ডালিম – যাকে আমরা আনার বা বেদানা ইত্যাদি
বিভিন্ন নামে চিনি। ডালিমের উন্নত
জাতই হলো আনার বা বেদানা। আনার খুবই আকর্ষণীয়, মিষ্টি, সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর একটি
ফল। নিয়মিত পরিচর্যা করলে আনার গাছ থেকে সারা বছর ফল পাওয়া যাবে।
আনারের খাদ্য উপযোগী অংশ এরিল নামে পরিচিত।
এত সুস্বাদু একটি ফলের উৎপত্তি ইরান ও ইরাক । মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, পাকিস্তান
ও আফগানিস্তানে জলবায়ুতে সেরা ডালিম বা আনার চাষ হয়।
জালবায়ু ও মাটি
আনার
শুকনো গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়া এবং নিম্ন তাপমাত্রা বেষ্টিত শীতপ্রধান দেশে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট
মানের হয়ে থাকে। যেহেতু আমাদের দেশে নিম্ন তাপমাত্রা উত্তরাঞ্চলে খানিকটা পাওয়া
যায়, সেহেতু ওইসব অঞ্চলে মোটামুটি ভালমানের আনার বা বেদানা চাষ করা সম্ভব।
আনার
চাষের জন্যে উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়া খুবই প্রয়োজন। ডালিমের জন্যে সবচেয়ে ভাল মাটি হল
বেলে দোআঁশ বা পলি মাটি। ডালিম কাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না।
আনারের জাত ও বংশবিস্তার
পৃথিবীতে আনারের অনেক জাত বর্তমান। এর মধ্যে উন্নত জাতের আনার
বা বেদানা হচ্ছে রুবি, পেপার সেল, ওয়ান্ডারফুল, মাসকেট রেড প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
তবে আমাদের দেশে যেসব ডালিম চাষাবাদ হয় তাদের মধ্যে ঢোল্কা, ভাদকি ও
জিবিজিআই, বেদানা ,কান্ধারী ইত্যাদী গুরুত্বপূর্ণ। ঢোল্কা
জাতের ফলের শাঁস সাদা ও বীজ নরম। অন্যদিকে ভাদকি ও জিবিজিআই জাতের শাঁস গোলাপি ও
বীজ শক্ত।
বাংলাদেশে আনারের কোনো অনুমোদিত জাত নেই। এর মধ্যে দুটি জনপ্রিয়
জাত হল বেদানা ও কান্ধারী।
আনারের
বংশবিস্তার মূলত বীজ, কলম ও শেকড় সাকারের মাধ্যমে হয়ে থাকে। শাখা কলম ও গুটিকলম এই
দুটি পদ্ধতি অনেক জনপ্রিয় যেহেতু এতে মাতৃ উদ্ভিদের গুণাগুণ বজায় থাকে। শাখাকলম
করার জন্যে ১ বছর বয়সী গাছের ২৫-৩০ সেন্টিমিটার আকৃতির ডাল নেওয়া ভাল।
মাদা তৈরি
গাছ
থেকে গাছের উপযুক্ত দূরত্ব ৩ মিটার x ৩ মিটার। গর্ত তৈরি করতে হবে ৬০ সেন্টিমিটার
x ৬০ সেন্টিমিটার x ৬০ সেন্টিমিটার আকৃতির। গর্ত তৈরি করে ৫-১০ গর্তটি
রোদে শুকাতে হবে যেন কিছু গ্রোথ ব্যাক্টেরিয়া ও ফাঙ্গাস মরে যায়। এরপর ১৫-২০ কেজি
পচা গোবর, ২৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ২৫০ গ্রাম এমওপি সার দিয়ে গর্ত ভরাট করে নিতে হবে।
গর্ত ভরাটের ১০-১৫ দিন পর চারা রোপন করতে হবে।
গর্তের
মাঝে চারা বসিয়ে দিয়ে সোজা রাখতে কোনো খুঁটি ব্যবহার করতে হবে। চারা রোপন করেই
পানি দিতে হবে গাছে। নিয়মিত পানি দিতে হবে নিয়ম মাফিক।
ডাল ছাঁটাই
গাছের
গোড়ার দিকে ১-১.৫ মিটার পর্যন্ত কোনো ডাল রাখা যাবে না। এর উপর থেকে প্রতি পাশে
৪-৫ টি ডাল রেখে দিতে হবে যেন সুন্দর আকৃতি বিশিষ্ট হয়। ফল সংগ্রহের পর দূর্বল,
রোগাক্রান্ত, মরা ডাল কেটে ফেলতে হবে। ডালিম গাছে পুরনো ডালের চেয়ে নতুন ডালে
মুকুল আসার সম্ভাবনা বেশি, সেহেতু পুরনো ডাল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেটে ফেলে দিতে
হবে।
আনার
গাছের শিকড় ছাঁটাইঃ
আনার গাছে সারা বছরই ফুল ও ফল হয়ে থাকে। সাধারণত বসন্তে এবং
বর্ষার সময় গাছে বেশি ফুল ধরে। বসন্তের ফুল থেকে গ্রীষ্মকালে ফল পাওয়া যায় এবং এর
গুণাগুণ খুবই নিম্নমানের হয়ে থাকে। কিন্তু বর্ষার ফুল থেকে প্রাপ্ত ফল
অক্টোবর-নভেম্বরে সংগ্রহ করা যায়, যার গুণগত মান খুবই ভালো হয়। তাই অসময়ে তথা
বর্ষায় গাছে ফুল আসার জন্য মার্চ-এপ্রিল মাসে ১৫ সেমি.গভীর করে মাটি খুঁড়ে
শিকড়গুলোকে ১৫ দিন উন্মুক্ত করে রাখাতে হবে। পরবর্তীতে জৈব সারসহ মাটি চাপা দিয়ে
সেচ প্রয়োগ করতে হবে।
গাছে সার প্রয়োগঃ
চারা লাগানোর পূর্বে
গর্তে সার প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়াও প্রতি বছর গাছে নিয়মিত সার দিতে হবে। গর্ত করার
৮-১০ দিন পর গর্তের মাটির সাথে নিম্নলিখিত হারে সার মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে দিতে
হবে। গর্ত ভরাট করার ২০-২৫ দিন পর ডালিমের চারা রোপণ করতে হবে।
সারের নাম
|
সারের পরিমাণ/গর্ত
|
কম্পস্টের গুঁড়া
|
৫০০ গ্রাম
|
ইউরিয়া
|
১৫০ গ্রাম
|
টিএসপি
|
১০০ গ্রাম
|
এমওপি
|
১০০ গ্রাম
|
জিপসাম
|
৭০ গ্রাম
|
১ বছর বয়সের প্রতিটি
গাছে গোবর ১০ কেজি, ইউরিয়া ১২৫ গ্রাম, টিএসপি ১২৫ গ্রাম এবং পটাশ সার ১২৫ গ্রাম
প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি বছর সারের মাত্রা একটু করে বাড়াতে হবে। পর্যায়ক্রমে পূর্ণ
বয়স্ক ১ টি গাছে ৬০ কেজি গোবর, ১.৫ কেজি ইউরিয়া, ১.৫ কেজি টিএসপি এবং
১.৫ কেজি এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) সার প্রয়োগ করতে হবে। উপরিউক্ত পরিমাণ সার
২ বারে গাছে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম বারে জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ( মে- জুন ) মাসে এবং
২য় বারে আশ্বিন-কার্তিক ( সেপ্টেম্বর- অক্টোবর ) মাসে গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে
হবে।
সেচ ও নিষ্কাশন
মাটিতে
অবশ্যই হালকা সেচ দিতে হবে। ডালিম গাছের গোড়া বেশি শুকনো থাকা বা পানি জমে থাকা
দুটোই ক্ষতিকর। পানির অভাবে ডালিম ফল গাছে থাকতেই ফেটে যেতে পারে। এজন্যে
বোরনমিশ্রিত পানি দিতে হবে।
বিশেষ পরিচর্যাঃ
আনার গাছে সারা বছরই কিছু না কিছু ফুল আসে। তবে সব সময়ের ফুল থেকে ফল
উৎপন্ন হয় না। বসন্তকালে যে ফুল হয় সেই ফুল থেকে গ্রীষ্মকালের ফল হয় যদিও এই ফলের
মান খুব একটা ভালো হয় না। বর্ষার শুরুতে যে ফুল আসে এবং সেই ফুল থেকে যে ফল হয় তা
কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে সংগ্রহের উপযুক্ত হয় এবং এ ফলের মান বেশ ভালো হয়। তাই
বর্ষার শুরুতে ফুল আনার জন্য পৌষ মাস থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত গাছের বিশেষ পরিচর্যা
নিতে হয়। এই সময়ে গাছে পানির সেচ দেয়া বন্ধ রাখতে হয় ফলে গাছের বৃদ্ধি বন্ধ থাকে। চৈত্র মাসে গাছে সেচ দিতে হয় এবং কোদাল দিয়ে
কুপিয়ে গাছের গোড়ার মাটি আল্গা করে দিতে হয়। চৈত্র মাসে গাছের পাতা ঝরে যায় ও
বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত গাছ ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে। বর্ষা শুরু হওয়ার আগে দু-একটা
সেচ দিলে ভালো হয়। বর্ষা শুরু হওয়ার সাথে সাথে গাছের বদ্ধি ও ফুল ফল ধারণ শুরু হয়
এবং কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে এই ফল সংগ্রহের উপযুক্ত হয়।
আনারের রোগবালাই তার
প্রতিকারঃ
আনারের
প্রজাপতি বা ফলছিদ্রকারী পোকাঃ
আনার
ফলের মারাত্মক শত্রু হচ্ছে আনারের প্রজাপতি বা ফলছিদ্রকারী পোকা। এই প্রজাতির
শূঁককীট ফলের ক্ষতি করে থাকে। স্ত্রী প্রজাপতি ফুলের বৃস্তৃতি ও ছোট ফলের ওপর ডিম
পাড়ে। ডিম থেকে শূঁককীট বের হয়ে বর্ধনশীল ফলে ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং ফলের
বীজ ও অন্যান্য অংশ খেয়ে ফেলে। পরে মূককীটে পরিণত হওয়ার পূর্বে ফলের ত্বকে গোলাকার
ছিদ্র করে ফল থেকে বের হয়ে আসে। এই পোকায় আক্রান্ত ফলে মাধ্যমিক সংক্রমণ হিসেবে
ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ হতে পারে।
প্রতিকারঃ আক্রান্ত
ফল গাছ থেকে পেড়ে বা মাটিতে পড়ে থাকা ফল কুড়িয়ে নষ্ট করে ফেলতে হবে। গাছে ফলধারণের
পর ফলের বৃদ্ধি শুরু হলে কাপড় বা পলিথিন বা বাটার কাগজ দিয়ে বৃদ্ধিমান ফল ব্যাগিং করে
দিলে এ পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
প্রতি
লিটার পানিতে এক মিলিলিটার হারে ম্যালাথিয়ন বা কার্বরিল বা ফস্ফামিডন গ্রুপের
কীটনাশক দিয়ে ১৫ দিন অন্তর অন্তর গাছে ও ফলে সেপ্র করতে হবে।
কাণ্ড
ছিদ্রকারী পোকাঃ
কাণ্ড
ছিদ্রকারী পোকা সাধারণত পরিচর্যাবিহীন গাছে আক্রমণ করে থাকে। এই পোকার শূঁককীট
রাতের বেলা কাণ্ড ও শাখার ছাল ছিদ্র করে ভেতরে প্রবেশ করে এবং ভেতরের অংশ খেতে
থাকে। দিনের বেলা ডালের গর্তের মধ্যে এরা লুকিয়ে থাকে ও বর্জ্য পদার্থ ত্যাগ করে।
কাণ্ড বা শাখায় ছোট ছোট ছিদ্র বা বর্জ্য পদার্থ দেখে এ পোকার আক্রমণ লক্ষ করা যায়।
প্রতিকারঃ গর্তের
মধ্যে সরু তার ঢুকিয়ে পোকার কীড়াকে খুঁচিয়ে মারার ব্যবস্থা করতে হবে।
গর্ত থেকে এ পোকার কীড়ার বর্জ্য পদার্থ পরিষ্কার করে গর্তে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ বা তুলার সাহায্যে কেরোসিন বা পেট্রোল ঢুকিয়ে কাদা দিয়ে গর্ত বন্ধ করে দিলে পোকা মারা যাবে।
গর্ত থেকে এ পোকার কীড়ার বর্জ্য পদার্থ পরিষ্কার করে গর্তে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ বা তুলার সাহায্যে কেরোসিন বা পেট্রোল ঢুকিয়ে কাদা দিয়ে গর্ত বন্ধ করে দিলে পোকা মারা যাবে।
রস
শোষণকারী পোকাঃ
ছাতা
পোকা, সাদা মাছি, শুল্ক বা আঁশ পোকা, থ্রিপস, জাব পোকা ও মাকড়
ডালিমের রস শোষণকারী পোকা হিসেবে চিহ্নিত। এসব পোকার আক্রমণে
পাতা, মুকুল, ফুল ও ছোট ফল খসে পড়ে। সাদা মাছি ও জাব পোকা পাতা ও কচি
ডগার রস চুসে খায় ফলে আক্রান্ত অংশ বিবর্ণ ও বিকৃত হয়ে যায়। এছাড়া এসব পোকা দেহ
থেকে এক ধরনের মধু নিঃসৃত করে যা পাতায় লেগে থাকে। পরে পাতার গায়ে এই নিঃসৃত মধুর
ওপর এক প্রকার ছত্রাক জন্মায়। ফলে গাছের খাদ্য তৈরি প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়। মাকড় ও
থ্রিপস পোকা পাতা, ফুলের বোঁটা, বৃতি ও দলমণ্ডলে ক্ষত করে এবং ক্ষত থেকে
বের হওয়া কোষরস খায়। ফলে পাতার আগা কুঁকড়ে যায় এবং ফুল ঝরে যাওয়ায় ফলধারণ বিঘ্নিত
হয়।
প্রতিকারঃ
ছাতা পোকা ও শুল্ক পোকার কীট দমনের জন্য আক্রমণের প্রথম অবস্থায় আক্রান্ত অংশ কেটে
পুড়িয়ে ফেলতে হবে। এর পর প্রতি লিটার পানিতে এক মিলিলিটার হারে মনোক্রোটোফস বা
ডায়াজিনন গ্রুপের কীটনাশক মিশিয়ে গাছে সেপ্র করতে হবে।
জাব
পোকা বা সাদামাছি দমনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে এক মিলিলিটার হারে ডাইমিথয়েট বা
আধা মিলিলিটার হারে ফসফামিডন বা ডায়াজিনন গ্রুপের কীটনাশক মিশিয়ে ১৫ দিন অন্তর
অন্তর গাছে দুই বার সেপ্র করতে হবে।
মাকড়
দমনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে এক মিলিলিটার হারে কেলথেন বা দুই গ্রাম হারে সালফার
ছত্রাকনাশক মিশিয়ে গাছে সেপ্র করতে হবে।
ফলের দাগ রোগঃ
এটি
একটি ছত্রাকঘটিত রোগ। এ রেগে আক্রান্ত ফলের ওপর ছোট ও অনিয়মিত দাগ পড়ে। দাগগুলোর
চারিদিকে সবুজ হলদে দাগ থাকে। পরবর্তীতে দাগগুলো লম্বা দাগে পরিণত হয় এবং ফলের
খোসার নিচের বীজগুলো বাদামি বর্ণের হয়ে যায়। আক্রান্ত ফলের গুণাবলী নষ্ট হয়ে যায়
এবং ফলের বাজার মূল্য কমে যায়।
প্রতিকারঃ রোগাক্রান্ত
অংশ কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম হারে মেনকোজেব বা ১ গ্রাম হারে কার্বান্ডিজম ছত্রাকনাশক গুলে ১০ দিন অন্তর অন্তর ৩-৪ বার ফলে ও গাছে ভালোভাবে সেপ্র করতে হবে।
প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম হারে মেনকোজেব বা ১ গ্রাম হারে কার্বান্ডিজম ছত্রাকনাশক গুলে ১০ দিন অন্তর অন্তর ৩-৪ বার ফলে ও গাছে ভালোভাবে সেপ্র করতে হবে।
ফল
পচা রোগঃ
ছত্রাকঘটিত
এ রোগটি সাধারণত বর্ষাকালে দেখা যায়। এ রোগের জীবাণু দ্বারা ফুল আক্রান্ত হলে
ফলধারণ বিঘ্নিত হয় এবং কচি ফল ঝরে যায়। ফলের গায়ে, বিশেষ করে বোঁটায় হলদে বা
কালো দাগ দেখে এ রোগের আক্রমণ বোঝা যায়। এরোগের আক্রমণে ফলের খোসা কুঁচকে যায় ও
ফলের ওজন কমে যায়। আক্রান্ত ফল কাঁচা থাকে, আকার ছোট হয় ও ফলের চাকচিক্য
নষ্ট হয়ে যায় এবং শেষে ফল নরম হয়ে পচে যায়।
প্রতিকারঃ এ
রোগের প্রতিকার ফলের দাগ রোগের প্রতিকারের অনুরূপ।
ফল
ফেটে যাওয়াঃ
আনারের
ফল ফেটে যাওয়া একটি মারাত্মক সমস্যা। এটি কোন ছত্রাকজনিত রোগ নয়। এটি সাধারণত
পুষ্টি উপাদানের অভাবজনিত কারণে বা মাটিতে রসের তারতম্যের কারণে হয়ে থাকে। ফলের
বৃদ্ধির সময় শুকনো আবহাওয়ায় মাটিতে রসের অভাব দেখা দিলে ফলের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং
ফলের ত্বক শক্ত হয়ে যায়। এরপর হঠাৎ বৃষ্টি হলে মাটিতে রসের আধিক্য ঘটে, ফলে
ফলের ভেতরের অংশ দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায় এতে ভেতরের চাপ সহ্য করতে না পেরে ফলের
খোসা ফেটে যায়।
প্রতিকারঃ ফলধারণের
পর থেকে ডালিম গাছে ঘন ঘন পানি সেচ দিতে হবে।
মাটিতে বোরনজনিত সার যেমন বোরিক এসিড গাছপ্রতি ৪০ গ্রাম হারে মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া ফলের বৃদ্ধির সময় প্রতি লিটার পানিতে পাঁচ গ্রাম হারে বোরিক এসিড এর মিশ্রণ ১০ দিন অন্তর অন্তর ফলে ও গাছে সেপ্র করতে হবে।
মাটিতে বোরনজনিত সার যেমন বোরিক এসিড গাছপ্রতি ৪০ গ্রাম হারে মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া ফলের বৃদ্ধির সময় প্রতি লিটার পানিতে পাঁচ গ্রাম হারে বোরিক এসিড এর মিশ্রণ ১০ দিন অন্তর অন্তর ফলে ও গাছে সেপ্র করতে হবে।
আনারের
যেসব জাতে ফল ফাটা সমস্যা নেই সেসব জাত চাষাবাদ করতে হবে।
ফল সংগ্রহঃ
কলমের গাছে ৩-৪ বছর থেকেই ফলন শুরু হয়। ফুল আসার পর থেকে ফল
পাকা পর্যন্ত ৬ মাস সময় লাগে। পুষ্ট ফলের খোসার রঙ হলদে-বাদামি হয়ে এলেই ফল পাড়ার
উপযুক্ত হয়। গাছে ফল বেশি দিন রেখে দিলে ফল ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফল ফেটে
যাওয়া জাতের ওপর নির্ভরশীল। যেসব গাছে ফল ফেটে যাওয়ার প্রবণতা থাকে সেসব গাছের ফল
পুষ্ট হওয়ার কিছু আগেই পেড়ে নিতে হয়। তবে অপুষ্ট ফলের স্বাদ ও গুণাগুণ খুব একটা
ভালো হয় না। ডালিমের খোসা বেশ শক্ত এজন্য পাকা ফল অনেক দিন সংরক্ষণ করা যায় এবং
পরিবহনেও নষ্ট হয় না।
ফলনঃ
আনার গাছ প্রথম বছর থেকেই ফল দিতে শুরু করে। তবে শুরুর দিকে ফলন
তেমন একটা আশানুরূপ হয় না। সাধারণত ৩-৪ বছর বয়স থেকে ডালিম গাছ ভালো ফলন দিয়ে
থাকে। প্রথম ফল ধরার সময় গাছপ্রতি ২০-২৫টির বেশি ফল পাওয়া যায় না। বয়স বাড়ার সাথে
সাথে ফলন বাড়তে থাকে। ৪ বছর বয়সের গাছে গড়ে ২০০-৫০০ টি ফল ধরে। একটি আনার গাছ
ত্রিশ বছর পর্যন্ত লাভজনক ফলন দিয়ে থাকে।
আনারের পুষ্টিমান
আনারের বীজ ও খোসা বাদে যে লাল বা গোলাপি
ভক্ষনযোগ্য অংশ থাকে তার ১০০ গ্রামে।
প্রতি ১০০ গ্রামে ডালিমের পুষ্টিমান
|
ভ্যালু
|
জলীয় অংশ
|
৮০.৯ ভাগ
|
শর্করা
|
১৬.৯ গ্রাম
|
প্রোটিন
|
১.৬ গ্রাম
|
ফ্যাট
|
০.১ গ্রাম
|
আঁশ
|
৫.১ গ্রাম
|
খাদ্যশক্তি
|
৭৪ কিলোক্যালোরি
|
থায়ামিন
|
০.০৬ মিলিগ্রাম
|
রিবোফ্লাভিন
|
০.১ মিলিগ্রাম
|
ভিটামিন সি
|
২৬ মিলিগ্রাম
|
ক্যালসিয়াম
|
২১ মিলিগ্রাম
|
ফসফরাস
|
০.৭ মিলিগ্রাম
|
আয়রন
|
০.৩ মিলিগ্রাম
|
ঔষুধি
গুনাগুণঃ
আনার
ফল আয়ুর্বেদিক ও ইউনানী চিকিৎসায় পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আনারে বিউটেলিক এসিড,
আরসোলিক এসিড এবং কিছু আ্যলকালীয় দ্রব্য যেমন- সিডোপেরেটাইরিন, পেপরেটাইরিন,
আইসোপেরেটাইরিন, মিথাইলপেরেটাইরিন প্রভৃতি মূল উপাদান থাকায় ইহা বিভিন্ন রোগ
উপশমে ব্যবহৃত হয়। কবিরাজী মতে ডালিম হচ্ছে হৃদয়ের শ্রেষ্ঠতম হিতকর ফল।
এ ফল
কোষ্ঠ রোগীদের জন্য উপকারী বলে মনে করা হয়। গাছের শিকড়, ছাল ও ফলের খোসা দিয়ে
আমাশয় ও উদরাময় রোগের ওষুধ তৈরি হয়। ইহা ত্রিদোষ বিকারের উপশামক, শুক্রবর্ধক,
দাহ-জ্বর পিপাসানাশক, মেধা ও বলকারক, অরুচিনাশক ও তৃপ্তিদায়ক। ডালিমের ফুল
রক্তস্রাবনাশক।
১.
রক্তপাত বন্ধ করতে আনার ফুল অত্যন্ত কার্যকরী। হঠাৎ দুর্ঘটনায় শরীরের কোনো অংশ
ছিঁড়ে গেলে, থেঁতলে গেলে বা কেঁটে রক্তপাত হলে ডালিম ফুল কচলিয়ে ক্ষতস্থানে
লাগিয়ে চেপে ধরলে রক্তপাত বন্ধ হয়ে যায়। ফুল না পেলে পাতাও ভালো কাজ করে।
২.
হঠাৎ নাক দিয়ে রক্ত পড়া রোগের মহৌষধ আনার ফুলের রস। নাক দিয়ে রক্ত পড়া বা
রক্তঝরা একটি সাধারণ রোগ। বহু মানুষের এরকম হয়। অনেকের বিনা কারণে নাক দিয়ে রক্ত
যায়। শিশুদের মাঝেও এটা লক্ষ্য করা যায়। হঠাৎ করেই এরকম হয়। আঘাত, পলিপ বা কোনো
কারণ ব্যতীত যদি নাক দিয়ে রক্ত পড়ে বা রক্ত যায় ডালিম ফুল কচলিয়ে রস নিয়ে
নাকে শ্বাস নিলে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যায়।
৩.
আমাশয় নিরাময়ে ডালিমের খোসা। যারা আমাশয়ের রোগী, ডালিমের খোসা সিদ্ধ করে সেবন
করলে আমাশয় নিরাময়ে ভলো ফল পাওয় যায়। আমাশয় নিরাময়ে ডালিমের কাঁচা খোসা এবং
শুকনা খোসা দুটোই কার্যকরী। তাই ডালিম খেয়ে খোসা ফেলে না দিয়ে শুকিয়ে ঘরে রেখে
দেয়া ভালো।
৪.
আনার গাছের ছাল গুঁড়ো করে ছড়িয়ে দিলে শরীরের যে কোনো স্থানের বাগি বা উপদংশ
নিরাময়ে ভালো কাজ করে। মহিলাদের প্রদররোগ নিরাময়ে ডালিম ফুল উপকারী। প্রদর একটি
জটিল মেয়েলি রোগ। প্রদর দু’প্রকার। শ্বেতপ্রদর ও রক্তপ্রদর। উভয় প্রকার প্রদরে
৪/৫টি ডালিম ফুল বেটে মধুর সাথে মিশিয়ে কিছুদিন সেবন করলে রোগ সেরে যায়।
৫.
গর্ভপাত নিরাময়ে ডালিমের গাছের পাতা উপকারী। বহু মহিলার গর্ভসঞ্চারের দুই তিন
মাসের মধ্যে গর্ভপাত হয়ে যায়। কোনো কোনো মহিলার একাধিকবার এরকম হয়। ডালিম গাছের
পাতা বেটে মধু ও দধি একসাথে মিশিয়ে সেবন করলে গর্ভপাতের আশংকা দূর হয়।
৬.
আনার গাছের শিকড় ক্রিমিনাশক। ক্রিমির সমস্যা আমাদের জাতীয় সমস্যা। ক্রিমির কারণে
শিশু থেকে বুড়ো পর্যন্ত সবাই নানাবিধ জটিলতায় ভোগে। ডালিম গাছের মূল বা শিকড়
থেকে ছাল নিয়ে চূর্ন করে চুনের পানির সাথে মিশিয়ে সেবন করলে আনায়াসেই ক্রিমিনাশ
হয়। বয়স ভেদে ১-৩ গ্রাম পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।
৭.
শিশুদের পেটের রোগ নিরাময়ে ডালিম গাছের ছাল। শিশুরা বিভিন্ন প্রকার পেটের পীড়ায়
ভোগে। যেসব শিশু পেট বড় হওয়াসহ বিভিন্ন প্রকার পেটের পীড়ায় ভোগে তাদেরকে জন্য
ডালিম গাছের শিকড় থেকে ছাল নিয়ে গুঁড়ো করে মধুর সাথে মিশিয়ে সেবন করতে দিলে
ভালো ফল পাওয়া যায়।
৮.
অনেকের মতে এটাও বলা হয়ে থাকে যে আনার খেলে শরীরে রক্ত বৃদ্ধি পায়।
মূলত,
আনার গাছের- ফল, ফলের খোসা, পাতা থেকে শুরু করে শিকড় পর্যন্ত কোনোটাই ফেলনা নয়।
আগাগোড়া মানুষের উপাকরী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন