ক্ষুদিরাম বসু , ৩রা ডিসেম্বর ১৮৮৯ তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল
প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত
মেদিনীপুর জেলা শহরে্র কাছাকাছি হাবিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা
ত্রৈলকানাথ বসু ছিলেন নাদাজল প্রদেশের শহরে আয় এজেন্ট। তার মা লক্ষীপ্রিয়
দেবী। তিন কন্যার পর তিনি তার মায়ের চতুর্থ সন্তান। তার দুই পুত্র আগেই
মৃত্যুবরণ করেন। অপর পূত্রের মৃত্যুর আশংকায় তিনি তখনকার সমাজের নিয়ম
অনুযায়ী তার পুত্রকে তার বড় বোনের কাছে তিন মুঠি খুদের (শস্যের) খুদ বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। খুদের বিনিময়ে
ক্রয়কৃত শিশুটির নাম পরবর্তীতে
ক্ষুদিরাম রাখা হয়। ক্ষুদিরাম বসু পরবর্তিতে তার বড় বোনের কাছেই বড় হন।
ক্ষুদিরামের বয়স যখন
সাত বছর তখন তাঁর বাবা মারা যান। বাবা মারা যাওয়ার ছমাস পরে তাঁর মা মারা যান।
এরপর তাঁর আশ্রয় হয় দুর সম্পর্কের এক দাদা ও বৌদির কাছে। কিন্তু সেখানে তাঁকে
অমানবিক অত্যাচার
সহ্য করতে হয়। অশান্তিতে তাঁর মন ভরে উঠে। সঙ্গী হয় দুঃখ আর একাকীত্ব। তবু পেটের দায়ে ৮ বছরের এই
ছেলেটিকে সবই সহ্য করতে হতো। এ সকল কারণে পড়াশোনায় তাঁর মন
বসত না। তবে সুযোগ পেলেই খেলাধুলা আর ব্যায়াম করতেন। এ্যাডভেঞ্চার জাতীয় কাজের প্রতি তাঁর প্রচুর আকর্ষণ
ছিল।
দিনের পর দিন দাদা-বৌদির নিষ্ঠুর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লেন একদিন। বোনের বাড়ি যাবেন কিনা ভাবতে ভাবতে মেদিনীপুরে এসে পৌছলেন। সেখানে একজনের সাথে তাঁর পরিচয় হয় যিনি ক্ষুদিরামের বোনের বাড়ি চিনতেন, তিনি তাঁকে সেই বাড়িতে পৌছে দিলেন। বোনের বাড়িতে যাওয়ার পর তিনি মেদিনীপুর হ্যামিলটন স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হলেন। এরপর ভর্তি হন কলেজিয়েট স্কুলে। এই স্কুলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন।
ক্লাস ফাঁকি দেয়া ও পড়াশোনা না করার জন্য স্কুলের শিক্ষকরা তাঁকে বিভিন্ন শাস্তি দিতেন। ক্ষুদিরাম তাঁর মতো বাউণ্ডুলে স্বভাবের ছেলেদের নিয়ে ভূত ধরা এবং তাড়ানোর দল গড়লেন। তখনকার দিনের কুসংস্কার তাঁকে মোটেও স্পর্শ করতে পারেনি। বরং সমাজের মানুষের মধ্য থেকে কুসংস্কার দূর করার জন্য চেষ্টা চালান তিনি। এজন্য তাঁকে অনেকের বকাবকি খেতে হয়েছে। এক পর্যায়ে স্কুল ছেড়ে দিলেন। মেধাবী, দুরন্ত এবং কিছুটা বাণ্ডুলে স্বভাবের কিশোর ক্ষুদিরাম ১৯০৩ সালে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে পড়াশুনা বন্ধ করে দেন। এ সময় তিনি ঝুঁকে পড়েন দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডে। অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সংকল্প গ্রহণ করেন তিনি।
ক্ষুদিরাম বসু তার শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বোস এর নিকট হতে এবং শ্রীমদ্ভগবদগীতা পড়ে ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে বিপ্লব করতে অনুপ্রাণিত হন। তিনি বিপ্লবী রাজনৈতিক দল ‘যুগান্তরে’ যোগ দেন।
বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন ক্ষুদিরাম বসু। এ সময় ক্ষুদিরাম সত্যেন বসুর নেতৃত্বে গুপ্ত সংগঠনে যোগ দেন। এখানে তিনি শারীরিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক ও রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। এখানে পিস্তল চালনার শিক্ষাও হয়। এই গুপ্ত সংগঠনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে ক্ষুদিরাম ইংল্যান্ডে উৎপাদিত কাপড় জ্বালিয়ে দেন এবং ইংল্যান্ড থেকে আমদানীকৃত লবণবোঝাই নৌকা ডুবিয়ে দেন। এসব কর্মকান্ডে তাঁর সততা, নিষ্ঠা, সাহসিকতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়। ফলে ধীরে ধীরে গুপ্ত সংগঠনের ভেতরে তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
১৯০৭ সালে বিপ্লবী দলের অর্থের প্রয়োজনে ক্ষুদিরাম এক ডাকহরকরার কাছ থেকে মেইলব্যাগ ছিনিয়ে নেন। সে সময় বিপ্লবীদের রাজদ্রোহ মামলায় কঠোর শাস্তি দেওয়ার জন্য কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড মরিয়া হয়ে ওঠেন। ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তিমূলে কাঁপন ধরাতে বিপ্লবীরা প্রথমেই সিদ্ধান্ত নেন কিংসফোর্ডকে হত্যা করার।
যথাসময় এ দায়িত্ব দেওয়া হয় ক্ষুদিরাম বসুর ওপর। আর তাঁর সহযোগী করা হয় রংপুরের আরেক যুবক বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকীকে। বিপ্লবীদের সম্ভাব্য আক্রমণ এড়াতে কিংসফোর্ডকে বদলি করা হয় মজফফরপুরে। দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ দুই তরুণ বিপ্লবী জীবনের কঠিন ব্রত পালন করতে রওনা দিলেন মজফফরপুর। দুজনে আশ্রয় নিলেন কিংসফোর্ডের বাসভবনের পাশের একটি হোটেলে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁরা কিংসফোর্ডের গতিবিধি লক্ষ করতে থাকেন। কিংসফোর্ডের বাসভবনের পাশেই ইউরোপিয়ান ক্লাব। অফিস আর ক্লাব ছাড়া কিংসফোর্ড বাইরে যেতেন না। ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল। সেদিন কিংসফোর্ডের খেলার সঙ্গী ছিলেন অ্যাডভোকেট কেনেডির স্ত্রী ও তাঁর মেয়ে। রাত আটটার দিকে খেলা শেষ করে মিস ও মিসেস কেনেডি কিংসফোর্ডের গাড়ির মতো হুবহু দেখতে আরেকটি গাড়ি নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। বাইরে আগে থেকেই দুই বিপ্লবী প্রস্তুত ছিলেন। গাড়িটি ফটক পার হতে না হতেই প্রচণ্ড শব্দে পুরো শহর কাঁপিয়ে একটি বোমা বিস্ফোরিত হলো। কেনেডির স্ত্রী ও তাঁর মেয়ে ঘটনাস্থলে মারা যান। বিধ্বস্ত গাড়িটি এক পাশে উল্টে পড়ে। যাঁকে হত্যার জন্য বোমার বিস্ফোরণ, সেই কিংসফোর্ডের অক্ষত গাড়িটি মাত্র কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে।
বোমা নিক্ষেপ করেই দুই বিপ্লবী ছুটলেন দুই দিকে। পরদিন সকালে ওয়াইসি রেলস্টেশনে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন ক্ষুদিরাম। ওদিকে প্রফুল্ল চাকীও পুলিশের হাতে ধরা পড়তেই তড়িঘড়ি করে নিজের পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যা করলেন। ক্ষুদিরাম গ্রেপ্তার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা শহর যেন মুহূর্তে ভেঙে পড়ল। পুলিশবেষ্টিত ক্ষুদিরামকে একনজর দেখতে হাজারো লোক ভিড় জমাল ওয়াইসি রেলস্টেশনে। উৎসুক জনতার উদ্দেশে ক্ষুদিরামের কণ্ঠে তখন ধ্বনিত হলো বজ্রনিনাদ বন্দেমা। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই তরুণ বিপ্লবীকে নিয়ে ব্রিটিশ সরকার অনেকটা বিপাকেই পড়ে যায়। যত দিন যাচ্ছিল, সারা ভারতে ক্ষুদিরামকে নিয়ে এক ধরনের উন্মাদনা তৈরি হচ্ছিল। ব্রিটিশের মাথা থেকে সেই বোঝা নেমে যায় সেদিন, যেদিন মামলায় ভারতীয় দণ্ডবিধি আইনের ৩০২ ধারা মোতাবেক ক্ষুদিরামের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়। যে বোমা হামলার জন্য তাকে মৃত্যদণ্ড দেয়া হয় তাতে ৩ জন ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছিলেন।
ক্ষুদিরামের লেখা গান:
একবার বিদায় দে-মা ঘুরে আসি।
হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে জগৎবাসী।
কলের বোমা তৈরি করে
দাঁড়িয়ে ছিলেম রাস্তার ধারে মাগো,
বড়লাটকে মারতে গিয়ে
মারলাম আরেক ইংল্যান্ডবাসী।
শনিবার বেলা দশটার পরে
জজকোর্টেতে লোক না ধরে মাগো
হল অভিরামের দ্বীপ চালান মা ক্ষুদিরামের ফাঁসি
দশ মাস দশদিন পরে
জন্ম নেব মাসির ঘরে মাগো
তখন যদি না চিনতে পারিস দেখবি গলায় ফাঁসি'
এই গানের মধ্যে দেশমাতাকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য যাঁর আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে এবং যাঁর কথা উঠে এসেছে তিনি এ উপমহাদেশেরই সূর্যসন্তান, ক্ষুদিরাম। এই গানটি আজও বিভিন্ন গণ আন্দোলনে অনুপ্রেরণা যোগায়, উৎসাহিত করে দেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্রে শপথ নিতে। এই গানের কিংবদন্তি অগ্নিযুগের অগ্নিজিতা বিপ্লবী ক্ষুদিরাম।
১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ভোর পাঁচটায় ব্রিটিশ সরকার ১৮ বছরের এক তরতাজা যুবককে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড় করাল। কারাফটকের বাইরে তখন হাজারো জনতার কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে ‘বন্দেমাতরম’ স্লোগান।
ফাঁসিতে ঝোলানোর আগে কারা কর্তৃপক্ষ যুবকটির কাছে জানতে চাইল, মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ ইচ্ছা কী? যুবকটি এক সেকেন্ড অপেক্ষা না করেই নিঃশঙ্কচিত্তে বলে উঠলেন, ‘আমি ভালো বোমা বানাতে পারি, মৃত্যুর আগে সারা ভারতবাসীকে সেটা শিখিয়ে দিয়ে যেতে চাই।’ উপস্থিত কারা কর্তৃপক্ষ সেদিন বিস্মিত হলো যুবকটির মানসিক দৃঢ়তা আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতি তীব্র ঘৃণাবোধ উপলব্ধি করে।
ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা ক্ষুদিরাম বসুর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়, ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট । হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলেন ক্ষুদিরাম এবং নিজ হাতে ফাঁসির দড়ি গলায় পড়েন। ফাঁসি মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছর, ৭ মাস ১১ দিন।
তথ্য সংগৃহীত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন