জনপ্রিয় ফলগুলোর একটি আনারস। ফলটি মিষ্টি, রসালো ও তৃপ্তিকর। সবচেয়ে বড়কথা পুষ্টিগুণে ভরা এ ফলটি।
অসংখ্য গুণে গুনান্বিত এই ফলে খেয়ে যেমন শরীরে
পানির চাহিদা মেটানো যায় তেমনি বাড়তি পুষ্টিগুণ পেতে জুড়ি নেই এর।
এ ফলটিতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন এ, সি, ক্যালসিয়াম,
ফসফরাস এবং পটাশিয়াম রয়েছে। এ ছাড়া এ ফলটিতে প্রচুর পরিমাণ
আঁশ ও ক্যালোরি রয়েছে। এটি কলস্টেরল ও চর্বিমুক্ত। তাই স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এ
ফলের জুড়ি নেই।
আকর্ষণীয় সুগন্ধ ও অম্ল মধুর স্বাদের জন্য
আনারস অনেকের কাছেই সমাদৃত। এটি রোমিলিয়েসি পরিবারভুক্ত ফল। আনারসের উৎপত্তিস্থল
হলো দক্ষিণ আমেরিকার উষ্ণ অঞ্চল। বিশেষ করে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায়। আনারসের গাছ
১৫১৩ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজদের দ্বারা ব্রাজিল থেকে মালাবার উপকূলে আমদানি হয়।
পরবর্তীতে সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকা ও পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে আনারসের চাষ
প্রবর্তিত হয় এবং ক্রমে দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত,
থাইল্যান্ড, ইন্দো চীন, ফিলিপাইন, যুক্তরাষ্ট্র (হাওয়াই রাজ্য),
মেক্সিকো, মালয়েশিয়া, পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ও অস্ট্রেলিয়ায় এর চাষ প্রসার লাভ করে।
পৃথিবীতে
প্রায় ৯৫ প্রজাতির আনারস চাষ হয়। এবং বাংলাদেশে সাধারণত চার জাতের আনারস চাষ করা
হয়। জায়েন্ট কিউ, কুইন, হরিচরণ ভিটা
ও বারুইপুর। বাংলাদেশে ঘোড়াশাল, সিলেট, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় এসব জাতের চাষ সবচাইতে বেশি হয়।
গ্রীষ্মের
সময় আনারস গাছে ফুল ফুটে এবং বর্ষা শেষে ফল পাকা শেষ হয়। আনারস বছরে দু'বার
তোলা হয়। আগস্ট, সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে গাছে প্রধান ফল
পাওয়া যায়। কিন্তু যেসব গাছে ফুল দেরিতে আসে সেখানে শীতের সময় ফল পাকে।
বর্ষাকালে ফল সুস্বাদু ও সুমিষ্ট হয় আর রসে টইটম্বুর থাকে। এছাড়া শীতের ফল ছোট ও
টক হয়।
পুষ্টিগুণঃ পুষ্টিগুণে আনারস
অতুলনীয়। এতে ভিটামিন এ, বি, সি, ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান রয়েছে। ১০০ গ্রাম আনারসে ০.৬ ভাগ প্রোটিন, শ্বেতসার ৬.২ গ্রাম, ০.১ ভাগ সহজপাচ্য ফ্যাট, ০.৫ গ্রাম খনিজ পদার্থ,
১২.০ গ্রাম শর্করা, ০.১১ গ্রাম ভিটামিন
বি-১, ০.০৪ মি. গ্রাম ভিটামিন-২, ভিটামিন সি ২১ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৮
মিলিগ্রাম, ফসফরাস ০.০২ গ্রাম এবং ১.২ মিলি গ্রাম লৌহ রয়েছে। এছাড়া প্রতি কেজি ফল থেকে ৫০০ ক্যালরি শক্তি
পাওয়া যায়।
ব্যবহারঃ কাঁচা আনারস স্বাদে টক এবং পাকা আনারস টক মিষ্টি
হয়ে থাকে। আমাদের দেশে সাধারণত পাকা আনারস খাওয়া হয়। তবে কেউ কেউ কাঁচা আনারসের
চাটনি তৈরি করে থাকেন। আনারস টিনজাত ফল হিসেবেও সংরক্ষণ করা হয়, এবং এই ধরনের
আনারসের চাহিদা দেশ-বিদেশের বাজারে খুব বেশি। আনারস দিয়ে জ্যাম, জেলি, স্কোয়াশ, রস
প্রভৃতি তৈরি হয় এবং তা বিদেশে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এছাড়া আনারস থেকে কোনো
কোনো সময় অ্যালকোহল ভিনেগার, সাইট্রিক এসিড উৎপাদন করা
হয়। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের খাবার রান্নায় ও সালাদে আনারসের ব্যবহার তো আছেই।
ভিটামিন ও খনিজ লবণঃ আনারসে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ লবণ
থাকে। এরমধ্যে রয়েছে ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস এবং পটাশিয়াম। আনারস একটি আঁশযুক্ত ফল যা থেকে প্রযোজনীয় ফাইবার
বা আঁশ ও ক্যালরি পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা হল, আনারসে
ফ্যাট ও কোলেস্টেরলের পরিমাণ কম। তাই যারা ওজন কমাতে চান তাদের জন্য আনারস খুবই
উপকারী।
জেনে নিই আনারসের উপকারিতাঃ
১। পুষ্টির
অভাব দূর করেঃ আনারস পুষ্টির বেশ বড় একটি
উৎস। আনারসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ এবং সি, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম
ও ফসফরাস। এসব উপাদান আমাদের দেহের পুষ্টির অভাব পূরণে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
২। ওজন
নিয়ন্ত্রণেঃ শুনতে অবাক লাগলেও আনারস আমাদের ওজন কমাতে সাহায্য করে। কারণ আনারসে
প্রচুর ফাইবার এবং অনেক কম ফ্যাট রয়েছে। সকালে আনারস বা সালাদ হিসেবে এর ব্যবহার
অথবা আনারসের জুস অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর।
৩। হাড়
গঠনেঃ আনারসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজ। ক্যালসিয়াম
হাড়ের গঠনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং ম্যাঙ্গানিজ হাড়কে করে তোলে
মজবুত। চুলকে করে শক্তিশালী। প্রতিদিনের খাবার তালিকায় পরিমিত পরিমাণ আনারস
রাখলে হাড়ের সমস্যাজনিত যে কোনও রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
৪। এতে রয়েছে প্রচুর
ক্যালরি, যা আমাদের শক্তি জোগায়।
প্রোটিন খাবার এ ফলটি ত্বকের মৃত কোষ দূর
করে, ত্বককে কুঁচকে যাওয়া থেকে বাঁচায়। আনারস টাটকা
খাওয়াই ভালো।
৫। আনারস জ্বরের ও জন্ডিস
রোগের জন্য বেশ উপকারী।
৬। দেহের তৈলাক্ত ত্বক, ব্রণসহ সব রূপলাবণ্যে আনারসের
যথেষ্ট কদর রয়েছে।
৭। দাঁত
ও মাড়ি সুরক্ষায়ঃ আনারসের ক্যালসিয়াম দাঁতের সুরক্ষায় কাজ করে। মাড়ির যে কোনো
সমস্যা সমাধান করতে বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিন আনারস খেলে দাঁতে
জীবাণুর আক্রমণ কম হয় এবং দাঁত ঠিক থাকে।
৮। চোখের
স্বাস্থ্যঃ রক্ষায় বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, আনারস ম্যাক্যুলার ডিগ্রেডেশন হওয়া থেকে
আমাদের রক্ষা করে। এ রোগটি আমাদের চোখের রেটিনা নষ্ট করে দেয় এবং আমরা ধীরে ধীরে
অন্ধ হয়ে যাই। আনারসে রয়েছে বেটা ক্যারোটিন। প্রতিদিন আনারস খেলে এ রোগ হওয়ার
সম্ভাবনা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। এতে সুস্থ থাকে আমাদের চোখ।
৯। হজমশক্তি
বৃদ্ধি করে আনারসঃ আমাদের হজমশক্তি বৃদ্ধি করতে বেশ কার্যকরী। আনারসে রয়েছে
ব্রোমেলিন, যা আমাদের হজমশক্তিকে উন্নত করতে সাহায্য করে। বদহজম বা হজমজনিত যে
কোনো সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে প্রতিদিন আনারস খাওয়া অত্যন্ত জরুরি।
১০। রক্ত
জমাটে বাধা দেয়ঃ দেহে রক্ত জমাট বাঁধতে বাধা দেয় এই ফল। ফলে শিরা-ধমনির (রক্তবাহী
নালি) দেয়ালে রক্ত না জমার জন্য সারা শরীরে সঠিকভাবে রক্ত যেতে পারে। হৃদপিণ্ড
আমাদের শরীরে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত সরবরাহ করে। আনারস রক্ত পরিষ্কার করে হৃদপিণ্ডকে
কাজ করতে সাহায্য করে।
১১। ঠাণ্ডা ও
কাশি প্রতিরোধ করেঃ আনারসে ভিটামিন সি’য়ের পরিমাণ বেশি থাকায় এটি ভাইরাসজনিত ঠাণ্ডা ও কাশি
প্রতিরোধে সাহায্য করে। আনারসের ব্রোমেলেইন নামক উপাদান ঠাণ্ডা ও কাশি প্রতিকার
করতেও সাহায্য করে। যদি ঠাণ্ডা-কাশি বেশি হয় তাহলে ডাক্তারের ওষুধের পাশাপাশি
আনারস খেলে দ্রুত উপকার পাওয়া যাবে।
১২। আর্থ্রাইটিস
দূর করেঃ আনারস
গেঁটেবাত ও এর ব্যাথা দূর করতে সাহায্য করে। পাশাপাশি হাড়ও সুস্থ রাখে।
১৩। গরম-ঠাণ্ডার জ্বর, জ্বর-জ্বর
ভাব দূর করে এই ফল। এতে রয়েছে ব্যথা দূরকারী উপাদান। তাই শরীরের ব্যথা দূর করার জন্য এর অবদান গুরুত্বপূর্ণ।
১৪। আনারস কৃমিনাশক। কৃমি দূর করার জন্য খালি পেটে
(সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে) আনারস খাওয়া উচিত।
১৫। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি। জিহ্বা, তালু, দাঁত, মাড়ির
যে কোনো অসুখের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আনারস।
১৬। পেট ফাপা সমস্যায় আনারসের কয়েকটি টুকরো লবণ ও গোলমরিচ
মাখিয়ে খান।
১৭। ক্যান্সার
প্রতিরোধ করেঃ
দেশী আনারসে আছে উচ্চ মাত্রায় পানিতে দ্রবনীয়
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন-সি
এবং পানিতে দ্রবনীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা দেহকে ফ্রি-রেডিকেল বা (মুক্ত মুলক)
থেকে সুরক্ষা প্রদান করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট দ্বারা যদি এই মুক্ত মুলকগুলোর
নিয়ন্ত্রন করা না যায় তাহলে মানবদেহের কোষের উপর বিরূপ ক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
ফলস্বরূপ ক্যান্সার এবং হৃদরোগের মত মারাত্মক রোগ দেখা যায়।
অ্যামাইনো এসিড বিশ্লেষণ
এবং কোলাজেন উৎপাদন করায় ভিটামিন-সি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৮। কোষ্ঠকাঠিন্য ও ইরিটেবল বাওল
সিন্ড্রোমঃ
আনারসে পযার্প্ত পরিমাণে ফাইবার বা খাদ্যআঁশ
থাকে। পরিপাকতন্ত্রের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে আনারসের উপকারিতা অপরিসীম।
১৯। অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস্ঃ শরীরের
কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে আনতে আনারসের উপকারিতা অনেক। আনারসে যে ফাইবার আছে তা
হৃদরোগের ঝুঁকিও কমায়। ফাইবার রক্তে সুগারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতেও সাহায্য করে।
২০। ঊচ্চ
রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকঃ পটাশিয়াম হল
একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান যা হৃদস্পন্দন ও হৃদপেশীর আন্যান্য কার্যকলাপ গুলো
স্বাভাবিক রাখে।
২১। এটি
দেহের গ্ল্যান্ড বা গ্রন্থিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে।
২২। গয়টার
অর্থাৎ থাইরয়েড
গ্রন্থির স্ফীত হওয়ার ক্ষেত্রে এটি প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে।
২৩। ক্ষুদ্রান্ত্রের
জীবাণু ধ্বংসে আনারস
খুবই উপকারী।
২৪। এটি
ওভারিয়ান, ব্রেস্ট,
লাং, কোলন ও স্কিন ক্যান্সারে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন
করে।
আনারস আর দুধ এক সাথে খাওয়া যায় না, এটি
একটি কুসংষ্কার। এখন পর্যন্ত আনারস এবং দুধের মাঝে এমন কোন রাসায়নিক বিক্রিয়া
খুঁজে পাওয়া যায়নি যার ফলে এদেরকে এক সাথে খেলে সেটা মানুষের জীবনহানি করবে।
বর্তমানে অনেক খাবারেই দুধ ও আনারস একসাথে মেশানো হয় এবং সারা বিশ্বেই তা খাওয়া
হয়। কাস্টার্ড নামক ডেজার্টে দুধের সাথে নানারকম ফল মেশানো হয় যার মাঝে আনারসও
থাকে। কাস্টার্ড খেয়ে বিষক্রিয়ায় কেউ মারা গেছে বলে জানা যায় না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন