাহেব এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, প্রস্তাবটি মুসলমানদের আবাসভূমির জন্য স্বতন্ত্র গণপরিষদ গঠনের কাঠামো এবং লাহোর প্রস্তাবের সংশোধনী নয়।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ১৯৪৬ সনে পাকিস্তান দাবিতে জিন্নাহর নির্দেশে ডাইরেক্ট এ্যাকশন দিবসের কর্মসূচী পালন নিয়ে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ শুরু হয়। এছাড়া খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেছিলেন যে, আমাদের সংগ্রাম ভারত সরকারের বিরুদ্ধে নয়, হিন্দুদের বিরুদ্ধে। কলকাতায় দাঙ্গার প্রতিক্রিয়া নোয়খালী জেলায়ও দেখা যায়, যা নিরসনের জন্য মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালী এসেছিলেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী সে সময় মুখ্যমন্ত্রী না থাকলে কলকাতার মুসলমানদের (শহরের ২৪ শতাংশ) রক্ষা করা সম্ভব হতো না।
স্বাধীন ও সার্বভৌম অবিভক্ত বাংলা দাবিটি যদিও শরৎ বসুসহ হিন্দু নেতৃবৃন্দ সমর্থন করেছিলেন, কিন্তু কংগ্রেস কোন অবস্থায় কলকাতাকে হাতছাড়া করতে রাজি হয়নি। জিন্নাহ সাহেব শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে খুশি রাখার জন্য অবিভক্ত বাংলাকে পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হিসেবে পেতে চান বলে ভাব দেখাচ্ছিলেন। কিন্তু এনিয়ে বেশি দূর অগ্রসর হননি; কেননা তার ভয় ছিল যে, অবিভক্ত বাংলা যদি পাকিস্তানের অংশ হয় তবে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সম্ভাবনা এতই উজ্জ্বল যে, বাংলাই পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ব্রিটিশ সরকারের ভাইসবয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন, বাংলাকে অবিভক্ত রাখার দাবি একমাত্র কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে পূর্ণ মতৈক্যের ভিত্তিতে মেনে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু তা সম্ভব ছিল না। বাংলাকে অবিভক্ত রেখে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বা অবিভক্ত বাংলা পাকিস্তানের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা না করার পেছনে বাংলার কতিপয় মুসলিম লীগ নেতাও দায়ী ছিলেন। কেননা, তাদের ভয় ছিল বাংলা অবিভক্ত অবস্থায় যদি পাকিস্তানের অংশ হয় সেক্ষেত্রে কলকাতাই থাকবে রাজধানী এবং তার অর্থ শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে নেতৃত্ব থেকে হঠানো যাবে না। কলকাতায় প্রভাবশালী সোহরাওয়ার্দী অবশ্য রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরের ওয়াদা করেছিলেন। কোন অবস্থায় যাতে কলকাতা কংগ্রেসের হাতছাড়া না হয় সেজন্য ১৯৪৬ সাল থেকেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে ছিল, যা ভারত বিভাগের সময় পর্যন্ত অব্যাহত ছিল এবং এর উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গ-বিভক্তি।

স্বাভাবিকভাবেই আইনত পূর্ব বঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রীর পদটি শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পাওনা ছিল; কেননা, দেশ বিভাগের প্রাক্কালে তিনিই ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। শেরেবাংলা আগেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন মুসলিম লীগের চক্রান্তে (এবং দেশ বিভাগের পর সম্ভবত পরিণত বয়সের কারণে শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান সরকারের এ্যাডভোকেট জেনারেলের চাকরি গ্রহণ করেন।) বাংলার অপর বিচক্ষণ রাজনীতিক সোহরাওয়ার্দীকে রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে সেখানে পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী তাদের আজ্ঞাবহ কাউকে বসাতে পারলেই পূর্ব বাংলাকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করা সম্ভব। তাই শহীদ সোহরাওয়ার্দী যাতে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী না হতে পারেন সেজন্য জিন্নাহ-লিয়াকত আলী খান খুবই সতর্ক ছিলেন।

১৯৪৭ সালের জুন মাসে সিলেটের পাকিস্তানভুক্তির প্রশ্নে যে গণভোট হয় তাতে যে ১৪ জন সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তারা মুসলিম লীগে যোগ দেয়ার জন্য সোহরাওয়ার্দীর কাছে তাদের ১৪ জন থেকে ৩ জনকে মন্ত্রী বানানোর শর্ত আরোপ করলে সোহরাওয়ার্দী তাতে রাজি হননি; কিন্তু খাজা নাজিমুদ্দিন তাদের সে প্রস্তাবে রাজি হন এবং লিয়াকত আলী খানের নির্দেশে পার্লামেন্টারি পার্টির পুনর্নির্বাচন হয়। উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালের ৫ আগস্ট মুসলিম লীগ ও ভারতীয় অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভার সদস্য ইসমাইল ইব্রাহিম চুন্দ্রিগড়ের সভাপতিত্বে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ সংসদীয় দলের বৈঠকে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ৭৫-৩৯ ভোটে পরাজিত করে খাজা নাজিমুদ্দিন নেতা নির্বাচিত হন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালের ১৩ আগস্ট খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছে পূর্ববঙ্গে এবং ড. প্রফুল্ল ঘোষের কাছে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে জন্ম নিলেও সোহরাওয়ার্দী কলকাতায় থেকে যান এবং গান্ধীর সঙ্গে একত্রে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধ করতে তৎপর ছিলেন। উল্লেখ্য, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও পাকিস্তানের ন্যায্য পাওনা ৫৫ কোটি টাকা পরিশোধ করতে ভারত সরকারের অসম্মতির প্রতিবাদে মহাত্মা গান্ধী যে অনশন শুরু করেন তারই ফলশ্রুতিতে ৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮ তারিখে উগ্রপন্থী হিন্দুরা (নাথুরাম গডসে) তাঁকে হত্যা করে। ১৯৪৮ সালের ৩ জুন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঢাকা আগমন করলে দুই বাংলাকে এক করার কল্পিত অভিযোগে তাকে বন্দী করে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালের ৫ মার্চ তিনি করাচী চলে যান। কিন্তু ইতোমধ্যে তার পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্যপদ পাকিস্তানের নাগরিক নয় অজুহাতে বাতিল করা হয়েছিল। উল্লেখ করা যেতে পারে, একই কারণে বাবু রাজকুমার চক্রবর্তী কলকাতা অবস্থান করলেও পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্যপদ বাতিল করা হয়নি। শহীদ সাহেব করাচীতে বসবাস শুরু করার পূর্বেই জিন্নাহ সাহেব মারা যান (১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮)।

করাচীতে বসবাস শুরু করলেও তিনি তার কলকাতার অনুগত কর্মী যারা পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান করছিলেন এবং সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা অব্যাহত থাকে। তাদের পক্ষে মামলা লড়ার জন্য তিনি ঢাকাসহ প্রদেশের বিভিন্ন শহরে যান। উল্লেখ করা যেতে পারে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শেষ দিকে কলকাতার মুসলিম লীগের যুবসমাজ বস্তুত দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী, অন্যদিকে খাজা নাজিমুদ্দিন। খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ববঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হলে তার সমর্থক শাহ আজিজ চক্র সরকার সমর্থক হয়ে পড়ে। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী সমর্থক শেখ মুজিব, তাজউীদ্দন, শামসুল হক, খন্দকার মোশতাক প্রমুখ সরকারবিরোধী শিবিরে অবস্থান নেন। ১৯৪৭ এর আগস্টে পাকিস্তানের স্বাধীনতার পরে মুসলিম লীগের রক্ষনশীল নেতারা খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে শক্তিশালী হয়ে উঠেন। এর আগে ১৯৪৭ সালের আগস্ট ৫ এ খাজা নাজিমুদ্দিন জিন্নাহর পরোক্ষ সমর্থনে মুসলিম লীগের সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন। এরপর থেকে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রগতিশীল নেতারা কোনঠাসা হয়ে পড়েন। খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ববাংলার মূখ্যমন্ত্রী হবার পর বেশ কয়েকবার সোহরাওয়ার্দীকে "ভারতীয় এজেন্ট" এবং "পাকিস্তানের শত্রু" হিসেবে অভিহিত করেন। সোহরাওয়ার্দীকে পাকিস্তানের আইনসভার সদস্য পদ থেকে অপসারিত করা হয়। তার অনুসারী রা অনেকে ১৯৪৮ এর শুরুর দিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ এবং ১৯৪৯ এর জুনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামি মুসলিম লীগ গঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নাম থেকে পরে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠালগ্নে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হন আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ কে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোষাধ্যক্ষ হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থাতেই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান মুজিব। অন্যদিকে, পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। এর সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ২৪ বছরের পাকিস্তান শাসনামলে আওয়ামী লীগ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে দু'বছর প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল। ১৯৫৩ সালে তিনি একে ফজলুল হক এবং মাওলানা ভাসানীর সাথে একত্রে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচন উপলক্ষে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে পরাভূত করার জন্য আওয়ামী মুসলিম লীগের উদ্যোগে এই যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। এই যুক্তফ্রন্টের নেতা ছিলেন - ১) মওলানা ভাসানী, ২) একে ফজলুল হক ও ৩) হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এই যুক্তফ্রন্ট ২১ দফার একটি নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। ওই ইশতেহারের মধ্যে প্রধান দাবি ছিল - ১) লাহোর প্রসত্দাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা, ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা, ভাষা শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে শহীদ মিনার নির্মাণ করা ইত্যাদি। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পূর্বেই ৫ মার্চ ৪৯ শহীদ সোহরাওয়ার্দী করাচীতে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক নির্যাতিত হন জঘন্যভাবে এবং তিনি জিন্নাহ মুসলিম লীগ গঠন করেন। পাকিস্তান সৃষ্টিতে যার অবদান ছিল সব চাইতে উল্লেখযোগ্য সেই শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহতি পরে তৎকালীন শাসক গোষ্ঠী শুধু উপেক্ষা এবং অবহেলাই করেনি বরং অবিশ্বাস করত। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৫০ সালের স্বাধীনতা দিবসের (১৪ আগস্ট) অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ভারতের লেলিয়ে দেয়া কুকুরবলে গালি দেন।
১৯৫৪ সালের মার্চের আট থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পায়। এরমধ্যে ১৪৩টি পেয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মওলানা ভাসানী, আবুল কাশেম ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক গঠিত যুক্তফ্রন্ট অভূতপূর্ব জয়লাভ করে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সম্পূর্ণরূপে পরাভূত হয়। তারা শুধু ৯টি আসন লাভ করে। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ 'মুসলিম' শব্দটি বর্জন করে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এরপর মোহাম্মদ আলী বগুড়া মন্ত্রীসভায় সোহরাওয়ার্দি আইনমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি ডিসেম্বর ২০, ১৯৫৪ হতে আগস্ট, ১৯৫৫ পর্যন্ত এ পদে ছিলেন। আগস্ট ১১, ১৯৫৫ হতে সেপ্টেম্বর , ১৯৫৬ পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান আইনসভায় বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণয়নে তার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তিনি সেপ্টেম্বর ১২, ১৯৫৬ থেকে অক্টোবর ১১, ১৯৫৭ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫৬ সালে চৌধুরি মোহাম্মদ আলির পদত্যাগের পর তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পররাষ্ট্র বিষয়ে পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্রপন্থী মনোভাবের ব্যাপারে তাকে অগ্রদূত হিসেবে অভিহিত করা হয়। ১৯৫৬ সালে সংখ্যা-সাম্যের ভিত্তিতে একটি শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়। উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়। কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের ১৩ জন এমএনএ থাকা সত্ত্বেও রিপাকলিকান পার্টির সহযোগিতায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হন। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেকার অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে তিনি পদক্ষেপ নেন। কিন্তু তার এই পদক্ষেপ ব্যাপক রাজনৈতিক বিরোধিতার জন্ম দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের মতো পশ্চিম পাকিস্তানেও এক ইউনিট ধারণা প্রচলনের তার চেষ্টা পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের কারণে নস্যাৎ হয়ে যায়। এরপর ১৯৫৮ সালে ইস্কান্দার মীর্জা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারী করেন। আগস্ট,১৯৫৯ হতে ইলেক্টিভ বডি ডিসকুয়ালিফিকেশান অর্ডার অনুসারে তাকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে রাস্ট্রবিরোধী কাজের অপরাধ দেখিয়ে তাকে জানুয়ারি ৩০, ১৯৬২ তে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং করাচি সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ করা হয়। আগস্ট ১৯, ১৯৬২ সালে তিনি মুক্তি পান।

১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গে অভাবিত সাফল্য, ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় ছিলেন। ১১ সেপ্টেম্বর ৫৬ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসবে শপথ গ্রহণ করেন এবং ১৯৫৭ সালের ১১ অক্টোবর পর্যন্ত এই পদে বহাল ছিলেন। আওয়ামী লীগ ও রিপাবলিকান কোয়ালিশন এই সরকারে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দলীয় সদস্য সংখ্যা ছিল ৮০ জনের মধ্যে মাত্র ১২ জন। আবুল মনসুর আহম্মদকে (ইতিপূর্বে যিনি প্রাদেশিক মন্ত্রী হয়েছিলেন) কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়েছিল। ১০ সদস্যবিশিষ্ট সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভায় সদস্য ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আবুল মনসুর আহম্মদ, জহিরউদ্দিন আহম্মদ, দিলদার আহম্মদ ও এমএ খালেক; পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মালিক ফিরোজ খান নুন, সৈয়দ আজমাদ আলী, গোলাম আলী তালপুরা, সরদার আমির, আজম খান ও মিয়া জাফর শাহ।

সোহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে বিদেশনীতি, স্বায়ত্তশাসন ইত্যাদি প্রশ্নে দলীয় সভাপতি মওলানা ভাসানীর সঙ্গে প্রবল মতবিরোধ দেখা যায়। যার ফলে মওলানা ভাসানী বামপন্থী কমিউনিস্ট-প্রভাবিত নেতাদের নিয়ে গঠন করেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। কিন্তু শেখ মুজিব স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে সংক্ষুব্ধ থাকলেও পাকিস্তানীদের সঙ্গে বোঝাপড়ার কৌশল হিসেবে সোহরাওয়ার্দীকে ত্যাগ করেননি।
১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর সামরিক শাসক আয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন। রাজনীতিকদের ঘায়েল করার লক্ষ্যে ২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৯ তারিখে পূর্ব পাকিস্তানের ৪৩ জনকে সর্বোচ্চ ৭ বছর রাজনীতি করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। এবডো নামক এই কুখ্যাত কর্মকাণ্ডে শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আতাউর রহমান খান, আবু হোসেন সরকার এবং অন্যদের ১৯৬৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজনীতি করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলো । ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসি পদ্ধতি বস্তুত গণতন্ত্র হত্যার সংবিধান (চালু ১ মার্চ ১৬৬২) প্রতিহত করার অভিযোগে আয়ুব খান সোহরওয়ার্দীকে আটক করেন । এ প্রসঙ্গে আইয়ুব খান ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বলেন, বিদেশী অর্থে সোহরওয়ার্দী পাকিস্তান ধ্বংস করতে যাচ্ছিলেন বলে তাকে আটক করা হয়। এর প্রতিবাদে ঢাকায় ১ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট হয় এবং একই সময়ে আটক হন শেখ মুজিব, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আবুল মুনসুর আহম্মদসহ অসংখ্য নেতাকর্মী। (সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা হয় ৭ জুনু ১৯৬২ সালে এবং নেতাকর্মীদের জেলে রেখেই সংবিধান চালু হয়।) আইয়ুববিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে যা শেষ পর্যন্ত ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরের শিক্ষা আন্দোলনের (শিক্ষা দিবস) ফলে গণবিরোধী শিক্ষানীতি বিশেষ করে ৩ বছর মেয়াদি গ্র্যাজুয়েশন ব্যবস্থা বাতিল করে ২ বছর মেয়াদি রাখতে বাধ্য হয়েছিল। উল্লেখ্য, ওই ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী আইয়ুববিরোধী সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয় ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারাদেশে (চট্টগ্রাম স্টেশনের অদূরে কদমতলী রেলক্রসিং এলাকায় রেললাইন উঠিয়ে ফেলেছিল ছাত্ররা,  সোহরাওয়ার্দীর মুক্তির জন্য ৯ নেতা একটি ঐতিহাসিক বিবৃতি দিয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দী অক্টোবার, ১৯৬২ তে তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের উদ্দেশ্যে ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট (এন ডি এফ ) গঠন করেন।

হৃদরোগ আক্রান্ত হয়ে সোহরাওয়ার্দী প্রথমে করাচীর হাসপাতালে ভর্তি হন ১২ জানুয়ারী ৬৩ এবং ১৯ মার্চ ১৯৬৩ বৈরুতের উদ্দেশে করাচী ত্যাগ করেন। সেখানে কিছুকাল অবস্থানের পরে লন্ডনে যান তার ছেলে রাশেদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে। পুনরায় নবেম্বর মাসে বৈরুতে ফিরে আসেন এবং হার্নিয়া অপারেশন করার প্রস্তুতি নেন। তার দেশে আসার কথা ছিল জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের ৩ বা ৪ তারিখে। কিন্তু হঠাৎ ৫ ডিসেম্বর ৬৩ বৈরুতের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-এ কক্ষে মৃত্যুমুখে পতিত হন। তাঁর মৃত্যু অনেকের কাছে রহস্যমণ্ডিত।  তাকে ঢাকায় শেরেবাংলার পাশে দাফন করা হয়। তার মৃত্যুতে ঢাকায় লাখো লোকের জানাজা/শোক মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সেতুবন্ধনের শেষ চেষ্টার পরিসমাপ্তি ঘটে এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করে। শেখ মুজিবের পাকিস্তানের প্রতি আর কোন দ্বিধা থাকল না। দিলেন একদফার পূর্বে ছয়দফা।


















তথ্য সংগৃহীত

কোন মন্তব্য নেই: