বকফুল শিম বা মটর গোত্রীয় গাছ। কিন্তু গাছ দেখতে মোটেই শিম বা মটরের মতো নয়।
ফুলের গড়নে কিছুটা মিল থাকলেও পাতা ও গাছের সঙ্গে মিল নেই। তবে ধৈঞ্চা গাছের সঙ্গে
কিছুটা মিল আছে। তবে বকফুলের গাছ ধৈঞ্চার চেয়ে অনেক বড় ও মজবুত। এ গাছের অনেকগুলো
বাংলা নাম- বক, বকে,
বগ, বকফুল, বগফুল,
অগস্তা, অগাতি ইত্যাদি। তবে গাছটি এ
দেশে বকফুল নামেই বেশি পরিচিত। বকফুলের হিন্দি নাম ‘গাছ মুংগা’।
ইংরেজী নাম- hummingbird tree/scarlet wisteria, August flower,
Australian corkwood tree, flamingo bill, grandiflora, sesban, swamp pea, tiger
tongue, West Indian pea, white dragon tree ইত্যাদি।
আমাদের প্রকৃতিতে বকফুল অনেক পুরনো। প্রচলিত আরেকটি নাম বাসনা। প্রাচীন
সাহিত্যেও তার উল্লেখ আছে। রাজনিঘন্টু ও ভারতচন্দ্রের কবিতায় বকফুলের প্রসঙ্গ
পাওয়া যায়। ভারতচন্দ্র লিখেছেন— ‘অশোক কিংশুক মধুটগর/
চম্পক পুন্নাগ নাগকেশর/ গন্ধরাজ যুতি ঝাটি মনোহর/ বাসক বক শেফালিকা।’
বকফুলের আদি আবাস মালয়েশিয়া। ক্ষুদ্র আকৃতির পত্রমোচী গাছ। কাণ্ড সরল, উন্নত, ম্লান-বাদামি ও মসৃণ। যৌগিক পত্রটি পালকের মতো এবং আকর্ষণীয়, পত্রিকা আয়তাকৃতি, সজোড় ও গাঢ়-সবুজ। কাক্ষিক মঞ্জরি অনিয়ত এবং স্বল্প-পৌষ্পিক।
বকফুলের আদি আবাস মালয়েশিয়া। ক্ষুদ্র আকৃতির পত্রমোচী গাছ। কাণ্ড সরল, উন্নত, ম্লান-বাদামি ও মসৃণ। যৌগিক পত্রটি পালকের মতো এবং আকর্ষণীয়, পত্রিকা আয়তাকৃতি, সজোড় ও গাঢ়-সবুজ। কাক্ষিক মঞ্জরি অনিয়ত এবং স্বল্প-পৌষ্পিক।
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বকফুল গাছ জন্মে। বিশেষ করে
বাংলাদেশ, লাওস, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া,
ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, চীন, ফিলিপিন, ভারত
প্রভৃতি দেশে বকফুল গাছ লাগানো হয়। এ গাছটি এখন অস্ট্রেলিয়া, কিউবা, মেক্সিকো প্রভুতি দেশেও জন্মাচ্ছে।
বিগত প্রায় দেড়শ বছর ধরে পশ্চিম আফ্র্রিকাতেও বকফুলের চাষ করা হচ্ছে।
বকফুলের
উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Sesbania
grandiflora,
পরিবার Fabaceae (সাবেক
লিগুমিনোসী),
উপ-পরিবার
Faboideae (সাবেক প্যাপিলিওনেসী) ।
ফুলের রঙ বকের মত সাদা বলেই হয়তো নাম হয়েছে বকফুল। কিন্তু এখন
এর অনেক নতুন জাত এসেছে যেসব জাতের ফুলের রঙ সাদা নয়। এদেশে ৩ রঙের বকফুল দেখা
যায়- সাদা, লাল ও গোলাপি।
বকফুলের পুষ্টিমানঃ
উপাদান
|
পরিমান
|
ফাইবার
|
১.৯%
|
ফ্যাট
|
১.৩%
|
ক্যালোরি
|
৯০
|
পানি
|
৭৪.৫%
|
প্রোটিন
|
৭.৫%
|
ক্যালসিয়াম
|
১২০ মিলিগ্রাম
|
ফসফরাস
|
৮০ মিলিগ্রাম
|
আয়রন
|
৩.৫ মিলিগ্রাম
|
ভিটামিন ‘সি’
|
১৬৫ মিলিগ্রাম
|
মিনারেল
|
৩.৪%
|
উপাদানঃ
বকফুল গাছের বাকল ট্যানিন ও লাল
আঠা বা গাম সমৃদ্ধ। বীজে আছে স্যাপোনিন ও সেসবানিমাইড। সেসবানিমাইড ক্যানসার
প্রতিরোধক হিসেবে বিবেচিত। ফুলে আছে প্রোটিন, ট্যানিন, ওলিওনোলিক এসিড, কেমফেরল, সিস্টিন, আইনোলিউসিন, অ্যাসপ্যারাজিন, ফিনাইলএলানিন, ভ্যালিন, নিকোটিনিক এসিড ও ভিটামিন সি। লাল
রঙের ফুল আয়রন ও ভিটামিন বি সমৃদ্ধ। পশুখাদ্য হিসেবে বকফুলের পাতা প্রচুর
প্রোটিনসমৃদ্ধ। এর পাতায় প্রায় ২৫% ক্রুড প্রোটিন আছে।
বকফুল
ও বকফুলের পাতার উপকারিতা বা ভেষজ মূল্যঃ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বকফুল গাছের প্রতিটি অংশই
ভেষজ চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।
১। জ্বর, ফোলা ও
ব্যাথাবেদনা সারাতে এ গাছের মূল ব্যবহার করা হয়।
২। বাতের ব্যথায় শিকড় চূর্ণ জলের
সাথে গুলে ব্যাথা জায়গায় ঘষলে, লাগালে বা প্রলেপ দিলে উপকার
পাওয়া যায়।
৩। বাকল বসন্ত রোগের চিকিৎসায় কাজে
লাগে।
৪। গাছের বাকল মুখের আলসার
সারাতে ব্যবহার করা হয়।
৫। চুলকানি-পাঁচড়া সারাতে
কম্বোডিয়ায় বাকল চূর্ণ লাগানো হয়।
৬। কৃমি ও জ্বর সারাতে পাতার রস
খাওয়ানো হয়।
৭। হাড় শক্ত করে ।
৮। গ্যাস্ট্রিক আলসার ও বুক
জ্বালা নিরাময় করে ।
৯। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে ।
১০। শরীরের বাড়তি তাপ বকফুল পাতার
গ্রহণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় ।
১১। বকফুল পাতার চোখের স্নায়ু
জোরদার করে ।
১২। বার্ধক্য ও হাড় দুর্বলতা
প্রতিরোধ করে ।
১৩। বকফুল পাতা কৃমি নাশক হিসাবে
কাজ করে ।
১৪। বকফুল পাতার বাষ্প নিয়ে মাথা
ব্যাথা কমাতে সাহায্য করে ।
১৫। বদ হজম রোধে ও হজম পক্রিয়া
ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করে ।
১৬। শরীর, চোখ, পেট, পা ও পায়ের
পাতা জ্বলা কমাতে বকফুল পাতার রস ব্যাবহার করুন ।
১৭। শরীরের অবাঞ্ছিত পিত্ত নাশ
করে ।
১৮। পাইলস রোগ নিরাময়ে সাহায্য
করে ।
১৯। রক্ত শোধনে কাজ করে ।
২০। মেরুদণ্ড ব্যাথায় কাজ করে ।
২১। ত্বকের ক্ষত ও ত্বকের দাগ
নিরাময়ে কাজ করে ।
২২। তলপেটের দাগ দূর করে ।
২৩। দাদ, চুলকানি,
লাল লাল ফুসকুড়ি ইত্যাদি ত্বকের সম্পর্কিত রোগ নিরাময় করে ।
২৪। কানের ব্যাথা ভাল করে ।
২৫। ত্বক পরিষ্কার করে ত্বকের
উজ্জ্বলতা বাড়ায় ।
২৬। মুখের আলসার নিরাময় করে ।
২৭। ম্যালেরিয়া জ্বর ভাল করে ।
২৮। ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার
বিরুদ্ধে কাজ করে ।
২৯। রাতকানা রোগ ভাল করে ।
৩০। যৌনশক্তি বাড়ায় ।
৩১। মূত্রাশয়ের ইনফেকসান নিরাময়
করে ।
৩২। বকফুল পাতার রস শক্তিশালী
শরীর, সুস্থ রক্ত, দেহের সব অঙ্গে পুষ্টি সরবরাহ করে
।
৩৩। বকফুল পাতার রস আয়ু বাড়ায় ।
বকফুলের
ব্যবহারঃ
বিভিন্ন দেশে বকফুল সবজি হিসেবে
খাওয়া হয়। সাধারণত: না ফোটা বকফুল সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। থাইল্যান্ডে সবজি হিসেবে
বকফুল বেশ জনপ্রিয়। সে দেশে বকফুল সবজি হিসেবে রান্না করে খাওয়া হয়, এমনকি কাঁচা
ফুলও খাওয়া হয়। বকফুলকে থাই ভাষায় বলা হয় ‘ডক খায়ে’। বাংলাদেশেও বহুকাল আগে থেকে
বকফুল ভেজে খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। ফিলিপিনে ফুল সেদ্ধ করে স্যুপ ও ভর্তা বানিয়ে
খাওয়া হয়।
শ্রীলংকায় কচি ফলও শিমের মত
খাওয়া হয়। ভারত ও শ্রীলংকার মত কোন কোন দেশে বকফুলের পাতাও খাওয়া হয়। তবে এর ফুল
সব দেশেই সবজি হিসেবে রান্না ও ভেজে খাওয়া হয়। ফুলের ভেতর থেকে শক্ত গর্ভদণ্ডটা
ফেলে দিয়ে ফুলের গায়ে ডালের বেসন পানিতে গুলে মাখিয়ে বেগুনির মত ভেজে খেলে মজা
লাগে। অনেকগুলো ফুল সবজির মত তেল, মরিচ, হলুদ ইত্যাদি দিয়ে রেঁধেও খাওয়া যায়।
সবজি ছাড়া পশুখাদ্য হিসেবেও বকফুল গাছের ব্যবহার রয়েছে। ইন্দোনেশিয়াতে এর পাতা গবাদি পশু ছাগলকে খাওয়ানো হয়। তবে বকফুলের বীজ মাছের জন্য বিষাক্ত। ধৈঞ্চার মত বকফুল গাছ ধানের জমিতে সবুজ সার ফসল হিসেবেও চাষ করা যায়। কেননা এ গাছের শিকড় বাতাস থেকে নাইট্রোজেন সঞ্চয় করে মাটিতে যোগ করে, ফলে জমির উর্বরতা বাড়ে। তাছাড়া কচি পাতা ও ডালপালা চাষ করে মাটিরে সাথে মিশিয়ে দিলে প্রচুর পরিমাণে জৈব পদার্থ ও নাইট্রোজেন মাটিতে যোগ হয়।
এক পরীক্ষায় দেখা গেছে বকফুল গাছ
সবুজ সা ফসল হিসেবে চাষ করে মাটিতে মিশিয়ে দিলে হেক্টর প্রতি প্রায় ৫৫-৬০ কেজি
নাইট্রোজেন যোগ হয়। গাছ পুরনো হরে কেটে তা জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তবে
পোড়ানোর সময় ধুঁয়া হয় বলে অনেকে বকফুল কাঠ জ্বালনিী হিসেবে ব্যবহার করেন না।
1 টি মন্তব্য:
অসাধারণ গাছটি গুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন