সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০১৩

মুসলমানদের রচিত প্রথম সংবিধান : মদিনা সনদ

৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বরে প্রণীত মদিনা সনদটি সিরাতে ইবনে হিশাম থেকে হুবহু তুলে ধরা হলো

মদিনা সনদঃ  

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, কুরাইশ ও ইয়াসরিবের মুমিন মুসলমানগণ এবং পরবর্তীকালে যারা তাদের অনুসারী হয়ে তাদের সাথে শরীক হবে ও একসাথে জিহাদে অংশগ্রহণ করবে, তাদের পক্ষ থেকে এ একটি ঘোষণাপত্র। সমগ্র মানব জাতির মধ্যে তারা একটি স্বতন্ত্র উম্মাহ। কুরাইশদের মধ্য থেকে আগত মুহাজিররা তাদের ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে, তাদের পরস্পরের মধ্যে ক্ষতিপূরণ দানের নীতির অনুসারী থাকবে, তারা বন্দীদেরকে ন্যায়সঙ্গতভাবে ও পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য পন্থায় মুক্তিপণ নিয়ে মুক্তি দিতে পারবে। বনু আওফও ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে, তাদের পরস্পরের মধ্যে সাবেকী ক্ষতিপূরণ দানের নীতি অটুট থাকবে, প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মুমিনদের মধ্যে মুক্তিপণ নিয়ে বন্দীকে মুক্তি দেয়ার বিধান চালু থাকবে। বনু সায়েদাও তাদের ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মুমিনদের মধ্যে বন্দীকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়া চলবে। বনু হারেস তাদের ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের পরস্পরের মধ্যে সাবেকী ক্ষতিপূরণ দানের নীতি অনুসারী থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মুমিনদের মধ্যে বন্দীকে মুক্তিপণের ভিত্তিতে মুক্তি দেয়ার রীতি অব্যাহত থাকবে। আর বনু জুশামও ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের সাবেকী ক্ষতিপূরণ দানের নীতির অনুসারী থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মুমিনদের মধ্যে মুক্তিপণের ভিত্তিতে বন্দীকে মুক্তি দেয়ার নীতি চালু থাকবে। বনু আমর ইবনে আওফ ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের সাবেকী ক্ষতিপূরণ দানের রীতি অব্যাহত থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মুমিনদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মুক্তিপণের ভিত্তিতে বন্দীকে মুক্তিদেয়া চলবে। বনু নাবীত ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের সাবেকী ক্ষতিপূরণ দানের রীতি চালু থাকবে।

তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মুমিনদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মুক্তিপণ্যের ভিত্তিতে বন্দী মুক্তির অনুসারী থাকবে। বনু আওস ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের প্রত্যেক মুমিনদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মুক্তিপণ নিয়ে বন্দী মুক্তির নীতি অব্যাহত থাকবে। মুমিনগণ তাদের মধ্যকার ঋণগ্রস্ত ও অধিক সন্তানধারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ ও মুক্তিপণদানে সঙ্গতভাবে আর্থিক সাহায্য করবে। কোনো মুমিন অন্য মুমিনের মিত্রের বিরোধিতা করবে না। খোদাভীরু মুমিনগণ তাদের মধ্যকার বিদ্রোহী, ঘোরতর নির্যাতক, অপরাধী, মুসলিম সমাজের স্বার্থের ক্ষতিকারক ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারকের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে এবং এ ধরনের অপরাধীর বিরুদ্ধে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে পদক্ষেপ নেবে, চাই সে তাদের কারো ছেলেই হোক না কেন। কোনো কাফিরের স্বার্থে এক মুমিন অন্য মুমিনকে হত্যা করবে না এবং কোনো কাফিরকে কোনো মুমিনের বিরুদ্ধে সাহায্য করবে না। মুসলিম রাষ্ট্রে অনুগত অমুসলিমের অধিকার সমানভাবে নিরাপদ। একজন নগণ্যতম অমুসলিমকেও মুসলমানরা পূর্ণ নিরাপত্তাসহ আশ্রয় দেবে। মুমিনরা পরস্পরের মিত্র হয়ে থাকবে, তবে অন্যদের বেলায় এ কথা প্রযোজ্য নয়। আর ইহুদিদের মধ্য হতে যে ব্যক্তি আমাদের আনুগত্য ও অনুসরণ করবে, সে আমাদের সমান অধিকার ও সাহায্য লাভ করবে। এ ধরনের লোকদের ওপর কোনো জুলুম চলতে দেয়া হবে না এবং তাদের ওপর কাউকে হামলা চালাতে সাহায্য করা হবে না। মুমিনদের রক্ষাকবচ সবার ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন। ইসলামের স্বার্থে কোনো যুদ্ধ সংঘটিত হলে সেই যুদ্ধে মুসলমান কোনো অমুসলমানের সাথে সমতা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে ছাড়া আপোষরফা করবে না। আমাদের মধ্য হতে প্রতিটা যোদ্ধাদল অন্য যোদ্ধাদলকে অনুসরণ করবে। মুমিনদের একজন অন্যজনকে হত্যা করতে পারবে শুধুমাত্র হত্যার বিনিময়ে এবং আল্লাহর বিধান অনুসারে। খোদাভীরু মুমিনগণ সর্বশ্রেষ্ঠ ও দৃঢ়তম আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত। মদিনার কোনো মুশরিক কুরাইশ সম্প্রদায়ের কারো জানমালের রক্ষক বা জিম্মাদার হতে পারবে না, আর কোনো মুমিনের ক্ষতি সাধনে তাকে প্রশ্রয় দেবে না। যে ব্যক্তি কোনো মুমিনকে মৃত্যুদণ্ড যোগ্য অপরাধ না করা সত্ত্বেও হত্যা করবে এবং তা যথাযথভাবে প্রমাণিত হবে, তাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। অবশ্য নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীকে অন্য কোনো উপায়ে খুশি করে থাকলে প্রাণদণ্ড হবে না। তবে সর্বাবস্থায় মুমিনরা সকলে ঐ মুসলিম হন্তার বিরুদ্ধে থাকবে এবং তার পক্ষপাতিত্ব করা কোনো মুমিনের জন্য হালাল হবে না। এই ঘোষণাপত্রকে মেনে নিয়েছে এবং আল্লাহ ও আখিরাতে অটুট বিশ্বাস রাখে এমন কোনো মুমিনের জন্য ইসলামী বিধানে উদ্ভট জিনিস সংযোজনকারীর সাহায্য করা বা আশ্রয় দেয়া বৈধ নয়। যে ব্যক্তি এ ধরনের লোককে সাহায্য করবে কিংবা আশ্রয় দেবে তার ওপর আল্লাহর লানত এবং কিয়ামতের দিন আল্লাহর গজব নামবে। তার পক্ষে কোনো সুপারিশ বা পণ গ্রহণ করা হবে না। আর তোমরা যখনই কোনো বিষয়ে মতবিরোধে লিপ্ত হবে, তখন সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শরণাপন্ন হবে।

মুমিনরা যতদিন যুদ্ধরত থাকবে ততদিন ইহুদিরা তাদের যুদ্ধের রসদ যোগানোতে অংশ নেবে। বনু আওফের ইহুদিরা মুমিনদের সাথে একই উম্মাতভুক্ত বলে গণ্য হবে, তারা নিজে এবং তাদের মিত্ররাও। কিন্তু মুসলমানরা ও ইহুদিরা সে অবস্থায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। তবে যে ব্যক্তি জুলুম-অত্যাচার ও অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হবে সে কেবল নিজের ও নিজের পরিবার-পরিজনের ধ্বংসই ডেকে আনবে। বনু নাজ্জারভুক্ত ইহুদিদের অধিকার বনু আওফের ইহুদিদের সমান। অনুরূপভাবে বনু হারেস, বনু সায়েদা, বনু জুশাম, বনু আওস, বনু সালাবা ও বনু শুতাইবার ইহুদিদের অধিকার বনু আওফের ইহুদিদের সমান। তবে জুলুম-অত্যাচার ও পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তি নিজের ও নিজের পরিবার পরিজনের কেবল ধ্বংসই সাধন করবে। সালাবার যাবতীয় বাহ্যিক ব্যাপার তাদের ভেতরকার ব্যাপারের সমপর্যায়ে তাদের প্রাণের মতই সম্মানার্হ। আনুগত্য ও প্রতিশ্রুতিপরায়ণতা যেন সবাইকে পাপাচার থেকে রক্ষা করে। সালাবার মিত্রদের অধিকার তাদের নিজেদেরই সমান। ইহুদিদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার তাদের প্রাণের মতই সম্মানার্হ। তাদের ভেতর থেকে কেউ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুমতি ছাড়া মদিনার বাইরে যেতে পারবে না। প্রত্যেকের জেনে রাখা উচিত যে, কোনো প্রকারের তর্ক বা জেরা দ্বারা আগুন থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করলো সে নিজের ও নিজের পরিবার-পরিজনের ধ্বংসের বিনিময়েই হত্যা করলো। অবশ্য নিহত ব্যক্তি অপরাধী হলে আলাদা কথা। আল্লাহ তায়ালা এ ক্ষেত্রে অধিকতর মহানুভবতা পছন্দ করেন। ইহুদিদের ব্যয়ভার তারা নিজেরাই বহন করবে এবং মুসলমানদের ব্যয়ভারও তারা নিজেরাই বহন করবে। এই ঘোষণাপত্রকে যারা মেনে নিয়েছে তাদের কর্তব্য, কোনো শরীক যুদ্ধরত থাকলে তাকে সর্বোতভাবে সাহায্য করা এবং পরস্পরের মধ্যে হিতকামনা, সদুপদেশ ও মহানুভবতার সম্পর্ক থাকবে, কোনো পাপ কাজে একজন আর একজনের সাথে শরীক হবে না। নিজের মিত্রের ক্ষতিসাধন এক ভয়ঙ্কর নজিরবিহীন অপরাধ। মজলুমকে সাহায্য করা সকলের কর্তব্য। মুমিনরা যতদিন যুদ্ধরত থাকবে ততদিন ইহুদিরা তাদেরকে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে যাবে এই ঘোষণাপত্রের শরীকদের জন্য ইয়াসরিবের অভ্যন্তরে ভাগ সম্পূর্ণ নিরাপদ। প্রতিবেশী যদি অপরাধী না হয় এবং ক্ষতিকর কাজে লিপ্ত না থেকে থাকে তাহলে তার জান, মাল ও ইজ্জত নিজের জান, মাল ও ইজ্জতের মতই পূর্ণ নিরাপত্তার অধিকারী। কারো বাড়ির ভেতরে বাড়ির মালিকের অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করা যাবে না। এই ঘোষণাপত্র গ্রহণকারীদের মধ্যে যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা কিংবা ঝগড়া কলহ ঘটুক না কেন, তার ফায়সালার জন্য আল্লাহ ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরণাপন্ন হতে হবে। আল্লাহ সর্বাধিক সতর্কতা ও সততার সাথে এই ঘোষণাপত্রের বাস্তবায়ন দেখতে আগ্রহী। জেনে রাখা দরকার যে, কুরাইশ ও তাদের সহযোগীদের আশ্রয় দেয়া চলবে না।

ঘোষণাপত্র গ্রহণকারীগণ মদিনা আক্রমণকারীকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করবে। আর যখন সন্ধি ও মৈত্রী স্থাপনের আহ্বান জানানো হবে তখন তারা আহ্বানকারীর সাথে সন্ধি ও মৈত্রী স্থাপন করবে। এ ধরনের কোনো সন্ধি ও মৈত্রীর দিকে তাদেরকে যখন আহ্বান জানানো হবে তখন তা মেনে চলা মুমিনদের জন্যও বাধ্যতামূলক হবে। তবে যে বা যারা ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে তখন তারা তাদের জন্য প্রাপ্য অংশ সেই পক্ষের নিকট থেকে নেবে যে পক্ষ তাদেরকে বাহিনীতে ভর্তি করেছিল। আওসের ইহুদিদের ও তাদের মিত্রদের অধিকার ও দায়দায়িত্ব এই ঘোষণাপত্র গ্রহণকারীদের অধিকার ও দায়দায়িত্বের মতই এবং ঘোষণাপত্র সম্পাদনকারীদের কাছ থেকে তারা পূর্ণ ন্যায়সঙ্গতভাবে তা লাভ করতে পারবে। কেউ সততার পথ অবলম্বন করলে তার পূর্বতন পাপাচার ক্ষমার চোখে দেখতে হবে। কেউ খারাপ কাজ করলে তা তার নিজেরই ক্ষতি সাধন করবে। আল্লাহ এই ঘোষণাপত্রের আনুগত্যের ব্যাপারে সর্বাধিক সততা ও সত্যবাদিতা দেখতে চান। এই ঘোষণাপত্র কোনো অত্যাচারী বা অপরাধীর জন্য রক্ষাকবচ নয়। জুলুম কিংবা অপরাধে লিপ্ত না হলে যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে যাওয়া কিংবা নিষ্ক্রিয় বসে থাকা লোকও মদিনার চৌহদ্দির ভেতরে নিরাপত্তা লাভ করবে। যে ব্যক্তি সততা ও খোদাভীতির পথে অবিচল থাকবে, আল্লাহ ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার আশ্রয়দাতা ও সহায়ক থাকবেন।

৬২২ খ্রীস্টাব্দের ২৪শে সেপ্টেম্বর ইসলাম ধর্মের নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মদিনা নগরীতে হিজরতের করেন। এসময় সেখানে বসবাসরত বিভিন্ন সম্প্রদায় গুলোর মধ্যে ছিল গোষ্ঠীগত হিংসা-বিদ্বেষ। তাই কলহে লিপ্ত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি স্থাপন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হযরত মুহাম্মদ (সা:) ৪৭ ধারার একটি সনদ বা সংবিধান প্রণয়ন করেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে মদিনার সনদ নামে পরিচিত। এর প্রথম ১০ ধারায় বলা হয় যে, মুহাজির (দেশত্যাগী বা যারা মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেছিল), বনু আউফ, বনু সাইদা, বনু হারিস, বনু জুশাম, বনু নাজ্জার, বনু আমর, বনু নবীত ও বনু আউস পূর্বহারে মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত নিয়মনীতি এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে পণের মাধ্যমে বন্দীদের মুক্ত করবে। ১১ থেকে ২০ ধারায় মুসলমানদের পারষ্পরিক সম্পর্ক সম্পর্কিত আইন বিধৃত হয়। ২১ থেকে ২৬ ধারায় হত্যাকারীর শাস্তি, কোনো মুসলমান কোনো অন্যায়কারীকে আশ্রয় দিলে তার শাস্তি, কোনো বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে তার মীমাংসা পদ্ধতি, ধর্মীয় স্বাধীনতা ইত্যাদী বিষয়ক আইন সন্নিবেশিত হয়। ২৭ থেকে ৩৬ ধারায় সন্নিবেশিত হয় বিভিন্ন গোত্রের স্বরুপ সম্পর্কিত বিধান। পরবর্তী ধারাসমূহে যুদ্ধনীতি, নাগরিকদের ক্ষতির ক্ষতিপূরণ, নিজ নিজ ব্যয় নির্বাহ, এ সনদে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে কেউ যুদ্ধে লিপ্ত হলে তার ব্যাপারে ব্যবস্থা, বন্ধুর দুষ্কর্ম, যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহ, নাগরিকের অধিকার, আশ্রয়দানকারী ও আশ্রিতের সম্পর্ক, নারীর আশ্রয়, সনদের স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে শান্তি ভঙ্গের আশন্কা দেখা দিলে করণীয়, কুরাইশদের ব্যাপারে ব্যবস্থা, মদীনার উপর অতর্কিত আক্রমণ হলে করণীয় ইত্যাদি সন্নিবেশিত হয়। বিশ্বের ইতিহাসে এটিই প্রথম লিখিত চুক্তি ও সংবিধান। ঐতিহাসিক পি.কে. হিট্টির মতে-" Out of the religious community of all Madinah the later and largest state of Islam arose" অর্থ্যাৎ মদীনা প্রজাতন্ত্রই পরবর্তীকালে ইসলামী সাম্রাজ্যের ভিত্তিমূল স্হাপন করে। উক্ত সংবিধানে সকল পক্ষ মেনে নিয়ে স্বাক্ষর দান করেছিল।

মদীনা সনদের মূল বিষয়বস্তু ছিল:

১) সনদপত্রে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়সমূহ একটি জাতি গঠন করবে।
২. যুদ্ধ বা হানাহানি শুরু হবার মতো তীব্র বিরোধ তৈরি হলে বিষয়টি আল্লাহ এবং হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কাছে ন্যস্ত হবে।
৩) কোন সম্প্রদায় গোপনে কুরাইশদের সাথে কোন প্রকার সন্ধি করতে পারবে না কিংবা মদীনা বা মদীনাবাসীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে কুরাইশদের কোনরুপ সাহায্য-সহযোগীতা করতে পারবে না।
৪) মুসলিম, খ্রীস্টান, ইহুদী, পৌত্তলিক ও অন্যান্য সম্প্রদায় ধর্মীয় ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে। কেউ কারো ধর্মীয় কাজে কোন রকম হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
৫) মদিনার উপর যে কোন বহিরাক্রমণ কে রাষ্ট্রের জন্য বিপদ বলে গণ্য করতে হবে। এবং সেই আক্রমণ কে প্রতিরোধ করার জন্য সকল সম্প্রদায়কে এক জোট হয়ে অগ্রসর হতে হবে।
৬) রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষার ব্যবস্থা থাকবে।
৭) অসহায় ও দূর্বলকে সর্বাবস্থায় সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে।
৮) সকল প্রকার রক্তক্ষয়, হত্যা ও বলাৎকার নিষিদ্ধ করতে হবে এবং মদীনাকে পবিত্র নগরী বলে ঘোষণা করা হবে।
৯) কোন লোক ব্যক্তিগত অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবেই বিচার করা হবে। তজ্জন্য অপরাধীর সম্প্রদায় কে দায়ী করা যাবে না।
১০) মুসলমান, ইহুদী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা পরষ্পর বন্ধুসুলভ আচরণ করবে।
১১) রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিষ্পত্তির অধিকার থাকবে রাষ্ট্রপ্রধানের এবং তিনি হবেন সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সর্বোচ্চ বিচারক।
১২) মুহাম্মদ (সাঃ) এর অনুমতি ব্যতীত মদীনাবাসীগণ কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না।

১৩) মুসলমানদের কেউ যদি অন্যায় কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে সবাই মিলে তার বিরুদ্ধে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। নিজ সন্তান বা আত্নীয় হলেও এ ব্যাপারে তাকে ক্ষমা করা যাবে না।


মদিনায় স্থাপিত প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের সচিবালয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচিত
রাষ্ট্রপ্রধানের দপ্তরঃ

১. হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর ব্যক্তিগত সচিব : হযরত হানযালা ইবনে আলরবি
২. পত্রলিখন ও অনুবাদ বিভাগ (সচিব) : হযরত আলী (রা.), হযরত মুয়াবিয়া (রা.) ও হযরত জায়েদ ইবনে সাবিত (রা.)
৩. সচিব : হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) ও হযরত শুরাহবিল ইবনে হাসান (রা.)
৪. সিলমোহরের আংটিটির সংরক্ষক : হযরত মুকরি ইবনে আবি ফাতিমা (রা.)
৫. অভ্যর্থনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত : হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) ও হযরত বারাহ (রা.)
৬. অর্থ ও হিসাব বিভাগ : হযরত মুয়ানকি ইবনে আবি ফাতিমা (রা.)
৭. জনস্বাস্থ্য বিভাগ : চিকিৎসক হারিস ইবনে সালাহ এবং আবিবার পুত্র
৮. শিক্ষা বিভাগ (স্বাক্ষরজ্ঞান) : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সাইদ (রা) ও আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)
৯. যাকাত ও সদ্কা বিভাগ : হযরত যোবায়ের ইবনে আওয়াম ও যুহাইর
১০. বিজয়ের পর মক্কার প্রশাসক ছিলেন : হযরত ইত্তাব ইবনে উসাইদ (রা.)
১১. ইয়েমেনের দায়িত্বে ছিলেন : হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.)
১২. আম্মানের দায়িত্বে ছিলেন : হযরত আমর ইবনে আজ (রা.)
১৩. ওহি বিভাগ : হযরত আবু বকর এবং ওসমান (রা.) সহ চার খলিফা সবাই এবং হযরত জায়েদ ইবনে আজ সাবিত (রা.), উবায় বিন কাব (রা.), মুয়াবিয়া (রা.), খালেদ বিন ওয়ালিদ (রা.), মুগিরা ইবনে শুবা (রা.) এবং আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াসহ দশজন মেধাবী-উচু মর্যাদার সাহাবী
১৪. প্রতিরক্ষা বিভাগ : নবীজী (স.) নিজে ছিলেন তবে অধিনায়ক হিসেবে ৭২টি নিয়োগদান করেছিলেন
১৫. জননিরাপত্তা বিভাগ : হযরত কায়েস ইবনে সায়াদ (রা.)
১৬. বিচারপতি হিসেবে : হযরত ওমর ও হযরত আলী (রা.) সহ আটজন মশহুর বিদগ্ধ সাহাবী।
সূত্র : গভর্নমেন্ট আন্ডার দ্যা প্রফেট, ফুতহুল বুলদান, সিরাতে ইবনে হিশাম।

কোন মন্তব্য নেই: