সোমবার, ১৬ জুন, ২০১৪

ছয় দফা আন্দোলন




৭ই জুন বাঙালির জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন

  পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বাঙালি জাতিকে গোলামির শৃঙ্খলে চিরস্থায়ীভাবে শৃঙ্খলিত করার জন্য যে ষড়যন্ত্র করেছিল, তার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, ৬৬ এর ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলের এক কনভেনশনে বাংলার গণমানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবি সম্বলিত বাঙালির ম্যাগনাকার্টা খ্যাত ঐতিহাসিক ছয় দফা উত্থাপন করে তা বিষয়সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন কিন্তু সভার সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ছয় দফা দাবি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় অস্বীকৃতি জ্ঞপন করলে ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে ঢাকা বিমান বন্দরে সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন ও ২০ ফেব্রুয়ারি তারিখে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ডেকে ছয় দফা অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নেন অতঃপর ফেব্রুয়ারি ২০ তারিখ আওয়ামীলীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ছয় দফা দলীয় কর্মসূচী হিসাবে গ্রহন করা হয়


 
ছয় দফা প্রচার ও প্রকাশের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় সদস্য বিশিষ্ট উপ-কমিটি গঠন করা হয় এবং তারই নামে পুস্তকটি মুদ্রিত হয় একই বছরের মার্চের ১৮,১৯ ও ২০ তারিখ ছিল আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অধিবেশন এ দিন কাউন্সিল সভায় পুস্তিকাটি বিলি করা হয় ছয় দফা কর্মসূচির দলীয় কর্মীদের মধ্যে বিশেষ করে তরুন ছাত্রলীগ নেতৃত্বের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে পরবর্তী সময়ে ছয় দফা এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, বাংলার প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে এই পুস্তিকা সযত্নে রক্ষিত হয়েছিল ছয় দফা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলতেন, সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য
 
বস্তুত, ছয় দফা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্র তথা অঙ্কুর ছয় দফার পক্ষে জনমত সংগঠিত করতে ৬৬ এর মার্চে অনুষ্ঠিত আওয়ামীলীগের তিন দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ   সে দিনের সেই কাউন্সিল সভার আগত ১৪৪৩ জন কাউন্সিলর বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগের সভাপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারন সম্পাদক ও মিজানুর রহমান চৌধুরীকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত করে ছয় দফার ভিত্তিতে সংশোধিত দলীয় গঠনতন্ত্রের একটি খসড়াও অনুমোদন করা হয় কাউন্সিলে
 
ছয় দফা কর্মসূচী প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে ছয় দফার ভিত্তিতে দলীয় গঠনতন্ত্র এবং নেতৃত্ব নির্বাচনে যে পরিবর্তন সাধিত হয় তা পরবর্তীকালে ছয় দফার চূড়ান্ত পরিণত এক দফা তথা স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের ইঙ্গিতবাহী ছিল আওয়ামীলীগের এ কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল বাঙালির ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তন যা ৬৯ এর মহান গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর ঐতিহাসিক নির্বাচন ও ৭১ এর মহত্তর মুক্তিযুদ্ধের পতভুমি তৈরি করেছিল কাউন্সিল সভার সমাপনী জনসভায় বঙ্গবন্ধু মুজিব বলেছিলেন, “ছয় দফার প্রশ্নে কোন আপোষ নাই রাজনীতিতে কোন সংক্ষিপ্ত পথ নাই নেতৃবৃন্দের ঐক্যের মধ্যেও আওয়ামীলীগ আর আস্থাশীল নয় নির্দিষ্ট আদর্শ ও সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের ঐক্যেই আওয়ামীলীগ বিশ্বাস করে আওয়ামীলীগ নেতার দল নয়, এ প্রতিষ্ঠান কর্মীদের প্রতিষ্ঠান শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই ছয় দফা আদায় করতে হবে কোন হুমকিই ছয় দফা আন্দোলনকে প্রতিরোধ করতে পারবে না ছয় দফা হচ্ছে বাঙালির মুক্তি সনদ” স্বভাবসুলভ কণ্ঠে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “ যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে” উদ্ধৃত করে বলেছিলেন এই আন্দোলনে রাজপথে যদি আমাদের একলা চলতে হয় চলব ভবিষ্যৎ ইতিহাস প্রমান করবে বাঙালির মুক্তির জন্য এটাই সঠিক পথ বঙ্গবন্ধু জানতেন, ছয় দফাই কেবল বাঙালির স্বাধিকার তথা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করে অখণ্ড পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ পাঞ্জাবিরা ছয় দফা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সংখ্যাগুরু বাঙালির রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহণ ঠেকাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে যা পরিনামে স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল
 
কি ছিল ছয় দফাতেঃ

১ নং দফাতে বলা হয়েছিল, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ফেডারেল রাষ্ট্র , সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, সার্বজনীন ভোটাধিকার এবং এর ভিত্তিতে সরাসরি ভোটে নির্বাচন

২ নং দফাতে, ফেডারেল সরকারে দুটো বিষয় ন্যস্ত থাকবে, প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র, অন্য সব বিষয় ফেডারেশনের ইউনিটগুলোর হাতে ন্যস্ত থাকবে
 
৩ নং দফাতে দুটি পৃথক অথচ অবাদে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা দুই অঞ্চলে প্রবর্তন, অথবা একক মুদ্রা কিন্তু সে ক্ষেত্রে পূর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার বন্ধে শাসনতান্ত্রিক বিধান থাকতে হবে পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভ রাখতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক রাজস্ব ও মুদ্রানীতি গ্রহন করতে হবে
 
৪ নং দফাতে ফেডারেশনের ইউনিটগুলোর হাতে করারোপ ও রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষমতা ন্যস্ত থাকবে ফেডারেল কেন্দ্রের হাতে এরকম কোন ক্ষমতা থাকবে না তবে কেন্দ্র তার নিজ ব্যয় বা চাহিদা মেটানোর জন্য প্রদেশগুলোর করের একটা অংশ পাবে
 
 ৫ নং দফায় দেশের দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের জন্য দুটি পৃথক বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রার হিসাব রাখা, এ দেশের অর্জিত বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রা এ দেশের সরকারের নিয়ন্ত্রনে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের নিয়ন্ত্রনে থাকবে, ফেডারেল সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন দুই অঞ্চল করতিক সমান হারে অথবা নির্ধারণযোগ্য অনুপাতে দুই অঞ্চলের মধ্যে শুল্কমুক্তভাবে অবাদে চলাচল করবে, সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে ফেডারেশনভুক্ত ইউনিটের সরকারগুলো বিদেশে বাণিজ্য মিশন খোলা এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করবে
 
৬ নং দফাতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি সামরিক বা আধাসামরিক বাহিনী গঠন করতে হবে ছয় দফার মুল বিষয়বস্তু ছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ছয় দফার পক্ষে জনগনের এই স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের কারন হচ্ছে , এই দাবিগুল প্রকৃতপক্ষে শুধু বাংলা নয়, তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষেরও দীর্ঘকালের দাবি
 
বাংলার মানুষের মুক্তিসনদ ছয় দফা ঘোষণার পর জনমত সংগঠিত করতে বঙ্গবন্ধু তার সফরসঙ্গীসহ উত্তরাঞ্চলে যান ৬৬ এর ৭ এপ্রিল ওই দিন পাবনায় এক বিরাট জনসমাবেশে তিনি বক্তৃতা করেন অতঃপর ৮ তারিখ বগুড়া, ৯ তারিখ রংপুর, ১০ তারিখ দিনাজপুর, ১১ তারিখ রাজশাহী, ১৪ তারিখ ফরিদপুর, ১৫ তারিখ কুষ্টিয়া, ১৬ তারিখ যশোর এবং ১৭ তারিখ খুলনা বিশাল সব জনসভায় ছয় দফার বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণসহ বক্তৃতা করেন এভাবে সারা দেশে ৩৫ দিনে মোট ৩২ টি জনসভায় তিনি বক্তৃতা করেন বঙ্গবন্ধুর ঝটিকা সফরে ছয় দফার স্বপক্ষে জনমত প্রবল হয়ে ওঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের ওপর নেমে আসে নির্মম গ্রেফতার-নির্যাতন প্রত্যেক জেলায় অনুষ্ঠিত সভায় প্রদত্ত বক্তৃতার প্রতিপাদ্য বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধুকে প্রত্যেক জেলা থেকে জারিকৃত ওয়ারেন্ট বলে গ্রেফতার প্রক্রিয়া চলতে থাকে
 
এপ্রিলের ১৭ তারিখ রাত ৪ টায় খুলনায় এক জনসভায় ভাষণ দান শেষে ঢাকা ফেরার পথে রমনা থানার জারিকৃত ওয়ারেন্ট অনুযায়ী পাকিস্তান দেশ রক্ষা আইনের ৪৭(৫) ধারা বলে পুলিশ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে যশোর মহকুমা হাকিমের এজলাস থেকে তিনি জামিন পান এর পর শে দিনই রাত ৯ টায় সিলেটে গ্রেফতার, পুনরায় জামিনের আবেদন, ২৩ তারিখ জামিন লাভ ২৪ শে এপ্রিল ময়মনসিংহে গ্রেফতার, ২৫ এপ্রিল জামিন এভাবেই আইয়ুবের দমন নীতি চলতে থাকে একই বছরে ৮ মে নারায়নগজ্ঞের চাষাঢ়ায় ঐতিহাসিক মে দিবস স্মরণে শ্রমিক জনতার এক বিরাট সমাবেশে শ্রমিকরা বঙ্গবন্ধুকে বিপুল সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে এবং পাটের মালায় ভূষিত করে ভাষণদান শেষে রাত ১ টায় তিনি যখন বাসায় ফেরেন তখন পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৩২(১) ধারা বলে তাকে সহ তার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মীদের গ্রেফতার করে ছয় দফা দেওয়ার অপরাধে বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিহিত করা হয় এরপর দেশরক্ষা আইনের আওতায় চলতে থাকে আওয়ামীলীগের ওপর অব্যাহত গ্রেফতার-নির্যাতন সামরিক সরকারের এহেন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগের আহ্বানে ১৩ মে সমগ্র প্রদেশে প্রতিবাদ দিবস পালিত হয় এর পরপরই দলের নবনির্বাচিত সাধারন সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে গ্রেফতার করা হলে সাংগঠনিক সম্পাদক মিজান চৌধুরী অস্থায়ীভাবে সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহন করেন নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ২০ মে আওয়ামীলীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ৭ জুন হরতাল আহ্বান করা হয় ৭ জুনের হরতাল সমগ্র পূর্ববাংলা যেন অগ্নিগর্ভ বিক্ষুদ্ধ মানুষ সে দিন স্বাধিকার ও বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল তোফায়েল আহমেদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের ( বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি শেখ ফজলুল হক মনি এর নেতৃত্বে নেতা কর্মীঃ সর্ব জনাব সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, আমীর হুসেন আমু, সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী, আবদুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, নুরে আলম সিদ্দিকী সহ আরও অনেকে সেদিন হরতাল কর্মসূচী পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে মনি ভাই এসেছেন হরতালের পক্ষে প্রচার কাজ চালানোর জন্য তিনি তখন ছাত্র নন ডঃ ওদুদুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ছিলেন তিনি মনি ভাইকে বললেন, মনি, তুমি এখন ছাত্র নও তুমি ক্যাম্পাসে অবস্থান করো না, চলে যাও তুমি যদি না যাও তবে আমার চাকরি যাবে মনি ভাই সকলকে হরতাল কর্মসূচী যথাযথভাবে পালনের নির্দেশ দিয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন সে দিনের হরতাল কর্মসূচিতে ধর্মঘটীয় ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য সরকারের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী নির্বিচার গুলিবর্ষণ করে ফলে তেজগাঁয় শ্রমিক মনু মিয়া, মুজিবুল্লাহ সহ ১১ জন শহীদ হন এবং ৮০০ লোককে গ্রেফতার করা হয় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে হরতাল সফল করার দায়িত্বে ছিলেন ছাত্রনেতা খালেদ মোহাম্মদ আলী ও নূরে আলম সিদ্দিকী তারা সেখানে বক্তৃতা করেন    

প্রকৃতপক্ষে ৭ জুন স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথের আরম্ভস্থল তথা যাত্রাবিন্দু সে দিনই ছাত্রলীগের রাজনৈতিক চেতনার ভিত্তিও স্থাপিত হয়েছিল ১৯৫২ এর ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬২ এর ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ এর ৭ জুন ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯ এর ১৭ থেকে ২৪ জানুয়ারি গণআন্দোলন-গনঅভ্যুত্থান, ৯ ফেব্রুয়ারি ১১ দফা বাস্তবায়ন ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে শপথ দিবস পালন, স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পদত্যাগ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ১৫,১৬,১৭,১৮,১৯, ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারি লাগাতার সংগ্রাম শেষে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম প্রদান, ২২ ফেব্রুয়ারি সব রাজবন্দীর মুক্তির পর বংবন্ধুর মুক্তিলাভ, এরপর ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ১০ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে মুক্ত মানব শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাদি প্রদান
পঞ্চাশের দশক থেকে বাঙালি জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের লক্ষ্যে গড়ে তোলা সব আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রলীগ এসব মহিমান্বিত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ অর্জন করেছিল গণতান্ত্রিক তথা নিয়মতান্ত্রিক আচরন ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং জয় করে নিয়েছিল বাংলার মানুষের হৃদয় আর সৃষ্টি করেছিল ইতিহাস স্বাধীনতার পূর্বে ছাত্রলীগের সম্মেলন গঠনতন্ত্র মোতাবেক প্রতি বছর ২১ মার্চের মধ্যে সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা ছিল তা না হলে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটির কাছে নেতৃত্ব তুলে দিতে হতো এটাই ছিল বিধান এবং গঠনতান্ত্রিক বিধিবিধানের অন্যথা হওয়ার কোন সুযোগ ছিল না বিধান মোতাবেক ৬৯ এর গনঅভ্যুত্থানের পর তোফায়েল আহমেদ ছাত্রলীগের সভাপতি এবং আ স ম আব্দুর রব সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে এক বছর পর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ২১ মার্চের মধ্যে সম্মেলন করে নূরে আলম সিদ্দিকী এবং শাজাহান সিরাজের কাছে নেতৃত্বের দায়িত্ব অর্পন করেন
 ছয় দফা প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তানি শাসকগুষ্ঠি বহু ষড়যন্ত্র করেছে কিন্তু ছয় দফার প্রতি বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় স্থির-প্রতিজ্ঞাবোধ তাকে জনমনে অধিনায়কের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে ৬৬ এর ৮ মে বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে নিক্ষেপ করে তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিয়েও ছয় দফার আন্দোলনকে যখন রোধ করা যাচ্ছিল না, তখন বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে চিরতরে তার কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ষড়যন্ত্রমূলক আগরতলা মামলা দেন ছয় দফা দাবি আদায়ে এবং বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করতে বাংলার সর্বস্তরের মানুষসহ যারা ছাত্র জনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল তারা ৬৯ এর জানুয়ারির ৪ তারিখে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনটিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ছয় দফাকে দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন সমেত ১১ দফায় অন্তর্ভুক্ত করে সারা বাংলার গ্রামগঞ্জে, শহর-বন্দরে, কল-কারখানায় ছড়িয়ে দিয়েছিল ফলশ্রুতিতে ১১ দফা আন্দোলনের পক্ষে সারা দেশে যে গনজোয়ার তৈরি হয়, তাতে দেশে বৈপ্লবিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে এমতাবস্থায় শাসকশ্রেণী এই আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে ছাত্রদের বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিত্রিত করে তাদের এই অপপ্রয়াসের সমুচিত জবাব দিতে ৬৯ এর ৯ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের শপথ দিবসে জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্দেশে তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, “পূর্ববাংলার মানুষ কোন দিন বিচ্ছিন্নতাকে প্রশ্রয় দেয়নি এবং বিচ্ছিন্নতায় বিশ্বাসীও নয় কারন তারা সংখ্যায় শতকরা ৫৬ জন যদি কারও পূর্ববাংলার সঙ্গে থাকতে আপত্তি থাকে, তবে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে”   

নেতাদের এই নির্দেশ ছাত্ররা পাকিস্তানিরা গনহত্যা চালানোর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মেনে চলেছে নিয়মতন্ত্রের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম পরিচালনা করেছেন বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগে ছাত্রদের কখনোই অভিযুক্ত করা যায়নি
 
৭ জুনের হরতাল সম্পর্কে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া দৈনিক ইত্তেফাকে লিখেন, যদিও প্রতিক্রিয়াশীলরা অতিতের মতোই বিধি-নিষেধ আরোপকে ব্যবস্থাদির পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে এবং মাত্র একটিবারের জন্য হলেও ইতিহাসের পুরনো পাতার প্রতি দৃকপাত মাত্র না করেই ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে, তবু এবার জনগন তাদের পূর্ণ অধিকার আদায়ে সংকল্পবদ্ধ
ছয় দফার পক্ষে ৭ জুনের হরতাল এতটাই সর্বব্যাপী ছিল যে, এ সম্পর্কে কোন রকম প্রতিবেদন মুদ্রন ো প্রকাশের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা বলবত ছিল বিধিনিষেধ সত্ত্বেও মানিক মিয়া তার কলামে লিখেন, ছয় দফা আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গৃহীত নিষ্ঠুর ব্যবস্থাদির কারনে মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে একমাত্র সান্ত্বনার বিষয় হলো এই যে, জনসাধারন ছয় দফা আন্দোলন তথা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে তাদের নিজেদের আন্দোলন হিসেবে গ্রহন করেছে
 
ছয় দফার পক্ষে ৭ জুনের সর্বাত্মক হরতাল কর্মসূচির পক্ষে জনমত তৈরিতে ইত্তেফাকের ভুমিকায় ক্ষুদ্ধ হয়ে ৬৬ এর ১৬ জুন পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির ৩২(১) ধারার আওতায় মানিক মিয়াকে গ্রেফতার এবং দ্য নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করে সামরিক জান্তা পরিবর্তীতে ৬৯ এর গনঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দৈনিক ইত্তেফাক এবং বাজেয়াপ্তকৃত নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসটি ফেরত প্রদানে স্বৈরশাসক বাধ্য হয়েছিল
 
মুলত ছয় দফা দাবি আদায় ও পাকিস্তানের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন থেকে মুক্তির জন্যই ৭ জুন হরতাল পালন ও সংগ্রাম করেছিল ৭ জুনের হরতালে মুজিবুল্লাহ, মনু মিয়া সহ অসংখ্য মেহনতি মানুষ বুকের তাজা রক্ত দিয়ে স্বাধিকারের দাবি ছয় দফা লিখে গেছেন, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করেছেন ৭ জুনে যে সার্বভৌম পার্লামেন্টের দাবিতে ছয় দফার পক্ষে সংগ্রাম করেছিল সকলে, সেই কর্মসূচির ফলশ্রুতিই হচ্ছে আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ৭ জুন ছিল এর সূচনা বিন্দু  






















তোফায়েল আহমেদের লেখা থেকে- 











 

 



  

কোন মন্তব্য নেই: