মঙ্গলবার, ২৯ মার্চ, ২০১৬

তেজপাতার পুষ্টিমান ও উপকারিতা



তেজপাতা সুগন্ধি মসলা। কাঁচা পাতার রং সবুজ আর শুকনো পাতার রং বাদামি। এটি শুধু মসলা হিসেবেই পরিচিত নয়, এর অনেক ঔষধি গুণও আছে। সাধারণত রান্নায় স্বাদ ও সুগন্ধ আনতে তেজপাতা ব্যবহার করা হয় বলেই আমরা জানি।  সুগন্ধ বাড়ানোর ছাড়াও এই খাদ্য উপাদানটির  আরো অনেক গুণ রয়েছে

পরিচিতিঃ   বৃক্ষ পর্যায়ভূক্ত এই গাছটি মাঝারি ধরনের উঁচু এবং গন্ধ বিশিষ্ট। ঈষৎ লাল আভাযুক্ত ধূসর বর্ণের কান্ড। পাতা ৭/৮ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে দেখা যায়। পাতাগুলো বিপরীতভাবে বিন্যস্ত, এগুলি কচি অবস্থায় লাল, পরে সবুজ হয়ে যায়। মার্চ-এপ্রিল মাসে ফুল ও ফল হয়। ফলগুলি পাকলে কালো বর্ণের হয়ে থাকে।
বাংলা নামঃ        তেজপাতা
ইংরেজীঃ           Tejpat

বৈজ্ঞানিক নামঃ  Cinnamomum tamala
পরিবারঃ         Lauraceae



তেজপাতার পুষ্টিমানঃ  
তেজপাতা ভিটামিন ও মিনারেলে ভরপুর। এতে প্রচুর ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও পটাশিয়াম রয়েছে। এ ছাড়া ১০০ গ্রাম তেজপাতা থাকে 

সোডিয়াম
২৩ মিলিগ্রাম
আয়রন
৪৩ মিলিগ্রাম
জিংক
৩.৭ মিলিগ্রাম
সিলেনিয়াম
২.৮ মিলিগ্রাম
শর্করা
৬.৯ থেকে ৩২ %
প্রোটিন
৩.১ থেকে ৩.৪ %
ফাইবার
১২ থেকে ২৮ %
পানি
৬.৫ থেকে ১৯.৯০ %
উদ্বায়ী তেল
১.০ থেকে ৫.১০ %



ফসল তোলাঃ  চারা লাগানোর ৪/৫ বৎসর পর থেকে প্রত্যক শীতকালে পাতা সংগ্রহ করা যায় এবং ১টি গাছ থেকে ১০০ বছর বয়স পর্যন্ত পাতা  সংগ্রহ করা যেতে পারে। স্বাস্থ্যবান  ও কম বয়সী গাছ থেকে প্রত্যেক বছর পাতা সংগ্রহ করা গেলেও রুগ্ন ও বেশী বসয়ী গাছ থেকে ১ বছর অন্তর পাতা সংগ্রহ করা উচিত। বৃষ্টিতে পাতার সুগন্ধ নষ্ট হয়ে যায় বিধায় অক্টোবর-মার্চ মাস পর্যন্ত পাতা সংগ্রহ করা হয়ে থাক।  গাছ থেকে পাতা তোলার পর ৫-৭ দিন ছায়াতে শুকিয়ে নিয়ে বিক্রয়ের জন্য বস্তায় ভরা হয়।


আয়ুর্বেদী মতে 
তেজপাতাকে পুষ্ট ও যৌনশক্তি বর্ধক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। মস্তিষ্ক, যকৃত, প্লীহা, অন্ত্র ও পাকস্থলীর ব্যথার উপসম করে।

তেজপাতার উপকারিতা বা গুনাগুণঃ তেজপাতা পাতা বাতব্যধি, আমবাত প্রভৃতিতে ব্যবহৃত হয়। পাতার ক্কাথ সন্তান প্রসবের পর প্রসূতিকে খেতে দিলে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়। ফল থেকে একপ্রকার উদ্ধায়ি তেল পাওয়া যায় এবং তা বিভিন্ন ঔষধে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।







১। তৃষ্ণা রোগেঃ   এক্ষেত্রে ৫ গ্রাম তেজপাতা এক লিটার জলে সিদ্ধ করে আধ লিটার থাকতে নামিয়ে, সেটা ছেকে, পিপাসা লাগলে অথবা না লাগলেও দুই-তিন বারে ঐ জলটা খেতে হবে। এর দ্বারা ঐ তৃষ্ণা রোগটা উপশমিত হবে।
২। পেটের পীড়ায়ঃ  তেজপাতা বেটে এর রস খাইলে পেটের পীড়া ভাল হয় ।
। চুলকুনিতেঃ  এটা রক্তবহ স্রোতের বিকারে হয় কিন্তু রক্ত বিকারে হয় না, এই ক্ষেত্রে ৫ গ্রাম তেজ পাতা কুচিয়ে, একটু থেতো করে ৫/৬ কাপ জলে সিদ্ধ করার পর আন্দাজ দুই কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে প্রত্যহ সেটা দুই/তিন বারে খেতে হবে। এই রকম কয়েকদিন খেলে রক্তবহ স্রোতের বিকার নষ্ট হবে। আরও ভাল হয় যদি ১০/১৫ গ্রাম তেজ পাতা সিদ্ধ করে সেই জলে স্নান করা যায়। এর দ্বারা স্রোত বিকার জনিত চুলকনা সেরে যাবে।
। লাবন্য হানিতেঃ  খাওয়া দাওয়া ও খারাপ নয় অথচ দিনে দিনে দেহের রং তামাটে হয়ে যাচ্ছে যেন একটা কালো ছোপ পড়ে গেছে । এর মূল কারন কিন্তু রক্তবহ স্রোতের বিকৃতি। সেক্ষেত্রে ৫/৬গ্রাম তেজ পাতা কুচিয়ে, থেতো করে আন্দাজ ২ কাপ গরম জলে ১০/১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে, সেটাকে ছেকে দুইবারে খেতে হবে। এই রকম অন্ততঃ ২ সপ্তাহ খাওয়া দরকার। শুধু তাই নয়, নিত্য ভোজা ব্যঞ্জনাদিতেও তেজ পাতা বাটা একটু করে দিতে হবে। এর দ্বারা লাবন্য ফিরে আসবে।
৫। স্মৃতিশক্তিঃ  স্মৃতিশক্তি নষ্ট করার জন্য যে এনজাইম দায়ী , তেজপাতা তাকে বাধা দেয় ।
৬। হজমেঃ  তেজপাতা হজমে সহায়তা করে ।
। রক্ত মূত্রেঃ   প্রস্রাব রক্তবর্ণ থাকলেও সেটা রক্ত নয় ওটা বিদগ্ধ পিত্ত, এই বিদগ্ধ পিত্তের উদ্ভব হয় অজীর্ণ দোষে, রাত্রি জাগরণে, রুক্ষ আহারে ও বিহারে, অত্যধিক ভ্রমনে হতে পারে। এক্ষেত্রে ৫/৭ গ্রাম তেজ পাতা থেতো করে ২ বা ৩ কাপ গরম জলে ঘন্টা দুই ভিজিয়ে রেখে, সেটা ছেকে নিয়ে ২/৩ ঘন্টা ব্যবধানে দুবারে খেতে হবে, এর দ্বারা ঐ রক্তবর্ণ প্রস্রাব আর হবে না, তবে একদিনে না হলেও ২/৩দিনে নিশ্চয়ই চলে যাবে।
৮। কোলেস্টরেলঃ  তেজপাতা রক্তের খারাপ কোলেস্টরেল কমায় ।
।স্বরভঙ্গঃ   সর্দি হয়ে বা উচ্চভাষণজনিত যে স্বরভঙ্গ সেই স্বরভঙ্গে ৫/৭গ্রাম তেজপাতা থেতো করে ৩ বা ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করতে হবে, সেটা সিদ্ধ হওয়ার পর এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে ঐ জলটা সিদ্ধ করতে হবে, সেটা সিদ্ধ হওয়ার পর এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে ঐ জলটা ৫/৬ ঘন্টার মধ্যে ৩/৪বারে একটু একটু করে খেতে হবে, এর দ্বারা এই স্বরভঙ্গটা চলে যাবে।


১০। তন্দ্রা রোগেঃ  প্রচলিত ভাষায় একে বলে ঢুলুনি এটাও রোগ। এটাকে উপেক্ষা করা উচিত নয়, আর এ রোগ যেকোন বয়সেই আসতে পারে। মেদোবহ স্রোত বিকারগ্রস্ত হলে এই রোগের সৃষ্টি হয়। এদের একটা বিশেষ লক্ষণ থাকে- পায়ের ডিম (জানুর নিচে পিছনের মাংস পেশী) দুটোয় ব্যথা, তাঁরা হাত পা টেপানোটা বেশী পছন্দ করেন। এই রোগ চলতে থাকলে পরিনামে নিন্নাঙ্গে পক্ষাঘাতও হতে পারে। এর প্রতিকারের জন্য ৫/৭ গ্রাম করে তেজ পাতা ৩/৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে বেশ কিছুদিন খেতে হয়। এর দ্বারা পক্ষকালের মধ্যে উপকার পাওয়া যায়।
১১। হৃদযন্ত্রঃ তেজপাতা হৃদযন্ত্রের পেশির কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে । হৃদ রুগীদের সুস্থ থাকতে সাহায্য করে ।
১২। স্মৃতি ভ্রংশেঃ  আশু প্রতিকারের জন্য তেজ পাতা ৫/৭ গ্রাম থেতো করে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করার পর এক বা দুই কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেকে সকালে ও বৈকালে দুবারে খেতে হবে। ১৫/২০ দিন খেলেই কিছুটা উপকার হয়।
১৩।দাদেঃ  যে দাদ ছোঁয়াচে হয়ে এসেছে, সেই ক্ষেত্রে এই তেজ পাতা ৫ গ্রাম উপরিউক্ত নিয়মে সিদ্ধ করে, ছেকে সেই জলটা খেতে হবে, আর ঐ জলে একটু তুলো ভিজিয়ে ঐ দাদের জায়গাটা মুছে দিতে হবে। এর দ্বারা উপশম হবে।
১৪। চোখ ওঠায়ঃ  দুখানা তেজপাতা গরম জলে ধুয়ে নিয়ে তাকে একটু থেতো করে সিকি কাপ গরম জলে কয়েক ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে, তারপর পরিস্কার ন্যাকড়ায় সেটা ছেকে নিয়ে সেই জল চোখে দিতে হবে। এই রকম সকালে ও বৈকালে দুবার দিলে চোখ লাল হওয়া, কর্ কর্ করা, পিচুটিপড়া, জুড়ে যাওয়া এগুলি সেরে যাবে। অবশ্য দুই/তিন দিন দিতে হয়।
। মাড়ির ক্ষতেঃ  এই ক্ষত রক্তবহ স্রোত বিকার হলে তবেই হয়, সেই ক্ষেত্রে তেজপাতা চূর্ণ দিয়ে দাঁত মাজলে এই ক্ষত সেরে যায়। 
। অরুচিতেঃ কয়েকখানা তেজপাতা জলে সিদ্ধ করে, ছেকে সেই জলে কুল্লি করলে অরুচি সেরে যায়।
। গাত্র দৌর্গন্ধেঃ  তেজপাতা চন্দনের মত করে বেটে সেইটা গায়ে মাখলে গায়ের দুর্গন্ধ হওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
। অত্যধিক ঘর্মেঃ   যাঁদের বেশী ঘাম হয় তাঁরা প্রত্যহ একবার করে তেজপাতা বাটা মেখে আধ ঘন্টা থাকার পর স্নান করে ফেলবেন। এর দ্বারা অত্যধিক ঘাম হওয়াটা কমে যাবে।
। ফোঁড়ায়ঃ  সাধারনতঃ গরমের দিনে যেসব ফোঁড়া হয়, সেসব ফোঁড়ার খুব বিষুনি-টাটানি থাকে, সেই সব ফোঁড়ায় তেজপাতা বেটে প্রলেপ দিলে বিষুনি-টাটানি ও শক্ত আঁটির মত যেগুলি রয়েছে, সেটাও কমে যাবে। সবদিকের উপকার হবে।
২০। ঘামাচিতেঃ  বরফ মাখতে হবে না আর পাউডার মাখারও দরকার নেই, কিংবা বৃষ্টিতেও ভিজতে হবে না, কেবলমাত্র তেজপাতা চন্দনের মত করে বেটে, গায়ে মেখে ঘন্টাখানেক থাকার পর স্নান করে ফেলতে হবে। সাবান দেওয়ার দরকার নেই। এটাতে গায়ের ময়লাও কেটে যাবে আর ব্যাঙের গায়ের মত গায়ের চামড়ার যে অবস্থা হয়েছিলো সেটাও আর থাকবে না।

২১।  শরীরের ময়লা দূর করতে তেজপাতা বেটে শরীরে মেখে গোসল করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।

২২। যাঁদের অতিরিক্ত ঘাম হয়, তার প্রতিদিন ১ বার করে তেজপাতা বাটা মেখে আধ ঘন্টা থাকার পর গোসল করে নিলে বেশি ঘাম হওয়া কমে যাবে। এইভাবে ৭ দিন করতে হবে। 







কোন মন্তব্য নেই: