বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৪

মানবতাবিরোধী অপরাধে অপরাধী বিএনপি নেতা জাহিদ হোসেন খোকন।



১১ টি অপরাধের মধ্যে ১০ টি অপরাধ প্রমানিত । ৬ টি অপরাধে ফাঁসির আদেশ , ৪ টিতে ৪০ বৎসরের জেল ।


১৯৪৩ সালে ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা পৌরসভার নগরকান্দা গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন জাহিদ হোসেন খোকন। তার পিতা মৃত মোতালেব মাতুব্বর ও মা মৃত জয়নব বেগম । তদের তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে খোকন তৃতীয় । খোকন তার বড় ভাই নগরকান্দা থানা রাজাকার কমান্ড জাফর মাতব্বর ওরফে জাফর রাজাকারের নির্দেশে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাদের সঙ্গে মানবতা বিরোধী অপরাধে যুক্ত হন । ৭১ এর ২৯ শে মে নগরকান্দা চাঁদহাটে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধের একপর্যায়ে জাফর রাজাকারের মৃত্যু হলে রাজাকার কমান্ডার হন খোকন রাজাকার ।




খোকন রাজাকারের তিন ছেলে তিন মেয়ে । খোকনের বড় ছেলে লিংকন ও বড় মেয়ে বিউটি তার জামাই সহ সুইডেনে থাকেন । খোকনের ছোট ভাই সামছুল হুদা হুদু জানিয়েছে খোকন কতটুকু লেখাপড়া করেছে তার জানা নাই , তবে মেট্রিক পাস করে নাই । খোকন রাজাকার ২০১০ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর বাড়ি থেকে পালিয়ে যান, এর পর আর বাড়ি যান নাই ।  

১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে খোকন জামায়াতের প্রার্থীর পক্ষে বৃহত্তর ফরিদপুর এলাকায় প্রচার চালান। পরে তিনি বিএনপির রাজনীতিতে জড়ান এবং নগরকান্দা পৌর কমিটির সহ-সভাপতি হন। ২০১১ সালে নির্বাচিত হন নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র।

অভিযোগ ১: একাত্তরের ২৭ এপ্রিল ভোর ৬টার দিকে খোকনের নেতৃত্বে তার বড় ভাই জাফর ও সশস্ত্র রাজাকার সদস্যরা নগরকান্দা থানাধীন বনগ্রামে যায়। এরপর জাফরের উসকানিতে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই মোল্লা ও নাজিম উদ্দিন মোল্লার বাড়িসহ ছয় বাড়িতে লুটপাট চালায়। এছাড়া উমেদ মোল্লা, রতন মোল্লা, হাসেম মোল্লা, মো. ইউনুস মোল্লাসহ ১৯ জনকে আটক করা হয়। তাদের মধ্যে সাত্তার মোল্লা ও আজিজ শেখকে সামান্য নির্যাতনের পরে ছেড়ে দেওয়া হলেও বাকি ১৭ জনকে থানায় নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। দুই দিন পর স্থানীয় চেয়ারম্যান আব্দুস সালামের মাধ্যমে পরিবারের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২) এবং ৪(১) ধারায় আসামির বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ ২: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২৮ এপ্রিল থেকে ৬ মের মধ্যে কোনো একদিন পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে আসামি খোকন ও তার নেতৃত্বাধীন রাজাকার বাহিনী জঙ্গুরদি-বাগুটিয়া গ্রামের কানাই লাল মণ্ডলসহ আরো একজনের বাড়িতে হামলা চালায়। তারা ওই বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং গ্রামের অন্য হিন্দুরা মুসলমান না হলে বাড়িঘর ধ্বংস করে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেয়।  এরপর কানাই লালের পরিবারের কাছ থেকে জোর করে ৫ হাজার টাকা এবং জীবন দাসের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। আসামির সহযোগী  আয়নাল রাজাকার, আতাহার রাজাকারসহ অন্যরাও গ্রামের অন্য হিন্দুদের হুমকি দিয়ে জোর করে টাকা আদায় করে।
এ ঘটনায় আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(সি)(ii), ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২) এবং ৪(১) ধারায় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে পরামর্শ ও সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ ৩: একাত্তরের ১৬ থেকে ২৮ মের মধ্যে কোনো একদিন আসামি খোকন ও তার ভাইয়ের নেতৃত্বে সশস্ত্র রাজাকাররা একজন মৌলবিসহ জঙ্গুরদি-বাগুটিয়া গ্রামের জীবন দাসের বাড়ি যায়। ওই বাড়ির আঙিনায় জীবন দাসসহ তার চার ভাইকে জোর করে মুসলিম করে তাদের মুসলিম নাম দেওয়া হয়। পরে বাড়ির ভেতরে ঢুকে বাড়ির নারী সদস্যদেরও কলেমা পড়িয়ে মুসলিম করা হয়।  এ ঘটনায় ভীত হয়ে নিজেদের কিশোরী মেয়েকে বাঁচাতে ১৮ থেকে ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে কোনো একদিন তারা সপরিবারে ভারত চলে যায়।
এ ঘটনায় খোকনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(সি)(জি), ২০(২) এবং ৪(১) ধারায় দেশান্তরে বাধ্য করা, মানসিক নির্যাতন ও নিপীড়নের অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ ৪: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৭ মে সকাল ৯টা থেকে ১১টার মধ্যে আসামি জাহিদ হোসেন খোকন, তার ভাই জাফর ও রাজাকার বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা চাঁদের হাট গ্রামের বণিকপাড়ায় গিয়ে ১৬/১৭ জন হিন্দুকে হত্যার হুমকি দেয় এবং তাদের কাছ থেকে জোর করে সোনার গয়না ও নগদ অর্থ লুট করে। এরপর তাদের বাড়ি ও মন্দিরে আগুন দেওয়া হয়।  ওই গ্রামে আশ্রয় নেওয়া টগর দাস দত্তের স্ত্রী রাধা রাণী দাসকে ধর্ষণ করেন খোকন। অন্য রাজাকার সদস্যরা এ সময় খুকু রাণী দত্ত নামের আরেক কিশোরীকে ধর্ষণ করে। পরে সম্মান বাঁচাতে ধর্ষিতদের পরিবার ভারতে চলে যায় এবং সেখানেই থেকে যায়।
এ ঘটনায় আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ২০(২) এবং ৪(১) ধারায় আটক, ধর্ষণ ও দেশান্তরে বাধ্য করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ ৫: মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ মে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে আসামি খোকন রাজাকারের নেতৃত্বে আতাহার রাজাকার, আইনাল রাজাকারসহ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে কোদালিয়া গ্রামের শহীদনগরে ঢোকে। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মিলে তারা বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাটের পরে আগুন দেয়। এ সময় আশেপাশে লুকিয়ে থাকা ৫০-৬০ জনকে ধরে এনে তাদের মধ্যে নারী ও শিশুসহ ১৬ জনকে গুলি করে হত্যা করে খোকন ও তার সহযোগীরা। দেড় বছর বয়সী এক শিশুসহ অন্তত ছয়জন সে সময় গুরুতর আহত হন। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যেতে অস্বীকৃতি জানানোয় আলাউদ্দিন নামে এক কিশোরের হাত ভেঙ্গে দেন খোকন। এছাড়া কোদালিয়া কওমি মাদ্রাসার কাছে পাকিস্তানি সেনারা আফজাল হোসেন এবং কাছেই এক পাটক্ষেতে শুকুর শেখ নামে একজনকে খোকন নিজে গুলি করে হত্যা করেন।
এ ঘটনায় আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(সি)(জি), ২০(২) এবং ৪(১) ধারায় অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা ও গণহত্যাসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ ৬: একাত্তরের ৩০ মে দুপুর দেড়টার দিকে খোকনের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাসহ রাজাকাররা ঈশ্বরদী গ্রামে যায় এবং বহু বাড়িঘর ও দোকানপাটে আগুন দেয়। এ সময় গ্রাম ছেড়ে পালাতে থাকা ভীত ও নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের গুলি করে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা। এতে সালাম মাতবর, শ্রীমতি খাতুন, লাল মিয়া মাতুব্বর ও মাজেদ মাতুব্বর নিহত হন।
এ ঘটনায় আসামির বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(জি) ও (এইচ) এবং ৪(১) ধারায় অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হত্যাসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।
অভিযোগ ৭: একাত্তরের ৩১ মে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে আসামির নেতৃত্বে রাজাকার সদস্য ও পাকিস্তানি সেনারা কোদালিয়ার শহীদনগর গ্রামের দীঘলিয়া-ঘোড়ানাড়া বিলে যায় ২৯ মে ওই গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত পাকিস্তানী সেনাদের লাশ খুঁজতে। এ সময় পিজিরউদ্দিন, তার ভাই আফাজ ও তাদের প্রতিবেশী শেখ সাদেকের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। তারা তিনজনই বাড়ির ভেতরে পুড়ে মারা যান। একইদিন সকাল ১০টার দিকে বনগ্রামে আব্দুল হাই মোল্লা, ইকরাম মোল্লাসহ পাঁচজনের বাড়ি লুট করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। মেহেরদিয়া গ্রামের আসিরুদ্দিন মাতুব্বরকে মেহেরদিয়া পূর্বপাড়া জামে মসজিদ থেকে বের করে গুলি করে হত্যা করেন খোকন নিজে। পরে সফিজুদ্দিন মাতুব্বরকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। গ্রামের বাড়িঘরে লুট চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(জি) ও (এইচ) এবং ৪(১) ধারায় হত্যাসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ ৮: একাত্তরের ৩১ মে খোকনের নেতৃত্বে তার অধীন সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী ও পাকিস্তানি সেনারা স্বাধীনতার পক্ষের লোকজন, আওয়ামী লীগের কর্মী ও হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করতে গোয়ালদি গ্রামে যায়। এ সময় প্রাণভয়ে পালাতে থাকা মানুষের দিকে তারা গুলি চালালে রাজেন্দ্রনাথ রায় নামে এক বৃদ্ধ নিহত হন। পরিবারের সঙ্গে পালাতে থাকা কিশোর হান্নান মুন্সীর দুই বছরের বোন বুলু খাতুনকে তার মায়ের কোলে গুলি করে হত্যা করেন খোকন ও তার সহযোগীরা। অনেক বাড়িঘরে লুটপাটও চালানো হয়।
এ ঘটনায় খোকনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(জি) ও (এইচ) এবং ৪(১) ধারায় লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ ৯: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৩১ মে খোকনের নেতৃত্বে রাজাকার সদস্য ও পাকিস্তানি সেনারা পুরাপাড়া গ্রামে ঢুকে ছটু খাতুন, সফিজুদ্দিন শেখ, মানিক সরদার, রতন শেখ, জয়নুদ্দিন শেখ ও আব্দুল বারেক মোল্লাকে গুলি করে হত্যা করে। এ সময় বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এ ঘটনায় আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(জি) ও (এইচ) এবং ৪(১) ধারায় লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ ১০: একাত্তরে ১ জুন ভোরে আসামি খোকন রাজাকারের নেতৃত্বে আতাহার রাজাকার, আয়নাল রাজাকারসহ অন্যরা এবং পাকিস্তানি সেনারা বাগত ও চুরিয়াচর গ্রামে গিয়ে বাড়ি বাড়ি লুটপাট চালায় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় আওয়ামী লীগের সমর্থক মিনি বেগমের বাড়িতে গিয়ে তার বাবা মালেক মাতব্বর, ভাই মোশাররফ মাতব্বর, দাদী, নানী ও আমজাদ মুন্সীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এছাড়া রতন মাতব্বর, আইয়ুব। আলী ও মঞ্জু রাণীসহ ১০/১৫জন গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় আসামির বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(জি) ও (এইচ), ৩(২)(সি)(জি) এবং ৪(১) ধারায় গণহত্যা, হত্যা ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের (লুটপাট, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি) অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ ১১: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১ জুলাই থেকে ১৭ জুলাইয়ের মধ্যে কোনো একদিন আসামি খোকন রাজাকারের নেতৃত্বে আতাহার রাজাকার, আয়নাল রাজাকারসহ অন্যরা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে জঙ্গুরদিয়া-বাগুটিয়া গ্রামে কানাইলাল মণ্ডলের বাড়িতে যায়। কানাইলাল তাদের আসতে দেখে পাশের পাটক্ষেতে আত্মগোপনের চেষ্টা করেন। কিন্তু খোকন রাজাকার সেখান থেকে তাকে ধরে এনে বাড়ির দক্ষিণ পাশের রাস্তায় নিয়ে গুলি করে। কানাইলালের ডান হাতে গুলি লাগলেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান এবং ১৮ থেকে ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে কোনো একদিন ভারতে পালিয়ে যান।
এ ঘটনায় আসামির বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(জি) ও (এইচ) এবং ৪(১) ধারায় গুলিতে জখম করা, দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
আজ ১২ই নভেম্বর ২০১৪ বৃহস্পতিবার তার রায় ঘোষণা করা হলো ।

কোন মন্তব্য নেই: