মঙ্গলবার, ৫ জানুয়ারী, ২০১৬

আমলকীর পুষ্টিমান উপকারিতা




আমলকী ফল গোলাকৃতি, রঙ হালকা সবুজ। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই আমলকীর গাছ দেখতে পাওয়া যায়। গাছের বয়স ৪-৫ বছর হলেই গাছ থেকে ফল পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত,মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা , মালয়শিয়া ও চীনে আমলকী পাওয়া যায়।

আমলকীতে রয়েছে ভিটামিন সি,ডায়েটারি ফাইবার, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, ক্যারোটিন, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট। এইসব উপাদান আমাদের শরীরের জন্য দারুন উপকারী। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ আমলকীতে রয়েছে প্রচুর পরিমান অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট।


খেতে একটু ভিন্ন ধরণের স্বাদ বলে অনেকেই এই ফলটি পছন্দ করেন না। আবার অনেকে বেশ পছন্দ করেই খেয়ে থাকেন আমলকি। এই ফলের মজার একটি বৈশিষ্ট্যও আছে। আর তা হলো চিবিয়ে খাওয়ার সময় কিছুটা টক ও তেতো লাগলেও এই ফলটি খেয়ে পানি খেলে মিষ্টি লাগে।

দেশী নামঃ  আমলকী
ইংরেজী নামঃ  Aowla (Emblica)
অন্যান্য নামঃ  আমলকীর ইউনানী নাম আমলা,  আয়ুর্বেদিক নাম ধাত্রী, শ্রীফল বা অসৃত ফল(আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রে একে রোটিনও বলা হয়)।
বৈজ্ঞানিক নামঃ  phyllanthus emblica.
জন্মস্থানঃ  আমলকীর আদিভূমি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হলেও ফলটি সবচেয়ে ভালো জন্মে পাহাড়ে।



পুষ্টিমানঃ
১০০ গ্রাম আমলকীতে থাকেঃ  
উপাদান
পরিমান
ভিটামিন সি
৪৬৩ মিলিগ্রাম
শর্করা
১৬.২০ গ্রাম
আঁশ
৩.৪০ গ্রাম
খাদ্য শক্তি
৭০ কিলো ক্যালরি
ক্যালরি
৩২ কিলো ক্যালরি
ক্যারোটিন
৪৭০০ মিলিগ্রাম
ক্যালসিয়াম
৩৪ মিলিগ্রাম
পানি
৯১.৪০ গ্রাম
খনিজ পদার্থ
০.৭০ গ্রাম
প্রোটিন
০.৯০ গ্রাম
আয়রন
১.২ মিলিগ্রাম
ভিটামিন বি১
১০.০২ মিলিগ্রাম
ভিটামিন বি২
২০.০৮ মিলিগ্রাম


অন্য যে কোন ফলের চেয়ে আমলকীতে ভিটামিন সির পরিমাণ দ্বিগুণ থেকে ১০০গুণও বেশি থাকে। এছাড়াও রয়েছে ভিটামিন প্রচুর পরিমাণে এ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান সহ রয়েছে ট্যানিন, লিপিড ও বিভিন্ন জৈব এসিড।

 একটি আমলকীতে রয়েছেঃ
আপেলের চেয়ে ১২০ গুণ, কমলার চেয়ে ১৫ গুণ, পেয়ারার চেয়ে ২.৫ গুণ, লেবুর চেয়ে ৪.৫ গুণ, আমের চেয়ে ২৪ গুণ, কলার চেয়ে ৬০ গুণ এবং আমড়ার চেয়ে ৫ গুণ বেশি ভিটামিন সি।
  



আমলকীর উপকারিতাঃ  

১।  আমলকীর টক ও তেতো মুখে রুচি ও স্বাদ বাড়ায়।
২।  রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ।  
৩।  মানসিক চাপ কমায়।
৪।  কফ, বমি ও অনিদ্রা দূর করে ।
৫। ব্যথা-বেদনা নিরাময়ে আমলকী অনেক উপকারী।
৬।  হাপানী, কাশি, বহুমূত্র, অজীর্ণ রোগে ভাল কাজ করে ।  
৭।  জ্বর নিরাময়ে বিশেষ কার্যকরী।
৮।  সর্দি-কাশি, পেটের পীড়া ভাল করে ।  
৯।  রক্তশূন্যতা দূরীকরণে বেশ ভালো কাজ করে।
১০।  হজম শক্তি বৃদ্ধি ও বমিবমি ভাব দূর করে। স্টমাক এ্যাসিডে ব্যালেন্স বজার রাখে।
১১।  নতুন রক্ত, গোশত ও হাড় তৈরীতে বিশেষভাবে কাজ করে।
১২।  শরীর ঠাণ্ডা রাখে, শরীরের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে, মাসল টোন মজবুত করে।
১৩।  এটি হৃদযন্ত্র, ফুসফুসকে শক্তিশালী করে ।  
১৪। মস্তিষ্কের শক্তিবর্ধন করে।
১৫।  শরীরের অপ্রয়োজনীয় ফ্যাট ঝরাতে সাহায্য করে।
১৬।  লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা বাড়িয়ে তুলে ।
১৭।  দাঁত ও নখ ভাল রাখে।
১৮।  ত্বক ও চুল সুস্থ ও সুন্দর করে। শুকনো আমলকী চুল বৃদ্ধি করে।
১৯।  সানবার্ন, সানস্ট্রোক থেকে রক্ষা করার উত্তম উছিলা।
২০।  পায়খানা স্বাভাবিক রাখে ।




২১।  পুরুষের দেহে বীর্যবর্ধক হিসেবে কাজ করে।
২২।   এ্যাজমা, পাইলস, ব্রঙ্কাইটিস সমস্যা কমায়।
২৩।  এর এ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান ফ্রি র‌্যাডিকালস প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। বুড়িয়ে যাওয়া ও সেল ডিজেনারেশনের অন্যতম কারণ এই ফ্রি র‌্যাডিকালস।
২৪।  অ্যাসিডিটি, স্কার্ভি ইত্যাদি নানারকম সমস্যায় আমলকী কার্যকর।
২৫।  লিভার ভাল রাখে, ব্রেনের কার্যকলাপে সাহায্য করে ফলে মেন্টাল ফাংশনিং ভাল হয়।
২৬।  ব্লাড সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণে রেখে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
২৭।  কোলেস্টেরল লেভেলেও কম রাখাতে যথেষ্ট সাহায্য করে।
২৮।  চর্মরোগের চিকিৎসায়ও আমলকী ব্যবহার হয়।
২৯।  এটি চোখের জন্যও বেশ উপকারী। এতে রয়েছে ফাইটো-কেমিক্যাল যা চোখের সঙ্গে জড়িও ডিজেনারেশন প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
 ৩০। ত্বক ভালো রাখেঃ  আমলকিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন সি আছে। আমলকি ত্বককে মসৃন ও সুন্দর করে তোলে। এছাড়াও ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতেও আমলকি ভূমিকা রাখে। নিয়মিত আমলকি খেলে শরীরের বিষাক্ত পদার্থ বের হয়ে যায়। ফলে ব্রণ কিংবা অন্যান্য ত্বকের সমস্যাও কমে। বয়সের কারণে বলিরেখা ঠেকাতেও আমলকি বেশ কার্যকরী।
৩১। ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়ঃ  আমলকিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট আছে যা শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী কোষের বৃদ্ধি কমায়। এছাড়াও আমলকি শরীরের দূষিত পদার্থ বের করে দিয়ে রক্ত বিশুদ্ধ করে। তাই নিয়মিত আমলকি খেলে ত্বক ও পাকস্থলীর ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে যায়।
৩২।  প্রতিদিন আমলকীর রস খেলে নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ রোধে তা সহায়তা করে 
৩৩।  চুল খুশকিমুক্ত ও কম বয়সে চুল পাকা রোধে আমলকী বিশেষভূমিকা পালন করে।
৩৪। আমলকীর রস কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে পাইলস রোগ থেকে মুক্তি দেয়। এছাড়া অন্ত্রের রোগ নিরাময় ও ক্রনিক কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে এটি সহায়ক।  
৩৫। চোখ লাল হওয়া, চুলকানো ও চোখ দিয়ে পানি পড়া রোধেও আমলকী বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
৩৬। আমলকী হৃদপিণ্ডের পেশি শক্তিশালী করে ও হূদযন্ত্রের সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে।



খাওয়ার নিয়মঃ
কাঁচা খাওয়াই সবচেয়ে ভালো। তবে শুকিয়ে এবং আচার বানিয়ে সংরক্ষণ করে খেতে পারেন।
আমলকীর রয়েছে হরেকরকমের ব্যবহার পদ্ধতি।
১। আধা চূর্ণ শুষ্ক ফল এক গ্লাস পানিতে ভিজিয়ে খেলে হজম সমস্যা কেটে যাবে। খাবারের সঙ্গে আমলকীর আচার   হজমে সাহায্য করে।
২। আমলকীর আচার বা মোরব্বা মস্তিষ্ক ও হৃদযন্ত্রের দুর্বলতা দূর করে।
৩। কাঁচা আমলকী স্কার্ভিসহ ভিটামিন সি ও বি-এর অভাবজনিত যে কোন রোগের জন্য বেশি উপকারী।
৪। আমলকীর জুস দৃষ্টি শক্তি ভাল রাখার জন্য উপকারী। ছানি প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। ব্রণ ও ত্বকের অন্যান্য সমস্যায় উপকারী।
৫। আমলকীর জুস  ব্রঙ্কাইটেস ও এ্যাজমার জন্য উপকারী।
৬। রুচী ও খিদে বাড়ানোর জন্য আমলকী গুঁড়োর সঙ্গে সামান্য মধু ও মাখন মিশিয়ে খাওয়ার আগে খেতে পারেন।
৭। আমলকী দিয়ে ধরণের জ্যাম, মোরব্বা তৈরি করা যায়।
৮। এ্যসিডিটির জন্য এক গ্লাস দুধ বা পানির মধ্যে আমলকী গুঁড়ো ও সামান্য চিনি মিশিয়ে দিনে দুবার খেতে পারেন। এ্যাসিডেটের সমস্যা কম রাখতে সাহায্য করবে।


আমলকীর মোরোব্বাঃ 

আমলকীর সঙ্গে মিশিয়ে খেলে মিষ্টিও স্বাস্থ্যকর হতে পারে! প্রথমে আমলকী ধুয়ে সেদ্ধ করে নিন। এত বেশি পানি দেবেন না যে, অতিরিক্ত পানি ফেলে দিতে হয়। খেয়াল রাখতে হবে যেন বেশি সেদ্ধ হয়ে আমলকী গলে যেতে শুরু না করে। এবার আমলকী তুলে একটা পাতে রাখুন। আমলকী সেদ্ধ পানিটুকুর সঙ্গে প্রয়োজনমতো আরও পানি ও চিনির সঙ্গে কিছু এলাচ দানা ও খানিকটা লবণ ছেড়ে দিয়ে জ্বাল দিন। এবার চিনির শিরার মধ্যে সেদ্ধ আমলকী ছেড়ে দিন। ব্যস হয়ে গেল আমলকির মোরোব্বা।  

আমলকীর চাটনিঃ
২৫০ গ্রাম কাচা আমলকী কুচি করে কেটে বিচি ছাড়িয়ে অল্প করে ছেঁচে নিন। ২০০ গ্রাম ধনেপাতা ও পুঁদিনা পাতা ডাঁট ছাড়িয়ে কিছুটা কুচি করুন। ১০০ গ্রাম কাচা মরিচ টুকরো করে কেটে নিন। এক চা চামচ আদা কুচি, এক টেবিল চামচ লবণ ও এক টেবিল চামচ চিনি নিন। এবার সবগুলো একসঙ্গে একটা ব্লেন্ডারে দিয়ে মন্ড করুন কিংবা হামানদিস্তায় ভালো করে পিষে নিন। এমন আমলকীর চাটনিতে জিভে জল চলে আসবে যে কারও।


আমলকীর আচারঃ 
উপাদান: ৫০০ গ্রাম আমলকি, ১০০ গ্রাম তেঁতুল, ২৫ গ্রাম হলদি গুঁড়ো, ২০০ গ্রাম মরিচ গুঁড়ো, ১০০ গ্রাম মেথি গুঁড়ো, ২৫০ মিলিলিটার সরিষার তেল, ২০ গ্রাম সরিষা দানা ও ১০ গ্রাম মেথি দানা ও পরিমাণ মতো লবণ।

যেভাবে বানাবেনঃ  আমলকীর দাগগুলো বরাবর কেটে কেটে টুকরো করে একটা পাত্রে রাখুন। আরেকটা পাত্রে ৫০ মিলিলিটার গরম পানিতে তেঁতুল ভিজিয়ে বিচিগুলো ছাড়িয়ে নিন। এবার আরেক পাত্রে তেঁতুল, হলদি গুঁড়ো, মরিচ গুঁড়ো মেথি গুঁড়ো আর পরিমাণ মতো লবণ মিশিয়ে একটা মন্ড বানিয়ে রাখুন। একটা কড়াইয়ে অর্ধেকটা তেল নিয়ে আমলকীর টুকরোগুলো হালকা লালচে করে ভেজে নিন, ঢাকনা দিয়ে ঢেকে অল্প আঁচে বেশি সময় ধরে ভাজুন। এবার তেঁতুলের মন্ড আর হলদি-মরিচ-মেথির মন্ড বাকি তেলটুকুর সঙ্গে কড়াইয়ে দিয়ে ৫ মিনিট ধরে হালকা করে নেড়ে নিন। চুলার জ্বাল একেবারে কমিয়ে দিন। এবার একটা ছোট কড়াইয়ে এক টেবিল চামচ তেল গরম করে সরিষা আর মেথি দানা ছেড়ে দিন। গরম তেলে দানাগুলো ফেটে গেল নামিয়ে নিয়ে আচারের ওপর ছড়িয়ে দিন। আচারটা চুলা থেকে নামিয়ে ঠান্ডা করুন। আচার ঠান্ডা হয়ে গেলে বয়ামে ভরে ভালো করে মুখ বন্ধ করে রাখুন।