শুক্রবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৬

‘বাংলা সন’ হিজরী সন ভিত্তিক মুসলমান কর্তৃক প্রবর্তিত এবং বিজ্ঞানসম্মত



সন তারিখ দুটিই আরবী শব্দ। প্রথমটির অর্থ হল বর্ষ বা বর্ষপঞ্জী এবং অন্যটির অর্থ দিনতারিখ বলতে আবার ইতিহাসও বোঝায়। সাল হচ্ছে একটি ফারসী শব্দ, যার অর্থ হল বৎসর। বাংলা সনের সূত্রপাত হয় আরবী হিজরী সনের ওপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ ইসলামী সনের ওপর ভিত্তি করেই একজন মুসলমান বাদশাহ  সম্রাট আকবর কর্তৃক বাংলা সনের প্রবর্তন।



ভারতে ইসলামি শাসনামলে হিজরি পঞ্জিকা অনুসারেই সকল কাজকর্ম পরিচালিত হতো। মূল হিজরি পঞ্জিকা চান্দ্র মাসের উপর নির্ভরশীল। চান্দ্র বৎসর সৌর বৎসরর চেয়ে ১১/১২ দিন কম হয়। কারণ সৌর বৎসর ৩৬৫ দিন, আর চান্দ্র বৎসর ৩৫৪ দিন। একারণে চান্দ্র বৎসরে ঋতুগুলি ঠিক থাকে না। আর চাষাবাদ ও এজাতীয় অনেক কাজ ঋতুনির্ভর। এজন্য ভারতের মোগল সম্রাট আকবারের সময়ে প্রচলিত হিজরি চান্দ্র পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সম্রাট আকবর ইরান থেকে আগত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে হিজরি চান্দ্র বর্ষপঞ্জীকে সৌর বর্ষপঞ্জীতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। ওমর ফতুল্লাহ্ শিরাজির সুপারিশে পারস্যে প্রচলিত সৌর বর্ষপঞ্জীর অনুকরণে ৯৯২ হিজরি মোতাবেক ১৫৮৪ খৃস্টাব্দে সম্রাট আকবার হিজরি সৌর বর্ষপঞ্জীর প্রচলন করেন। তবে তিনি ঊনত্রিশ বছর পূর্বে তার সিংহাসন আরোহনের বছর থেকে এ পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। এজন্য ৯৬৩ হিজরি সাল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। ইতোপূর্বে বঙ্গে প্রচলিত শকাব্দ বা শক বর্ষপঞ্চির প্রথম মাস ছিল চৈত্র মাস। কিন্তু ৯৬৩ হিজরি সালের মুহাররাম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস, এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং ১লা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়।




 সম্রাট আকবরের খাজনা আদায়ের হিসাব সংরক্ষণের বিষয়টি ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।গড়মিল ছিলো হিসাব সংরক্ষণের সময় ও সংখ্যা নিয়ে। সংখ্যা মিলতো কিন্তু সময় মিলতো না। একেক জনের হিসাব সংরক্ষিত হতো একেক সময় হিসেবে। সম্রাট আকবর রাজজ্যোতিষী আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজীকে নির্দেশ দিলেন, এই সমস্যার সমাধান চাই আমি।

 ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি মোতাবেক ৯৬৩ হিজরির ২৮ রবিউস সানি তারিখে সম্রাট জালালুদ্দিন আকবর শাহ সিংহাসনে আসিন হন। সম্রাটের এই ক্ষমতা গ্রহণের স্মৃতিকে চিরভাস্কর করে রাখার উদ্দেশ্যে রাজজ্যোতিষী ফতেহ উল্লাহ সিরাজী ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১ এপ্রিলকে পহেলা তারিখ নির্ধারণ করে খাজনা আদায় এবং এর যাবতীয় হিসাব-নিকাশ সংরক্ষণের উপযোগী করে হিজরি ৯৬৩ সনের সাথে পরবর্তী সৌরমাস ও বছরের সংখ্যা যোগ করে নতুন একটি ফসলি সন প্রবর্তন করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে এই সন সৌরমাস হিসেবে গণনা হতো। পরর্বতীতে রাজজ্যোতিষী ফতেহ উল্লাহ প্রবর্তিত এই ফসলি সনই বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের রুপান্তিত হয়।

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সৌরদিন গণনা শুরু হয়। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে মোট ৩৬৫ দিন কয়েক ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন হয়। এই সময়টাই এক সৌর বছর। খ্রিস্টান পোপ গ্রেগরী  ইংরেজি ক্যালেন্ডারের প্রণেতা । গ্রেগরিয়ান সনের মতো বাংলা সনেও মোট ১২ মাস। এগুলো হল বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র। 

গ্রেগেরিয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাংলাদেশে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন করা হয়৷ সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই শুরু হয় বাঙ্গালির পহেলা বৈশাখ উত্সাব৷ বাংলা দিনপঞ্জির সাথে হিজরি ও খ্রিষ্টিয় সালের সাথে কিছুটা মৌলিক পার্থক্য রয়েছে৷ প্রচলিত হিজরি সালের নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় নতুন চাঁদের আগমনে, ইংরেজি দিন শুরু হয় মধ্যরাতে, আর বাংলা সাল শুরু হয় ভোরে বা সূর্যোদয়ের সাথে সাথে৷ এ ছাড়াও সৌর সাল হয় ৩৬৫ দিনে আর চান্দ্র হয় ৩৫৪ দিনে অর্থাত্‍ চান্দ্র সাল সৌর সাল থেকে ১১ দিন কম৷ সে কারণেই হিজরি ও চান্দ্র সালের মধ্যে ১১ দিন করে ব্যবধান বাড়তে থাকে৷ বাংলা সালে ১২ মাসে মোট ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা৷

অতীতে ১২ মাসের কাল বিন্যাসে কিছুটা জটিলতা থাকায় ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ড.মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ্কে সভাপতি করে বাংলা বর্ষপঞ্জি পুনর্বিন্যাসের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল৷ এ কমিটি ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ১৭ ফেব্রুয়ারিতে প্রচলিত বাংলা সালের মূল কাঠামো ঠিক রেখে বছরের প্রথম পাঁচ মাস ৩১ দিন এবং শেষের সাত মাস ৩০ দিন ধরে বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কারের সুপারিশ করে যা ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ১৯ জুন বাংলা সৌর সালের নিয়মতান্ত্রিকতা কার্যকর করা হয়৷ ফলে বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যনত্ম ৩১ দিন এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যনত্ম প্রতি মাস ৩০ দিন করে গণনা করা হয়৷ এ ছাড়াও বছরে বাড়তি ৬ ঘন্টার জন্য গ্রেগরিয় বর্ষপঞ্জিতে অধিবষের্র (লিপইয়ার) মতো বাংলা বর্ষপঞ্জিতেও অধিবর্ষ হিসেবে চৈত্র মাসকে ৩১ দিন হিসাবে ধরা হয়৷

সংশোধিত এই বাংলা সন এ দেশ কিন্তু সহজে গ্রহণ করেনি। গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডারের স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় দেশগুলো যে  রকম গড়িমসি করেছিল, বাংলা একাডেমি কর্তৃক সংশোধিত বাংলা সন গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশেও কিন্তু কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা যায়। ফলে, সংশোধনের প্রায় দুই যুগ পর ১৯৮৮ সালের ১৯ জুন তারিখে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বাংলা সন-এর সংশোধিত রূপ স্বীকৃত হয়।

মোঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে তারই নির্দেশে ৯৯৮ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সনের প্রবর্তন হয়। বাদশাহ আকবর ৯৬৩ হিজরীতে অথাৎ ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে (১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে) দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনা চিরন্তরণীয়  করে রাখার জন্য ৯৬৩ হিজরী অবলম্বন করেই বাংলা সন চালু করা হয়।

মহানবী (সা.) স্বয়ং আনুষ্ঠানিকভাবে হিজরী সন চালু করেননি। এটি প্রবর্তন করেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা.) ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে।

হিজরী সনের ক্ষেত্রে যে রকম হিজরতের দিন ও মাস (১২ রবিউল আউয়াল) সুনির্দিষ্টভাবে অবলম্বন না করে শুধুমাত্র সালটিকেই (৬২২ খ্রিস্টাব্দে) সংরক্ষণ করা হয়, বাংলা সনের ক্ষেত্রেও তেমনি সম্রাট আকবরের রাজ্যভিষেকের দিন ও মাস (১৪ইং ফেব্রুয়ারি) অবলম্বন না করে শুধুমাত্র বৎসরটি (৯৬৩ হিজরী) সংরক্ষিত হয়।

১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে মুগল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন বলে বেশিরভাগ পণ্ডিত মনে করেন। ঐ সময়ে বঙ্গে শক বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হতো, যার প্রথম মাস ছিল চৈত্র। বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রথমে তারিখ-ই-এলাহী বা ফসলি সন নামে পরিচিত ছিল। ১৫৮৪ সালের ১০ বা ১১ মার্চ তারিখে এটি বঙ্গাব্দ নামে প্রচলিত হয়।

১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ নভেম্বর, এবং ৯৬৪ হিজরির ১ মুহররম তারিখে মাত্র ১৩ বছর বয়সে সম্রাট হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্যকে ২য় পানিপথের যুদ্ধে পরাজিত করেন। পানিপথের যুদ্ধে সম্রাট আকবরের বিজয়কে মহিমান্বিত করে রাখবার জন্য, এবং অধিকতর পদ্ধতিগত উপায়ে রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশে এ বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়েছিল। সম্রাট যে মাসে সিংহাসনে অরোহণ করেন, তার নিকটতম হিজরি বছরের ১ম মাসকে ভিত্তি ধরা হয়। ৯৬৩ হিজরির ১ মহররম ছিল নিকটতম। ঐ বছর শকাব্দের ১ বৈশাখ এবং হিজরির ১ মহররম একই দিনে এসেছিল। বৈশাখ হলো শকাব্দের ২য় মাস, চৈত্র ১ম মাস। ৯৬৩ হিজরির ১ মহররমকে বাংলা ৯৬৩ সনের ১ বৈশাখ পরিচিহ্নিত করে বাংলা সন শুরু করা হয়।

কিন্তু ৯৬৩ হিজরীতে যখন ফসলী সন বা বাংলা সন শুরু করা হয়, তখন হিজরী সনের প্রথম মাস মহররম বৈশাখ মাসের সঙ্গে মিশে যায়। ফলে, এ দেশে ১লা বৈশাখই  নওরোজ বা নববর্ষ হিসেবে পরিচিহ্নিত হয়। উল্লেখ্য, ইংরেজি তথা গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডারের ক্ষেত্রেও প্রথমে ১লা মার্চ ছিল নিউ ইয়ারস ডে। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে পহেলা জানুয়ারি সে সম্মানজনক স্থান দখল করে নেয়।
সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এ সময় থেকেই অসাম, ত্রিপুরা, বঙ্গ, কেরল, মণিপুর, নেপাল, উরিষ্যা, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ুতে নববর্ষ উদযাপিত হতো৷ কিন্তু সার্বজনীন উত্সলব হিসেবে নয়৷ তখন নববর্ষ ঋতুধর্মী উত্সরব হিসেবে পালন করা হতো৷ এ উত্সলবের মূল বিষয় ছিল কৃষিকাজকে প্রাধান্য দেয়া ৷ কেননা এ সময় সমাজ-অর্থনীতি কৃষিকাজের উপর অধিকাংশ নির্ভরশীল ছিল৷



চৈত্র মাসের শেষ দিনে (সংক্রানত্মি) জমিদারি সেরেসত্মায় প্রজাদের কাছ থেকে কৃষি ও রাজস্ব কর বা খাজনা আদায় করা হতো৷ এ সময় প্রত্যেক চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো৷ এর পরের দিন, অর্থাত্‍ পহেলা বৈশাখ ভূমির মালিকরা নিজেদের অঞ্চলের প্রজা বা অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করতেন৷ এ উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো৷ এ সময় থেকেই হালখাতা উত্সকবের প্রচলন হয় ৷ এ দিনে মহাজনরা পুরানো দেনা-পাওনার হিসাব বন্ধ করে নতুন হিসাবের খাতার সূচনা করতেন যার প্রচলন আজও আছে৷ মূলত এ ধরনের উত্সনবের মাধ্যমে দেনাদার ও পাওনাদারের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্কের সূচনা হতো৷

সম্রাট আকবরের আমলে ফার্সি মাসের অনুকরণে বাংলা মাসের নাম ছিল যথাক্রমে কারওয়ারদিন (Karwadin),, আর্দি (Ardi), খোরদাদ( Khordad ), তীর( Teer), আমারদাদ (Amardad), শাহারিবার (Shahriar), ভিহিসু (Vihisu), আবান (Aban), আজার (Azur), দে( Dai ), বাহমান (Baham) ও ইসফান্দা মিজ( Iskander Miz )৷ এ পঞ্জিকার প্রথম নাম ছির তারিখ-ই ইলাহি(Tarikh-e-Elahi )৷ পরবর্তীকালে নানা ঘটনাক্রমে মাসের নামগুলো বিভিন্ন তারকার নাম অনুসারে বর্তমান নামে প্রর্বতন করা হয়৷


সম্রাট আকবরের সময় মাসের প্রতিটি দিনের জন্য পৃথক পৃথক নাম ছিল। সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে এ জটিল প্রথা পরিহার করে সপ্তাহের সাতটি দিনের জন্য সাতটি নাম নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে ব্যবহৃত ঐ সাতটি নামের সঙ্গে রোমান সাপ্তাহিক নামগুলোর সাদৃশ্য সহজেই পরিলক্ষিত হয়। অনুমিত হয় যে, বাদশাহ শাহজাহানের দরবারে আগত কোন ইউরোপীয় (সম্ভবত পর্তুগীজ) মনীষীর পরামর্শক্রমে মূলত গ্রহপুঞ্জ থেকে উভূত নিম্নবর্ণিত নামগুলোর প্রচলন করা হয় : (১) রবি (সূর্য)- ঝঁহ বা সূর্য থেকে, (২) সোম (চন্দ্র) গড়হধহ অর্থাৎ গড়ড়হ থেকে, (৩) মঙ্গল গধৎং বা মঙ্গল গ্রহ থেকে, (৪) বুধ গবৎপঁৎু বা বুধ গ্রহ থেকে, (৫) বৃহস্পতি ঔঁঢ়রঃবৎ বা বৃহস্পতি গ্রহ থেকে, (৬) শুক্র ঋৎরমম  (বা ঠবহঁ ) থেকে এবং (৭) শনিবার ঝধঃঁৎহ বা শনি গ্রহ থেকে।

বাংলা সন মূলত : ইসলামী হিজরী সনের উপর নির্ভরশীল হলেও শকাব্দের নিকটও সে কিঞ্চিৎ ঋণী। বাংলা সনে আমরা বর্তমানে দিন ও মাসের যে নামগুলো ব্যবহার করি সেগুলো শকাব্দ থেকেই গৃহীত।  মাসের নামগুলো, যেমন বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ ইত্যাদি আমরা পেয়েছে নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে।

বর্তমান ভারতের জাতীয় সন হচ্ছে শকাব্দ। রাজা চন্দ্রগুপ্ত ৩১৯ অব্দে গুপ্তাব্দ প্রবর্তন করেন। এই সন পরে বিক্রমাব্দ নামে অভিহিত হয়। এই অব্দ প্রথমে শুরু হতো চৈত্র মাস থেকে। পরবর্তী পযায়ে কার্তিক মাসকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে পরিচিহ্নিত করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ১৫ সালে ভারতে শক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। শক সনের স্মারক হিসেবে ৭৮ খ্রিস্টাব্দে শাকাব্দ চালু করা হয়। সৌরভিত্তিক শকাব্দের রবিমার্গের দ্বাদশ রাশির প্রথম মেঘ অন্তর্গত পূর্ণচন্দ্রিকাপ্রাপ্ত প্রথম নক্ষত্র বিশাখার নামানুষারে বৎসরের প্রথম মাসের নাম রাখা হয় বৈশাখ। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে, নাক্ষত্রিক নিয়মে বাংলা সনের মাসগুলোর নাম নিম্নেবর্ণিত নক্ষত্রসমূহের নাম থেকে উদ্ভত হয়েছে
 বিশাখা নক্ষত্রের নাম থেকে বৈশাখ; জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নাম থেকে জ্যৈষ্ঠ; উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রের নাম থেকে আষাঢ়; শ্রবণা নক্ষত্রের নাম থেকে শ্রাবণ; পূর্বভাদ্রপদ নক্ষত্রের নাম থেকে ভাদ্র; আশ্বিনী নক্ষত্রের নাম থেকে আশ্বিন; কৃত্তিকা নক্ষত্রের নাম থেকে কার্তিক; মৃগশীরা নক্ষত্রের নাম থেকে মাগশীষর্ (অগ্রহায়ণ); পৃষ্রা নক্ষত্রের নাম থেকে পৌষ; মঘা নক্ষত্রের নাম থেকে মাঘ; উত্তর ফাল্গুনী নক্ষত্রের নাম থেকে ফাল্গুন; চিত্রা নক্ষত্রের নাম থেকে চৈত্র৷

আমাদের সংস্কৃতির এক মৌলিক উপাদন বাংলা বর্ষপঞ্জি৷ এ বর্ষপঞ্জির সূচনা হয় নববর্ষ উত্সকব দিয়ে যা আমাদের জাতীয় চেতনার মূর্ত প্রতীক৷ এ উত্সকবের উদ্ভব হয়েছিল বাংলার কৃষক সমাজের মধ্য দিয়ে৷ আজও বাংলা বর্ষ আমাদের কৃষক সমাজের চেতনায় বিঁধে আছে ও মিশে আছে জীবনের সঙ্গে৷ কোনো মাসের নামের সাথে মিশে আছে ফসল, আহরণ ও বিভিন্ন ধরনের আনন্দ উত্স বের সম্পর্ক৷

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয় রমনার বটতমূলে মুক্ত চিন্তার সংগঠন ছায়ানটের_এসো হে বৈশাখ এসো এসো গানের মাধ্যমে৷ এ গানটি পরিবেশনের মধ্য দিয়ে নতুন বছরের সূর্যকে আহ্বান করা হয়৷ ১৯৬০ দশকে পাকিস্থানী শাসক গোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সংস্কৃতি চর্চা বন্ধের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু হয়৷ ১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্রছাত্রীরা বের করে মঙ্গল শোভাযাত্র৷ এ শোভাযাত্রায় স্থান পায় বাংলার পশুপাখি আর অন্যান্য বিচিত্র চেহারার মুখোশ যা বৈশাখ উদযাপনকে আরো অধিক আকর্ষণীয় ও মোহনীয় করে তোলে ৷ 

এ শোভাযাত্রায় হাজার হাজার বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ অংশ নেয়৷ বিশাল এলাকা জুড়ে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী ও বযস্কদের পথচারণে মুখরিত হয়ে উঠে রাজপথ৷ হাতে বেলুন, বাউলের একতারা, ছোট ডুগডুগি নিয়ে ঢাকের বাদ্যের তালে তালে নেচে নেচে আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ে নব বৈশাখে ৷ মূলত এ শোভাযাত্রার মাধ্যমে গ্রামীণ জীবন এবং অবহামান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়৷ এ শোভা যাত্রার জন্য তৈরি করা হয় রঙ-বেরঙের বিভিন্ন আকৃতির মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি৷ এ ছাড়াও সকল বিভাগীয় ও জেলা শহরে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের অয়োজন করা হয়৷ ১৯৮৩ সালে শুরু হয় পাআত্ম ইলিশের প্রচলন যা বর্তমানে অত্যনত্ম জনপ্রিয় বৈশাখের পানত্মা ইলিশ সংস্কৃতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে এবং এর শিকড়ের বিস্তৃতি লাভ করেছে শহর ছেড়ে গ্রামেও৷

পারসিকগণ খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ সালে এই নববর্ষ পালন বা নওরোজের প্রর্বতন করেছিলেন এবং এ ধারাবাহিকতায় এখনো ইরানে নওরোজ বা নববর্ষ জাতীয় উত্সিব হিসেবে পালিত হয়৷ ইরান থেকেই এ ধরনের একটি সংস্কৃতিক ধারা মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রবেশ করে৷

বেবিলনে নববর্ষ উদ্যাপিত হতো আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে যা ছিল সে দেশের সর্ববৃহত্‍ জাতীয় উত্সপব৷ এ উত্সগব ১১ দিন ধরে পালন করা হতো৷ ফরাসি, গ্রিক, মিসর, ভারত, চিন, ভিয়েতনাম, লাওসেও বর্ষবরণ উত্স`বের প্রচলন রয়েছে৷ এ ছাড়া উন্নত বিশ্বের সকল দেশেই নববর্ষ বিশেষ ধুম-ধামের সাথে পালন করা হয়৷ ইংরেজি নববর্ষ ইউরোপ ও আমেরিকায় আনন্দের জোয়ার বয়ে আনে৷ গ্রেগরিয় পঞ্জিকা সারা বিশ্বে অধিক অনুসৃত হয় বলে পহেলা জানুয়ারি বিশ্বে মহোত্স ব বয়ে যায়৷ এর ঢেউ আমাদের দেশেকেও কম আলোড়িত করে না ৷

সন হিসেবে বাংলা সন নিঃসন্দেহে অতীব কার্যকর ও বিজ্ঞানসম্মত বলে বিবেচিত হয়। এর কারণ হল এটি একই সঙ্গে চান্দ্র (খঁহধৎ) ও সৌর (ঝড়ষধৎ) পদ্ধতির সার্থক উত্তরাধিকারী। এর প্রথমাংশ, অর্থাৎ ৯৬৩ বৎসর, সম্পূর্ণরূপে হিজরী সনভিত্তিক তথা চন্দ্র সন। পরবর্তী অংশ, অর্থাৎ ৯৬৩ থেকে অদ্যবধি, সৌর ভিত্তিক। ফলে, বিশ্বে সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত ইংরেজি তথা গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডারের সঙ্গে বাংলা সন সামঞ্জস্য রেখে চলে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, ৯৬৩ বাংলা বর্ষে পহেলা বৈশাখ হয়েছিল ১১ই এপ্রিল, ১৫৫৬ তারিখে। এ বৎসর, অর্থাৎ ১৪২৩ বাংলা সনে, পহেলা বৈশাখ আমরা পাচ্ছি ১৪ই এপ্রিল। অর্থাৎ ১৪২৩-৯৬৩=৪৬০ বছরে পার্থক্য হয়েছে মাত্র ৩ দিন। আর, ভবিষ্যতে সে পার্থক্য এর চেয়ে একদিনের অধিক কখনও হবে না। বিজ্ঞানসম্মত এবং মুসলমান কর্তৃক প্রবর্তিত হিজরী ভিত্তিক এই বাংলা সন নিঃসন্দেহে আমাদের গৌরব।






কোন মন্তব্য নেই: