সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’স ডে ( Valentine’s Day) যা বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে ‘ভালবাসা
দিবস’ নামে পরিচিত।
ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর কোমল দুরন্ত মানবিক অনুভূতি।
ভালোবাসা নিয়ে ছড়িয়ে আছে কত কত পৌরাণিক উপাখ্যান। সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি
সর্বত্রই পাওয়া যায় ভালোবাসার সন্ধান। ভালোবাসার জন্য মানুষ মৃত্যুকে তুচ্ছ করে।
রাজা সিংহাসন ত্যাগ করে হাসিমুখে প্রেমিকার হাত ধরে।
২৬৯
সালে ইতালির রোম নগরীতে সেন্ট ভ্যালেইটাইন’স নামে একজন
খৃষ্টান পাদ্রী ও চিকিৎসক ছিলেন। ধর্ম প্রচার-অভিযোগে তৎকালীন রোমান সম্রাট
দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস তাঁকে বন্দী করেন। কারণ তখন রোমান সাম্রাজ্যে খৃস্টান ধর্ম
প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। বন্দী অবস্থায় তিনি জনৈক কারারক্ষীর দৃষ্টহীন মেয়েকে
চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। এতে সেন্ট ভ্যালেইটাইনের জনপ্রিয়তার প্রতি
ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সেই দিন ১৪ই ফেব্রুয়ারি ছিল। অতঃপর ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউও ১ম জুলিয়াস ভ্যালেইটাইন’স
স্মরণে ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন’ দিবস ঘোষণা করেন।
কিংবদন্তী আছে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন তৃতীয় শতাব্দীতে রোমে বাস
করতেন। তখনকার রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস- ২ বিশ্বাস করতেন যে বিবাহিত পুরুষেরা ভাল
যোদ্ধা হয় না। তিনি ফরমান জারী করেন যে যুবকেরা বিয়ে করতে পারবে না। সেইন্ট
ভ্যালেন্টাইন এই অন্যায় মেনে নিতে পারেন নি। তিনি সম্রাটের ফরমান অগ্রাহ্য করে
গোপনে যুবক যুবতীর বিয়ে দিতে থাকেন। সম্রাট তা জানতে পেরে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনকে
মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেন।
পাশ্চাত্যের ক্ষেত্রে জন্মদিনের উৎসব, ধর্মোৎসব সবক্ষেত্রেই ভোগের বিষয়টি মুখ্য।তাই গির্জা অভ্যন্তরেও
মদ্যপানে তারা কসুর করে না। খৃস্টীয় এই ভ্যালেন্টাইন দিবসের চেতনা বিনষ্ট হওয়ায়
১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার কর্তৃক ভ্যালেইটাইন উৎসব নিষিদ্ধ হয়। ইংল্যান্ডে
ক্ষমতাসীন উৎসব পিউরিটানরাও একসময় প্রশাসনিকভাবে এ দিবস উদযাপন করা থেকে বিরত
থাকার জন্যে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। এছাড়া অস্ট্রিয়া ,হাঙ্গেরি
ও জার্মানিতে বিভিন্ন সময়ে এ দিবস প্রত্যাখ্যাত হয়।
বর্তমানকালে, পাশ্চাত্যে এ উৎসব মহাসমারোহে
উদযাপন করা হয়। যুক্তরাজ্যে মোট জনসংখ্যার অর্ধেক প্রায় ১০০ কোটি পাউন্ড ব্যয়
করে এই ভালোবাসা দিবসের জন্য কার্ড, ফুল, চকোলেট, অন্যান্য উপহারসামগ্রী ও শুভেচ্ছা
কার্ড ক্রয় করতে, এবং আনুমানিক প্রায় ২.৫ কোটি শুভেচ্ছা
কার্ড আদান-প্রদান করা হয় ।
সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের গল্প কোনটা সত্যি তা নিয়ে হয়ত দ্বিমত আছে
তবে মধ্যযুগ থেকেই সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন ইংল্যান্ডে এবং ফ্রান্সে প্রবাদ পুরুষ।
তিনি ভালবাসা, প্রেম, বীরত্ব এবং
সহমর্মিতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন সেই সময় থেকেই।
অন্য একদলের বিশ্বাস যে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপনের জন্য খৃস্টানেরা মধ্য ফেব্রুয়ারীতে “ ভ্যালেন্টাইন” ভোজ এর আয়োজন করতেন।
অন্য একদলের বিশ্বাস যে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপনের জন্য খৃস্টানেরা মধ্য ফেব্রুয়ারীতে “ ভ্যালেন্টাইন” ভোজ এর আয়োজন করতেন।
খৃষ্টানজগতে পাদ্রী-সাধু সন্তানদের স্মরণ ও কর্মের জন্য এ ধরনের
অনেক দিবস রয়েছে। যেমন: ২৩ এপ্রিল – সেন্ট জজ ডে, ১১ নভেম্বর – সেন্ট মার্টিন ডে, ২৪ আগস্ট – সেন্ট বার্থোলোমিজম ডে, ১লা নভেম্বর – আল সেইন্টম ডে, ৩০ নভেম্বর – সেন্ট এন্ড্রু ডে, ১৭ মার্চ – সেন্ট পযাট্রিক ডে।
রোমান ঐতিহ্য অনুসারে মধ্য ফেব্রুয়ারীতে পালিত হত পৌত্তলিক
রোমানদের উৎসব “ লুপারসেলিয়ায়” (Lupercalia)। ফেব্রুয়ারী মাসের ১৫ তারিখ বা মধ্য
ফেব্রুয়ারীতে পালিত হত এ উৎসব। নতুন জন্মের এ উৎসব নিবেদিত হত রোমান কৃষির দেবতা “ফোনাস”র
উদ্দেশ্যে । রোমান পূরোহিতদের বলা হত “লুপারসি”।
কথিত আছে রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রেমুস এবং রোমুলাস কে পাহাড়ের গুহাতে
লালনপালন করে নেকড়ে বাঘ “লুপা”সেই পবিত্র
গুহাতে লুপারসিরা মধ্য ফেব্রুয়ারীতে সমবেত হতেন।সেখানে নতুন জন্মের আশীর্বাদ
চেয়ে দেবতার উদ্দেশ্যে পাঠা বলি দেওয়া হত আর আত্মশুদ্ধির প্রতীক হিসেবে বলি
দেওয়া হত কুকুরের। পাঠার সে চামড়া রক্তে ভিজিয়ে তা দিয়ে যুবতীদের এবং শস্য
ক্ষেত্রকে স্পর্শ করা হত। তাদের বিশ্বাস ছিল যে এই স্পর্শ ভূমি এবং যুবতীদেরকে আরো
ফলদায়ীনি করবে। বিকেলের দিকে কুমারী যুবতিদের নাম লিখে রাখা হত এক বড় পাত্রে
যেখান থেকে অবিবাহিত পুরুষেরা তাদের সঙ্গী বেছে নিত। লুপারসেলিয়া টিকে ছিল খৃস্ট
ধর্মের গোড়ার দিনগুলোতে । লুপারসেলিয়া উৎসবকে খৃস্টান ধর্মের সাথে অসামঞ্জস্য
পুর্ন বিবেচনা করে অবশেষে ৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু পোপ
গেলাসিয়াস ১৪ ই ফেব্রুয়ারীকে ‘ সেইন্ট ভ্যালন্টাইন দিবস” হিসেবে ঘোষনা করেন।
সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুর আগে প্রতি বছর রোমানরা ১৪
ফেব্রুয়ারি পালন করতো ‘জুনো’ উৎসব। রোমান পুরাণের বিয়ে ও সন্তান দেয়ার দেবী জুনোর নামানুসারে এ
উৎসবের নামকরণ। এই দিন অবিবাহিত তরুণরা কাগজে নাম লেখা লটারির মাধ্যমে তার নাচের
পার্টনারকে বেছে নিত। ৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে রোমানরা যখন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীতে
পরিণত হয় তখন ‘জুনো’ উৎসব আর সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগের দিনটিকে একই সূত্রে গেঁথে
১৪ ফেব্রুয়ারি
এ দিনকে ভালবাসার দিন হিসেবে জনপ্রিয়তা পেতে সময় লেগেছে আরো অনেক
বছর। মধ্যযুগে ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সে বিশ্বাস ছিল যে ১৪ ই ফেব্রুয়ারী থেকে সে
দেশে পাখীদের প্রজনন শুরু। সে বিশ্বাস সাহায্য করেছে ১৪ই ফেব্রুয়ারীকে ভালবাসার
দিন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে ।
আজ থেকে শতবর্ষ আগে ব্রিটেনে ছোট শিশুরা দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি গান
গেয়ে দিনটি উদযাপন করত। ওয়েলসে কাঠের তৈরি চামচের ওপর হৃদপিন্ড, তালা, শেকল প্রভৃতির নকশা খোদাই করে এ দিনে
উপহার দেয়া হত। এর মানে ছিল ‘ইউ আনলক মাই
হার্ট’। কোথাও আবার এ দিনে তরুণীরা রোদে একটি বাটিতে
পরিষ্কার পানি রেখে তার ওপর চেয়ে থাকত। ধারণা করা হত, যার ছবি ওই পানিতে ভেসে উঠবে সে-ই হবে তার কাঙ্তি ভ্যালেন্টাইন। কোথাও
ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে তরুণ-তরুণীরা তাদের জামার হাতায় কাঙ্তি ভালবাসার মানুষটির
নাম লিখে সপ্তাহজুড়ে ঘুরে বেড়াত। তারা ধরেই নিতো, এর
ফলে সহজেই কাছে পাবে তার ভালোবাসার মানুষটিকে।
কোনো কোনো দেশে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে অবিবাহিত ছেলেরা মেয়েদের নতুন পোশাক উপহার হিসেবে পাঠাত এবং মেয়েটি ওই পোশাক গ্রহণ করলে ধরে নেয়া হতো, মেয়েটি তাকে বিয়ে করতে রাজী আছে। ওইসব দেশে কিছু লোকদের ভ্যালেন্টাইনের ওপর বিশ্বাস আরো একধাপ এগিয়ে। তারা বিশ্বাস করত, ১৪ ফেব্রুয়ারিতে যদি কোন মেয়ে তার মাথার ওপর একটি ফিতা উড়ে যেতে দেখে তাহলে তার বিয়ে হবে নাবিকের সাথে, যদি সে একটি চড়ুই পাখি দেখে তবে তার বিয়ে হবে একজন দরিদ্র লোকের সাথে, কিন্তু সে হবে খুবই সুখী। আর যদি সে সোনালী রঙের মাছ দেখে তবে তার বিয়ে হবে একজন প্রভাবশালী ধনাঢ্য লোকের সাথে।
১৮৭৬ সালের ভ্যালেন্টাইন ডে তে আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল টেলিফোন
আবিস্কারের প্যাটেন্ট এর জন্য আবেদন জানান।
ভ্যালেন্টাইন ডের উপহার হিসেবে প্রখ্যাত চকোলেট নির্মাতা ক্যাডবেরী, প্রথম হৃদয় আকৃতি’র বাক্সে চকোলেট উপহারের প্রচলন করে।
কোন কোন দেশে যুবকরা পানি প্রার্থনা করে যুবতীদের কাপড় চোপড়ের উপহার বাক্স পাঠিয়ে থাকেন। যুবতী বাক্স গ্রহন করলে ধরে নেওয়া হয় যে তিনি প্রেরনকারী যুবকের সাথে বিয়ে তে রাজী আছেন।
কোরিয়া তে যুবতীরা এ দিনে কোন উপহার না পেলে শোকের চিহ্ন হিসেবে রেস্তোরাতে গিয়ে কাল স্যুপ খেয়ে থাকে।
ভ্যালেন্টাইন ডে’র প্রতীক- এ দিনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়
হল ভালোবাসা। বেশ কিছু প্রতীক ব্যবহার করা হয় ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষেঃ
হার্ট – জোড়া গোলাপী হার্ট হল আবেগ এবং ভালবাসার প্রতীক।
লাল গোলাপ- ভালবাসা এবং গভীর অনূভূতির প্রতীক হল লাল গোলাপ। ভ্যালেন্টাইন ডে’র প্রতীক হিসেবে লাল গোলাপ ফুল সবচে বেশী জনপ্রিয়।
কিউপিড বা বামুন- রোমান পৌরানিক উপাখ্যানমতে কিউপিড ছিলেন প্রেমের
দেবতা ভেনাসের পূত্র। কিউপিড হলেন খর্বাকৃতির বালক, হাতে তার তীর
ধনুক, পিঠে তুন এবং এক জোড়া পাখা লাগানো। তিনি তার তীর
ছূড়ে যুবক যুবতীর মনে প্রেমের সঞ্চার করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন