১-১ শুরুর কথা
কামসূত্রের
উৎপত্তি ও বিকাশ আমাদের দেশের
প্রাচীন শাস্ত পাঠে জানা যায় যে, খ্রীষ্টের জন্মের শত শত বৎসর আগেও ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিরাট উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত ছিল। সেই প্রাচীন দিনে বিশ্বের বিভিন্ন জাতির আত্নিক উন্নতি, সামাজিক ও
বৈষয়িক ধ্যান জ্ঞান সব কিছুর সার্থক সাধনার জন্যেই
ভারতের শাস্ত্রের দিকে দৃষ্টিপাত
করতেন। সে ছিল একটা স্বর্ণ যুগ- একটি অতুলনীয় যুগ। একদিকে বেদ, উপনিষদ, প্রভৃতি ধর্ম
গ্রন্থ, অন্য দিকে বিভিন্ন জ্ঞান- বিজ্ঞানের বিষয়
নিয়ে সার্থক সব গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। মানুষ যাতে
ধর্মীয় ভাবে জীবন যাপন করতে পারেন তাই তাঁদের জীবনে চারটি
সাধনের
স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়।
তা হলো-ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। মানুষের সমস্ত কাজের পেছনে চাই অর্থ। চারটি সাধনের স্পষ্ট সাহচর্য
দেখা যেত। মানুষের জীবন
যাত্রাকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্যে বিভিন্ন অংশে ভাগ করা হতো-তা হলো ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ ও
সন্ন্যাস। তাই দেখা যাচ্ছে সাধনার মধ্যে ধর্মের
পর অর্থ, তারপরই কাম-ছাত্র জীবনে বা ব্রহ্মচর্যের
পরই গার্হস্থ্য বা দাম্পত্য জীবন স্থান পেয়েছে। কামশাস্ত্র
আলোচনার স্তর পুরাণ মতে ব্রহ্ম বা পূর্ণব্রহ্ম সারা
বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি বিভিন্ন
জ্ঞান-বিজ্ঞান নানা ঋষি বা মুনির মাধ্যমে প্রকাশ ও প্রচার করে থাকেন। তাই ঋষি বা
মুনিদের প্রাচীন ভারতে বিরাট একটা সম্মানের আসন দেওয়া হতো।
এই মত অনুযায়ী নর-নারীদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে সমস্ত বিধান
রচনা করেন মনু-যাঁকে ভারতীয় আইন শাস্ত্রের পিতা বলা
হয়ে থাকে। তারপর বৃহস্পতি রচনা করেন অর্থশাস্ত্র। মহাদেবের অনুচর নন্দী হরপার্বতীর কথোপকথন শুনে রচনা করেন রতিশাস্ত্র। এ গ্রন্থের নাম
মনুসংহিতা। মহর্ষি উদ্দালিকের পুত্র শ্বেতকেতু তা
থেকে একটি সুন্দর প্রন্থ রচনা করেন। তাপর বাভ্রব্য
নামে উত্তর ভারতের একজন ঋষি তাকে সুন্দরভাবে ১৫০টি পরিচ্ছেদে ভাগ করে তা বিশ্লেষণ করেন।
বাভ্রব্যের বিভিন্ন বিভাগ রচনা বাভ্রব্য তাঁর
গ্রন্থে কামশাস্ত্রকে মোট সাতটি ভাগ করে রচনা করেছিলেনঃ
১। কামসূত্রের সাধারণ কথ।
২। নর-নারীর যৌনমিলন ও তৃপ্তি।
৩। যুবতী নারীদের কাম জাগরণ।
৪। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দৈহিক আনন্দ।
৫। পরস্ত্রীর সঙ্গে সম্বন্ধ ও পরস্ত্রীর সঙ্গে কাম।
৬। বারাঙ্গনামের কাম বৃত্তান।
৭। শারীরিক সৌন্দর্য ও কামশক্তি বৃদ্ধির উপায়।
বাভ্রব্য এইভাবে
তাঁর গ্রন্থে কামশক্তিকে একটা সুনির্দিষ্ট পথে চালিত করেন ও তার একটি বিভাগ করে দেন। বাভ্রব্যের এই
পুস্তক সারা বিশ্বের পণ্ডিত ও লেখক সমাজে বিশেষ প্রশংসা লাভ করে। বাভ্রব্যের পর
কামশাস্ত্র বাভ্রব্যের গ্রন্থটির বিভিন্ন অধ্যায়কে
আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে ভারতের ঋষিরা বিভিন্ন
গ্রন্থ রচনা করেন।
১। চারায়ণ
লেখেন-সাধারণ কাম বিচার।
২। সুবর্ণাভ নামক লেখক-যৌন কাম বিচার।
৩। ঘোটকমুখ লেখেন- যুবতী নারীর বিচার।
৪। গোমার্দীয় লেখেন-স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধের বিচার।
৫। গণিকাপুত্র লেখন-পরস্ত্রীগমন বিচার।
৬। দত্তক লেখেন-পতিতাদের কাম বিচার।
৭। কুচুমার লেখেন-দেহ সৌন্দর্য ও যৌনিক বৃদ্ধির উপায় বিচার।
কিন্তু এই সব গ্রন্থ প্রত্যেকটি উৎকৃষ্ট হলেও, পরস্পর পরস্পরের
থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল বলে লোকের মনকে তা আকর্ষণ করতে
পারেনি। তাই ঋষি বাৎস্যায়ন এই শাস্ত্র একত্রিত করে তাঁর
‘কামসূত্রম’
নামক
গ্রন্থটি রচনা করলেন। এই গ্রন্থে তিনি বিভিন্ন ভাগে সব
রকম কাম উদ্রেকের তত্ত্ববিষয়ে সুন্দর ভাষায় ও
স্পষ্ট করে আলোচনা করেছেন। কামশাস্ত্রের
ধারা বাৎস্যায়নের কামসূত্রের বাভ্রব্যের মতই সাতটি
অংশ। এই গ্রন্থ তিনি ছত্রিশটি অধ্যায়ে ভাগ
করেন। মোট ৬৪টি বিষয়ে তিনি এ গ্রন্থের মধ্যে বিশদভাবে
আলোচনা করেন। এই গ্রন্থের আলোচনা তিনি সম্পূর্ণ করেন
মো ১২৫০টি শ্লোকের মাধ্যমে। কিন্তু তাঁর
শ্লোকগুলি অপূর্ব। প্রতিটি শ্লোকের বক্তব্য এত সুন্দর যে তার ব্যাখ্যা করলে প্রচুর লেখা যায়। কিন্তু আমরা অতি সংক্ষেপে অথচ
সুস্পষ্ট ভাবে কি করে তা ব্যাখ্যা করা যায় সেই চেষ্টা
করেছি। বাৎস্যায়ন তাঁর
বইতে তৎকালীন সমাজের সুন্দর স্পষ্ট ছবি এঁকে গেছেঁন। তিনি যে কালে
গ্রন্থ রচনা করেন, তখন আমাদের দেশ বাইরের মুসলমান দ্বারা আক্রান- হয়নি। তাই এ দেশে স্ত্রী-স্বাধীনতা বিদ্যমান ছিল। স্ত্রী-পুরুষ
স্বাধীনভাবে মেলামেশা করত-এমন কি নানা ঠাট্টা তামাশা বা কৌশলে শ্লোকের মাধ্যমে যৌনতার ইংগিত দেওয়াকে তারা ঘৃনা মনে করত না।
সত্যিকারের রুচি জ্ঞান ছিল তাদের মনে।
কামশস্ত্রে সমাজ ব্যবস্থা বাৎস্যায়নের
কামশাস্ত্রে সমাজ ব্যবস্থার বিষয়ে সুন্দর বর্ণনা আছে। পুরুষেরা
পুঁথিপাঠ,গ্রন্থরচনা, দেশ-বিদেশে গমন নানা প্রকার ব্যবসা বাণিজ্য করত। আর্থিক, ধর্মবিষয়ক ও
সম্ভোগাদি বিষয়ে তাঁরা যথেষ্ট উন্নতি করেছিলেন। নারীরা, তেমনি
স্বাধীনভাবে নানা শিল্পকলা ও সঙ্গীতকলায় পারদর্শিনী হয়ে সংসারের নানাবিধ
সুখ সম্পদ উপভোগ করত। এইভাবে সুন্দর
জীবন তাঁরা উপভোগ করতেন-জীবনকে প্রকৃত শিল্পকলার মত ভাবে তাঁরা গ্রহণ
করতেন। বিলাস ব্যসন সে আমলে দেশের
রাজকর্মচারী ও ধনী, অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা নৃত্যগীত ও বিলাস ব্যসনে বেশ সময়
কাটাতেন-এইভাবে তাঁরা জীবনকে ভোগ করতেন। নৃত্যগীত নিপুনা
ও বিলাস ব্যসন সংযুক্ত নানা কৃষ্টিসম্পন্ন গণিকা ছিল সে আমলে। তারা
অধিকাংশই ছিল সুন্দরী নর্তকী ও গায়িকা। এদের সংস্পর্শে এসে তাঁরা জীবনটিকে ভোগ করতেন ঠিক ইন্দ্রপুরীর মত। জীবনকে ভোগ করতেন ধর্ম,
অর্থ,
কামের
প্রতীক রূপে। সে এমন একদিন ছিল, যখন পুরুষ ও
রমণীর উপভোগে কোন বাধা ছিল না।
কামতৃপ্তি ছিল বিরাট বড়
বস্থ, তাতে
কোন সামাজিক বাধা মাথা তুলতে পারত না। কামশাস্ত্রে
যথেষ্ট সঙ্গম কামশাস্ত্রে যথেষ্ট সঙ্গম বা ইচ্ছামত
নর-নারীর তৃপ্তিকে উচ্চ আসন দেওয়া হয়েছে। তাই তৎকালীন পরিপ্রেক্ষিতেই পরস্ত্রীগমন পতিতাগমন প্রভৃতি বিষয়ে
আলোচনা করা হয়েছে। নারী যেমন
খুশিভাবে পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা কত, তেমন ইচ্ছামত নিজের মনোমত পুরুষ উপভোগ করতেও পারত। পুরুষ অর্থ ও
উচ্চপদের অধিকারী হলে ইচ্ছানুযায়ী নারীকে যথেষ্ট ভোগ করতে পারত- কিন্তু বলপ্রয়োগ ছিল অশাস্ত্রীয়।
সে আমলে দরিদ্রা
নারী যদি গুণবতী বা রূপবতী হতেন তা হলে রাজ্যের প্রধান পুরুষকেও ধন্য
করতে পারতেন। যদি কোন পুরুষ বংশদোষে হীনপদস্থ বা
অর্থাবাবে পথের কাঙালও হতেন, তা হলেও শিল্প বা কলার
প্রভাবে বা বাণিজ্যের অর্থাগমে রাজ্যের রাজকন্যাকেও শয্যাসঙ্গিনী
করতে পারতেন। সেকালে ইন্দ্রিয়-সেবা, উল্লসিত জীবন ও
যৌবন চরিতার্থতা ছিল মানুষের কাম্য পদার্থ। শুধু মাত্র মোক্ষ বা মুক্তির জন্যেই মানুষ পাগল ছিল না। ধর্ম,
অর্থ,
কাম
এই তিন বস্থর জন্যেও লালায়িত ছিল। আমরা সমাজের এই সব অনেক দৃষ্টান- অন্যান্য সংস্কৃত গ্রন্থেও দেখতে
পাই।
বাৎস্যায়নের দেশ
ও কাল বাৎস্যায়নের কামসূত্র পড়লে বোঝা যায়, ঐরূপ কাম বিলাস
সম্পন্ন পুরুষ ও নারীদের যুগে
তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল। কোথায় এবং কোন
দেশে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন তার ঐতিহাসিক বৃত্তান- বিশেষ পাওয়া যায় না। তবে মনে হয়,
তিনি
গুপ্ত সম্রাটদের সময়েই আবির্ভূত হয়েছিলেন। এই গুপ্ত
সম্রাটদের সময়েই মহাকবি কালিদাস, জ্যোতির্বিদ বরাহমিহির ইত্যাদি মনীষা সম্পন্ন ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাৎস্যায়নের
সাহিত্যের মত তাঁদের সাহিত্যেও অনেক অধুনা সমাজ বিরুদ্ধ ও
তথাকথিত
বর্তমান অশ্লীল আখ্যা বিশিষ্ট কবিতাও লেখা দেখতে পাওয়া যায়। নাট্য লেখক শূদ্রক রাজাও ঐ সময়ে তাঁর মৃচ্ছকটিক নামে সংস্কৃত নাটক
লেখেন। তবে অনেকে বলেন বাৎস্যায়ন খ্রীষ্ট পূর্ব যুগে
জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কেউ কেউ বলেন
খ্রীষ্ট জন্মের পরবর্তী যুগে তিনি জন্মগ্রহণ করেন দাক্ষিণাত্য দেশে। এ বিষয়ে অনেক মতানৈক্য আছে। তবে আমরা এ কথা
অনেকটা বিশ্বাস করি যে মহর্ষি বাৎস্যায়ন গুপ্ত রাজাদিগের সময়েই জন্মগ্রহণ
করেছিলেণ।
বহু দেশ-বিদেশ
ঘুরে যৌনক্রিয়ার বিভিন্ন প্রচলন দেখে জ্ঞান লাভ
করে কামসূত্র নামে এই পুস্তকটি রচনা করেন। তাঁর পুস্তক
পড়লে বুঝতে পারা যায় যে, তিনি যখন জীবন যাপন করেছিলেন, সেই সময় ভারতের অধিকাংশ লোক গীত বাদ্য ও নানা কামশাস্ত্রে ব্যুৎপন্ন ছিলেন। কামসূত্রকালে সামাজিক জীবন কামসূত্র যে
কালে রচিত হয়, সে আমলে লেখাপড়া সাধারণ লোকের মধ্যে খুব বেশি পরিমাণে চালু ছিল। স্ত্রী-স্বাধীনতা,
স্ত্রীলোকদের
আদর যত্ন করা সমাজে বেশ প্রচলিত ছিল। কামশাস্ত্র পাঠ
করলে বোঝা যায় তখনকার সমাজের ব্যবস্থা মদ্যপায় নিজেদের একত্র বিহার ও
উল্লসিত আচরণ উদ্যান যাত্রা অর্থাৎ বহু প্রস্ফুটিত ও সুগন্ধি পুষ্পদল শোভিত উদ্যান বীথিকায় নর-নারীর একত্রে ভ্রমণ, লেখাপড়া,
শিল্প কার্য, বাণিজ্য ইত্যাদি যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেছিল। তৎকালীন নানা
সাহিত্যে (যেমন প্রাচীন নাট্য লেখক কালিদাস প্রভৃতির গ্রন্থে) সেই সমাজের জীবন ধারার অনেক ইতিহাস পড়তে পারা যায়। যা বাৎস্যায়ন লিখে গেছেন তার সঙ্গে এর অনেকটা মিল পাওয়া যায়।
অশ্লীল কথাটায় বহু ব্যাপকতা আজকাল ঘটেছে, কিন্তু ঋষি
বাৎস্যায়নের সময়ে এই কথাটার এত
প্রচলন হয়নি। রসপূর্ণ বাক্য সে আমলে রাজদরবার থেকে সুরু করে সাধারণ মানুষ সকলের কাছেই ছিল আদরণীয়। অবশ্য বাক্য
নগ্ন হতো না- কিন্তু এমনভাবে তা বলা হতো যে তার অর্থ দুভাবে ব্যবহার করা যায়। সে আমলে শালীনতা বোধ ছিল ঠিকই- কিন্তু রসবোধ ছিল
এবং যৌনতা রস বলে গণ্য হতো।
১-২ ত্রিবর্গের প্রতিপত্তি
মানবজীবনের
সর্বাপেক্ষা অপরিহার্য প্রাচীনযুগের
ইতিহাস পড়লে দেখা যায় তখন মানুষ সাধারণতঃ একশত বৎসর বাঁচতেন। প্রথম ষোল বছর বাল্য ও শৈশবকাল বিদ্যার্জনে ব্যয়িত হতো। তারপর আরম্ভ হতো সংসার জীবন। সেটা চলত পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত। তারপর আসত বানপ্রস্থ-শেষ জীবনে অর্থাৎ ষাটের ওপরে হতো সন্ন্যাস। তখন ভগবানের ধ্যান্-ধারণা করতে করতে শেষ জীবনটুকু কাটাতেন তাঁরা। বাল্য ও কৈশোরে বাল্য ও কৈশোরে
ছেলেরা প্রথম অভিভাবদের অধীন থেকে বিদ্যাশিক্ষা করত। তারপর তারা যেত
গুরুগৃহে। গুরুগৃহে থেকে তারা অঙ্কন বিদ্যা, গণিত শাস্ত্র,
শিল্পকলা,
সাহিত্য,
ব্যাকরণ,
ন্যায়,
বাণিজ্য
প্রভৃতিতে জ্ঞানলাভ করত। আর ষোল বছর বয়েস
পার হয়ে গেলে গুরুগৃহের পাঠ শেষ করে ফিরত। তখন কেউ বা
বিবাহ করত কেউ বা করত না।
যৌবনে গুরুগৃহে যে
বিদ্যা অর্জন করত তার অনুশীলন করে তারপর তারা নানা শিল্প, বাণিজ্য,
কাব্য,
সাহিত্য,
ব্যবসায়
ইত্যাদি নানাভাবে অর্থ উপার্জনের চেষ্ট করত। সঙ্গে সঙ্গে যৌবন আগমনে তাদের মধ্যে কামবৃত্তি স্ফুরিত হওয়ায় তারা হয় বিবাহের পর স্ত্রীসঙ্গ করত। আর তা না হলে সুন্দরী কলাবিদ্যানিপুণ্য
নারীদের সঙ্গ লাভ করত। তাছাড়া নানা
প্রকার জীবন আনন্দকর উৎসবে যোগদান করে সঙ্গীত, নৃত্য, বাদ্য ইত্যাদিতে পারদর্শিতা লাভ করে জীবনটাকে পরম সুখে অতিবাহিত করার
চেষ্টা করত। তখনকার দিনে বহু নারীকে বিবাহ করা এবং
বহু নারীকে একসঙ্গে সম্ভোগ করা অসামাজিক ও
নিন্দনীয় বলে পরিগণিত হতো না। সেটা ছিল
সামাজিক রীতি। এমন কি কোন ভদ্রসন্তান বা অভিজাত বংশের
লোক যদি পতিতা সম্ভোগ করত, তখনকার দিনে তা পাপ বলে
লোকে মনে করত না। তাদের
দুশ্চরিত্র বা অপবাদ দেওয়া হতো না।
বারনারী বা পতিতারা শিল্পবিদ্যা, সঙ্গীতবিদ্যা,
বাদ্যযন্ত্র
প্রভৃতিতে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করত। শূদ্রক রাজার রচিত ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে সে আমলের
এক অপূর্ব চিত্র পাওয়া যায়। এটি কবি
কালিদাসের বা বাৎস্যায়নের সমসাময়িক কালেই রচিত। এই নাটকে দেখা
যায় চারুদত্ত নামে একজন সম্ভ্রান্ত ও উচ্চ শিক্ষিত ব্যাক্তি বসন্ত সেনা নামে এক
বারাঙ্গনার জন্যে শূলে মৃত্যু পর্যন্ত বরণ করতে গিয়েছিলেন। তখনকার দিনে কি যুবক, কি যুবতী সকলেই যৌবন মদে মত্ত হয়ে
পরস্পর উল্লাস, কাম ও যৌন আনন্দ
ইত্যাদি সম্ভোগ করতেন। কামশাস্ত্র ও
ধর্ম যুবক বা যুবতীরা সংসার ধর্ম পালন করতে বা যৌবন
মদে মত্ত হয়ে যে হিন্দু শাস্ত্রের
বিধিনিষেধগুলি অবজ্ঞা করতেন তা কখনো নয়। পুরুষেরা দেখতেন,
নারীর
সঙ্গে পূর্ণ বিলাস, পূর্ণ কামচর্চা করলে তাতে কোন ধর্মশাস্ত্র ব্যবস্থা
লঙ্ঘন করা হয় না। বরং যে কোন নায়িকা অধিকাংশ স্থানে ধর্মকার্যে বা
সৎপথে নায়ককে চলতে প্ররোচিত করত।
তখনকার দিনে ব্রাহ্মণদিগের কর্তব্য ছিল- ইষ্যাধ্যয়ন
দানামিং তপঃ শান্তিং ধৃতিঃ ক্ষমা। অলোভ ইতি
অষ্টানি ব্রাহ্মণানাৎ! -মনুসংহিতা অর্থাৎ
ব্রাহ্মণদের কর্তব্য ছিল যজ্ঞ, পড়াশুনা, দান, তপস্যা, ক্ষমা, সহ্যগুণ বা ধৃতি
প্রভৃতি। ক্ষত্রিয়দের কর্তব্য ছিল- প্রজাদিগের রক্ষা,
যুদ্ধ
বিগ্রহ, যজ্ঞকার্যের উদ্যোগ প্রভৃতি। বৈশ্যদের কর্তব্য ছিল- বাণিজ্য, অর্থ উপার্জন।
আর শূদ্রদের কর্তব্য ছিল অন্য জাতিদের
সেবা। এই সব কাজে নারী পুরষদের উৎসাহ দিত এবং
কামচর্চা করতে করতে তাঁরা প্রিয় বংশবদ পুরুষকেও
সৎ উদ্দীপনায় প্ররোচিত করত।
নারীর ধর্ম ছিল স্বামী- স্বামীর ধর্মই নারীর ধর্ম বলে গণ্য হতো। তাই স্ত্রীর নাম ছিল সহধর্মিণী। অর্থ ও কাম বাৎস্যায়ন বলেন যতো কামে উন্মত্ত হবে ততো অর্থ উপার্জন করবার
প্রবৃত্তি ও কৌশল সৃষ্টি করতে পারবে- তার অর্থ
উপার্জন ততো বাড়বে। তার কেবলই ইচ্ছা
হবে কিসে বেশি অর্থ উপার্জন করে সে স্ত্রী পরিনীতা বা অভীপ্সীতা বা
প্রতিজ্ঞাবদ্ধ নারীকে উজ্জ্বল মণিমাণিক্যাদি কচিত অলংকার দিয়ে তৃপ্ত করতে পারবে। তার সঙ্গে
প্রেমানন্দ ততো বৃদ্ধি পাবে। নায়িকা এতে
তৃপ্ত হবে, তাই সে পুরুষকে সুখপূর্ণ আলিঙ্গন, চুম্বন, সুরত ইত্যাদি দ্বারা তার জীবনকে স্বর্গতুল্য করে তুলবে। জীবন হবে সুখ পূর্ণ- জীবন হবে প্রকৃতই আনন্দময় ও তৃপ্তিকর। এইভাবে বাৎস্যায়নের মত- কাম এবং কাম পরিতৃপ্তিই মানুষকে ধর্ম ও অর্থ উপার্জনের পথে নিয়ে যায়। কামই মানুষকে
সত্য, সুন্দর
ও ন্যায়ের পথে এগিয়ে যাবার ক্ষমতা দেয়। কামই জীবনের
পথকে প্রকৃতই সুগম্য ও কুসুমে আত্তীর্ণ করে তোলে।
১-৩ কলাবিদ্যা শিক্ষা
কামের চৌষট্টি কলা বাৎস্যায়নের মতে কামের পথে প্রকৃতই অগ্রসর হতে হলে নারী বা পুরুষ
উভয়ের কতকগুলি কলাবিদ্যা শিক্ষা করা উচিত। কলাবিদ্যা একটি নয়-একাধিক। মোট ৬৪টি কলা
বাৎস্যায়ন দেখিয়ে গেছেন। এই সব কলায় একজন লোক হয়ত শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে না-তবে কয়েকটি কলায় সে ব্যুৎপত্তি লাভ করতে পারে। আর কলা ছাড়া জীবন ও কাম কিছুই মধুময় হতে পারে না। নারী ও কলা নারী যে শুধু
সুন্দরী হলেই পুরুষের মন জয় করতে পারে বা তাকে আকর্ষণ করতে পারে, একথা ঠিক নয়। এমন অনেক সময়
দেখা যায় যে নারীর যথেষ্ট গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল না হলেও বা যথেষ্ট সুগঠন না
থাকলেও যদি তার কণ্ঠস্বর মিষ্ট হয়, ব্যবহার খুব সন্তোষজনক হয়, নানাপ্রকার কলা বিদ্যা তার আয়ত্তে থাকে,
তা
হলেও সে জীবনে উন্নতি করতে পারে। অনেক গুনগ্রাহী, বিদগ্ধ পুরুষ হয়ত সেই নারীকে পাবার জন্যে আকুল
হতে পারে। তাই বাৎস্যায়নের চৌষট্টি কলা বিষয়ে
জ্ঞান লাভ করা নারীদেরও অবশ্য উচিত।
চৌষট্টি কলার
প্রয়োজনীয়তা নিুলিখিত কলাগুলি চৌষট্টি কলার মধ্যে গণ্য।
তাদের প্রত্যেকটির কথা বলা হচ্ছেঃ
১। কণ্ঠ সংঙ্গীত
চর্চা।
২। যন্ত্র
সংঙ্গীত পারদর্শিতা।
৩। নৃত্য-কলা বা
নাচ।
৪। অঙ্কন বিদ্যা
বা ছবি আঁকা।
৫। নিজ সীমন্ত
বা চুলকে সুসজ্জিত করা।
৬। নানাবিধ
পুষ্পে শয্যা সুশোভিত করা।
৭। নানাবিধ
বর্ণে গৃহ সুসজ্জিত করা।
৮। আপন দন্ত,
পোষাক-পরিচ্ছদ,
কেশ নখ
প্রত্যক্ষ বর্ণের দ্বারা সুসজ্জিত করা।
৯। বর্ণাঠ্য
প্রস্তরে ও ধাতব পদার্থে ঘর ও শয্যা সুশোভিত করা।
১০। ভিন্ন ভিন্ন
উৎসবে বা আনন্দে শয্যা নানাভাবে আস্তরণ দেওয়া।
১১। সাঁতার ও
জলকেলি।
১২। প্রিয় লোককে
আকর্ষণ করার জন্য মন্ত্রতন্ত্র অনুশীলন।
১৩। ফুল নিয়ে
মালা গাঁথা ও অঙ্গাদি সুশোভিত করা।
১৪। ফুল নিয়ে
মালার মুকুট ও বেষ্টন।
১৫। নিজের শোভন
বেশভুষা করা-এক উৎসবে এক প্রকার, অন্য উৎসবে অন্য প্রকার।
১৬। চিত্তহারী
প্রথায় কানের দুল পরিধান করা।
১৭। সুগন্ধি
দ্রব্য তৈরী করা। তৈজস পত্রাদি তৈরী সম্বন্ধে শিক্ষা করা।
১৮। নূতন ভূষণ
তৈরী বা পুরানো বিভিন্ন ধরনের অলঙ্কার নতুন করে গড়া।
১৯। অতিথিবর্গের
সন্থষ্ট করবার বিদ্যা।
২০। পরিচ্ছদ
রচনার সুচারুতা।
২১। হস্ত কৌলশ।
২২। রান্না করার পারদর্শিতা।
২৩। পানীয়
দ্রব্য তৈরী করা, বিভন্ন
মিষ্টান্ন তৈরী করা, অম্ল,
চাটনি, প্রভৃতি তৈরীতে পারদশিতা।
২৪। সেলাই ও
দেহের বস্ত্রাবরণ করতে সুদক্ষতা।
২৫। বস্ত্রখণ্ড
ও সুতা দিয়ে পাখি, পাতা,
ফুল ইত্যাদি
তৈরী করা।
২৬। বীণা ও
ডমরুর শব্দ অনুকরণ।
২৭। নানাবিধ
হেঁয়ালী রচনা।
২৮। সঙ্গে সঙ্গে
না ভেবে চিনে- কবিতা রচনা করা বা কবিতার পাদপূরণ করা।
২৯। কঠিন
অর্থপূর্ণ দুরূহ শব্দের অর্থ নিরূপণ করা।
৩০। সুমধুর
কণ্ঠে শাস্ত্রীয় শ্লোক পাঠ করা।
৩১। নাটক অভিনয়
দর্শন ও নাটকের বিভিন্ন চরিত্রের প্রকৃত সমালোচনা।
৩২। কোনও কবিতার
হারানো পংক্তির পুনরুদ্ধার করা বা তা পুনরায় নতুন করে লেখা।
৩৩। বেত বা তৃণ
থেকে নানাবিধ নতুন নতুন আসবাবপত্র রচনা বা বোনা।
৩৪। কাঠ থেকে
কুঁদে ছবি বা দৃশ্য রচনা।
৩৫। ছুতারের কাজ
এবং বাড়ি ঘর তৈরী।
৩৬। সোনা বা
রূপা ও দামী পাথর বসিয়ে নানা কাজ করা।
৩৭। রসায়ন বা
ধাতব শাস্ত্র অধ্যয়ন।
৩৮। উজ্জ্বল
পাথর ও দামী ধাতুর বস্তু রচনা।
৩৯। বাগানের কাজ
করা।
৪০। ভেড়া,
মোরগ এবং
পায়রাদের নিয়ে কৌতুকপূর্ণ খেলা করার উৎসাহ দান।
৪১। শুক,
ময়না প্রভৃতি
পাকিকে কথা শেখানো ও তাদের দিয়ে নানা কৌতুককার্য করানো।
৪২। গাত্র মর্দন
করতে শেখা, বেশভূষা
রচনা করা, কাজের
শিল্প শিক্ষা করা।
৪৩। সংবাদ
প্রাপ্তির নমুনা স্বরূপ আঙ্গুলের দাগ বোঝা।
৪৪। গুপ্ত সংবাদ
বোঝার জন্যে ভাষা শিক্ষা।
৪৫। বিভিন্ন
দেশের লিখিত ভাষা ও কথাবার্তা বোঝা।
৪৬। ঘোড়া হাতী ও যানবাহন সুসজ্জিত করা।
৪৭। সংকেত চিহ্ন
বা গুপ্ত বার্তা বোঝা।
৪৮। নানা ধরণের
যন্ত্রে জ্ঞানলাভ করা।
৪৯। স্মৃতিশক্তি
বা স্মরণশক্তি বৃদিধ করার অভ্যাস বা কি করতে পারলে বেশি কথা মনে রাখা যায়।
৫০। নানাবিধ
পুস্তক পাঠ।
৫১। নানাবিধ
পুস্তক রচনা।
৫২। অভিধান ও
বিশ্বকোষ সংগ্রহ।
৫৩। ছন্দের নিয়ম
এবং বক্তৃতা শিল্প শিক্ষা।
৫৪। লুকাবার
শিল্প, তুলা রচিত
দ্রব্যকে পশমরূপে রূপদান, সাধারণ দ্রব্যকে চিত্তাকর্ষক করে তোলা। নানা বস্ত্র
পরিধান করা।
৫৫। দাবা খেলা ও
পাশা খেলায় দক্ষতা।
৫৬। বস্ত্র
পরিচ্ছদ পরিধান করে নিজেকে অন্যের চোখে আকর্শণীয় করে তোলা। ৫৭।
শিশুদের মত পুতুল ও গোলাকার সব বস্তু নিয়ে খেলা করা।
৫৮। নানা প্রকার
শারীরিক ব্যায়াম ও কলাকৌশল শিক্ষা করা।
৫৯। রাজনীতি
শিক্ষা করা।
৬০। সামরিক
রীতিনীতি সম্পর্কে জ্ঞান।
৬১। মুখ দেখে
মানুষের চরিত্র বোঝা।
৬২। কৃত্রিম
পুষ্প রচনা শিক্ষা করা।
৬৩। কর্দম বা
নরম মাটি দ্বারা নানা ধরণের সুন্দর মূর্তি রচনা করা।
৬৪। গণিত বিষয়ে
জ্ঞান লাভ।
চৌষট্টি কলার প্রয়োজনীয়তা এই চৌষট্টি কলা ছাড়া বাভ্রব্য আরও চৌষট্টি ধরনের শিল্পকাজের কথা
বলেছেন। বাভ্রব্য ছিলেন পঞ্চাল দেশের লোক। তাই তিনি এই কথাগুলিকে পাঞ্চালী কথা বলে অভিহিত করেছেন। যে বারাঙ্গনা এই চৌষট্টি কলায় পারদর্শিনী হতে পারতেন তাঁদের বলা হতো
‘রূপ-গণিকা’
সংক্ষিপ্ত
ভাষায় গণিকা। সাধারণ মানুষ এই গণিকাকে সম্মান
করত-বর্তমানেও গণিকারা পরম আদরণীয়। রাজবংশীয় বা
অভিজাতবংশীয় মেয়েরাও এই চৌষট্টি কলা শিক্ষা করলে তারা যতাযথ আদর্শ স্থানীয় বলে গণ্য হতেন ও উত্তম পুরুষকে লাভ করতে পারতেন।
১-৪ দায়িত্ব ও কর্তব্য
পুরুষের কর্তব্য যেমন নারী তেমনি
পুরুষের পক্ষেও কলাবিদ্যা বা ভালবাসার বিজ্ঞান এমনভাবে শিক্ষা করা উচিত
যাতে তার ভার্য্যা বা উপপত্নী সন্তোষের সঙ্গে জীবন যাপন করতে পারে। বাল্যে ও কৈশোরের গুরুগৃহে বা পাঠশালায় বিদ্যা অর্জন করার পর
প্রত্যেক নাগরিকের অর্থোপার্জন করায় নিযুক্ত হওয়া অবশ্য
উচিত।
শাস্ত্রে আছে, ব্রাহ্মণ লোকের কাছ থেকে দান গ্রহণ করবে,
ক্ষত্রিয়
যুদ্ধে জয়লাভ করে কৃতিত্ব দেখাবে, বৈশ্য যুবক
ব্যবসা-বাণিজ্যে অর্থ উপার্জন করবে-আর শূদ্র
যুবক পরের সেবা করে জীবন যাপন করবে।
অর্থ উপার্জনের পর নাগরিক তার নিজের জন্যে বসত বাড়ি তৈরী করবে। সে
সর্ব প্রকার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করবে। মানুষের উচিত রাজধানীতে বা অন্য বড় শহরে বাসগৃহ নির্মাণ করা। তবে বহু গণ্যমান্য লোকের সঙ্গে তার সহৃদয়তা বা বন্ধুত্ব হয়ে থাকে। গৃহ নির্মাণ কলা বাড়ি এমন স্থানে
নির্মিত হওয়া উচিত, যাতে জল পাবার কোন কষ্ট না হয়। বাৎস্যায়ন পড়ে
মনে হয়, যে সময়ের কথা লেখা হচ্ছে সে সময় শহরে নগরে জল পাবার ব্যবস্থা ভাল ছিল না। এই বাড়ি ভিন্ন
ভিন্ন উদ্দেশ্য সাধন করতে ভিন্ন ভিন্ন অংশে গঠিত হওয়া উচিত। বাড়িতে ফুলবাগান, উদ্যান, লতাকুঞ্জ
ইত্যাদি থাকবে।
এ অংশের কক্ষগুলি দুই ভাবে বিভক্ত
হবে-বহির্বাটী ও অন্তঃপুর।
অন্তঃপুর হবে নারীদের আবাস্তবর্হিবটীতে
থাকবে, বৈঠকখানা,
যেখানে
বিভিন্ন সুরসিক জ্ঞানী বা বাণিজ্য
সম্পর্কিত লোকেরা বসে কথাবার্তা বলবে। এই বৈঠকখানায়
বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে খেলাধুলাও হতে পারে। বৈঠকখানার মেঝে মাদুরের দ্বারা
ও জানালা পট্ট বস্ত্রের দ্বারা আবৃত থাকবে। এখানে একটি সুন্দর বিছানা
থাকবে-একধারে ফুলদানীতে ফুল থাকবে। বালিশ বেশ নরম হবে। প্রধান
পর্যাঙ্কের কাছে থাকবে একটি শয্যা- সেখানে গৃহকর্তা তাঁর প্রিয় নারীদের সঙ্গে রতি কার্য করলেও শয্যা বসন সিক্ত বা কলুষিত হবে না। এর মাথার দিকে থাকবে ব্রাকেট গৃহ দেবতার একটি প্রতিচ্ছবি বা ছবি। এই ছবির নীচে থাকবে একটি টেবিল। এই টেবিলে থাকবে যে দ্রব্য তা হলো- সুগন্ধি দ্রব্য, পুষ্পমাল্য, মোমবাতি,
সুগন্ধি
পান, দাড়িম্বের
খোসা ও তাম্বুল । বিছানার তলায় থাকবে পিকদানী। এছাড়া, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য থাকতে পারে বীণা, ছবি আঁকার পাত্র,
ব্রাশ,
রঙ,
বই,
হাতীর
দাঁতের তৈরী বস্তু, পুষ্পনির্মিত স্তবক প্রভৃতি। ঘরের বিছানা
ছাড়া, বালিশ
থাকবে-সব ঘরে মাদুর বিছানা থাকা উচিত। দাবা পাশা থাকবে
ঘরে। বাইরের গৃহসজ্জা এই বৈঠকখানা
ঘরের বাইরে থাকবে বারান্দায় ময়না, টিয়া প্রভৃতি পাখি।
গ্রীষ্মকালের জন্যে থাকবে বাসগৃহের পাশে একটি বাগান। বাগানটি হবে
মনোরম। এই বাগানে একটি ছায়াযুক্ত গাছের তলে থাকবে একটি
দোলনা। এই দোলনাটি হবে সুদৃশ্য। এই বাগানে ফোয়ারা থাকলে ভাল হয়। না থাকলে,
কয়েকটি
সুদৃশ্য বেদী থাকবে। বেদীতে থাকবে সুগন্ধি ফুলচন্দন। এর চারিদিকে
লতাপাতা ও সুগন্ধি ফুলের বৃক্ষ থাকবে।
নাগরিকদের দৈনিক জীবনধারা
১। সকালে উঠে নাগরিক প্রাতঃকৃত্যাদি করবে। তার মধ্যে দাঁতমাজা,
মুখ
ধুয়ে, ফেলা
ইত্যাদি থাকবে।
২। গোসল করবে সুগন্ধি জল দিয়ে। তোয়ালে দিয়ে গা মুছবে।
৩। চন্দনাদি সুগন্ধি দ্রব্য অঙ্গে লেপন করবে। ঠোঁটে একটু লিপষ্টিক
লাগাবে। গরায় একটি মালা ঝোলাবে।
৪। একটি আয়নায় ভাল করে মুখ দেখে কেশ রচনা করবে।
৫। অবশেষে নিজের কাজে বের হবে।
সম্ভ্রান্ত নাগরিকের উচিতঃ
১। প্রত্যহ একবার গোসল করবে।
২। একদিন অন্তর ভাল করে গাত্রমর্দন বা গাত্র মার্জনা করা।
৩। প্রতি তৃতীয় দিনে মালা দরকার।
৪। প্রত্যেক চতুর্থ দিনে মুখের দাঁড়ি গোঁফ কামানো আরামদায়ক হয়ে থাকে।
৫। প্রত্যেক পঞ্চম দিনে মাথার চুল কাঁটা উচিত।
৬। প্রতি দশদিন অন্তর দেহের গোপনীয় স্থানের কেশ মুণ্ডন করা উচিত।
৭। রোদের সময় বিনা ছাতায় বের হবে না। তা হলে শরীর থেকে বেশী ঘাম বের
হতে পারে বেশী ঘাম দুর্গন্ধ যুক্ত হয়।
৮। দিবারাত্রে দুবারের বেশি ভোজন্তদুপুর ও সন্ধ্যা-প্রত্যহ দুবার
প্রধান আহারের পর উচিত প্রিয় পাখিদের কথা বলা শেখানো।
ভেড়া ইত্যাদি থাকলে তাদের কৌতুক যুদ্ধ
শেখানো।
৯। সকালে মুখ, হাত, পা, ধুয়ে কিছু
সামান্য খেয়ে বন্ধুবান্ধব প্রভৃতিদের সঙ্গে কথাবার্তা
বলবে। দুপুরে খাবার পর দিবানিদ্রা বা ঘুম হবে।
১০। দিবা নিদ্রার পর সংগীত চর্চা বা ক্রীড়া প্রভৃতি চলতে পারে।
১১। তারপর বাইরে কাজ থাকলে বের হয়ে-সন্ধ্যায় ফিরবে।
১২। বাড়ি ফিরে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা, গল্প প্রভৃতি
করতে থাকবে। তারপর বন্ধুদের বিদায়
দেব।
১৩। তাপর প্রণয়িনীদের সঙ্গে দেখা করবে-বা তার আগমন প্রতীক্ষা করবে।
সে এলে কুসুমাস্তীর্ণ শয্যায় তাকে বসাবে। মধুর নরম
বাক্য বলে তাকে আনন্দ দেবে। তার আসতে বিলম্ব হলে
তার জন্যে দূত পাঠাবে।
১৪। দূতীর বাক্যেও যদি প্রণয়িনী না আসে তা হলে নিজে তার বাড়ি যাবে,
নানা সন্তোষ করে তাকে নিয়ে আসবে। যদি বৃষ্টি থাকে ও তার গা বা বস্ত্র ভিজে
যায়, তাকে
শুকনো বস্ত্র পরিয়ে দেবে। যেন বন্ধু বান্ধবেরা সে সব কাজে সাহায্য না করে। নিজের বস্ত্রাদি ভিজে গেলেও পরিবর্তন করবে।
১৫। তারপর সবাইকে বিদায় দিয়ে প্রণয়িনীর সঙ্গে সুমধুর সম্ভাষণ করবে।
১৬। প্রণয়িনীকেই সমস্ত রাত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান দান করা অবশ্য
কর্তব্য।
যদি এ বিষয়ে কোনও ভুল হয়, তার জন্যে
প্রণয়িনীর কছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে কোন দোষ নেই। উপরে সে সব জীবন বৃত্ত লিখিত হলো, তা শুধুমাত্র
ধনী ও যার অবসর প্রচুর তাদের পক্ষেই
সম্ভব। রাতে প্রণয়িনী নিয়ে সম্ভোগ ঠিক ভাবেই হতে পারে। নৈমিত্তিক
নাগরিককৃত বা সামাজিক কর্ম উপরের
প্রাত্যহিক কর্ম ছাড়া অনেক সামাজিক কাজ ও অনুষ্ঠান নাগরিকের পালন করা উচিত। এতে নাগরিক
সমাজের মধ্যে একটি সম্মানও প্রতিষ্ঠা হয়। বাৎস্যায়ন নিুলিখিত সামাজিক অনুষ্ঠানগুলির অবশ্য পালনীয় বলছেন।
১। ঘটা নিবন্ধক দেবতার উদ্দেশ্য
অনুষ্ঠিত সব উৎসবে নাগরিকের অবশ্যই যোগদান করা উচিত। এতে দেশ বা বিদেশ
থেকে আগত শিল্পীরা সংগীত ও অন্য নানা কলা উৎসবের নৈপুণ্য দেখাতে পারে।
এতে মানব সংস্কৃতি উন্নতি লাভ করে। মাসে অন্ততঃ একবার তা অনুষ্ঠিত হওয়া
উচিত।
২। গোষ্ঠী সমন্বয় সমান বয়স্ক বা
সমান চরিত্র বা সম চরিত্রবান যুবকদের মিলন ও সমন্বয়। এতে ভাবের
আদান্তপ্রদানে প্রচুর সাহায্য হয়ে থাকে। এরূপ জন সমাবেশ
কোন সম্ভ্রান্ত রাজকর্মচারীর বৈঠকখানায় বা অলিন্দে, কোন নৃত্যকলয়ে বা বন্ধু-বান্ধবদের বহিঃকক্ষে হওয়া উচিত। এই সম্মিলনীতে
নৃত্যগীত বা কোন প্রবন্ধ পাঠ হতে পারে। নানা কলা
প্রদর্শনও এখানে হতে পারে।
৩। সমাপালক পালাক্রমে
বন্ধুদের বাড়ীতে গিয়ে সেখানে নানা প্রকার সুস্বাদু ফল নিয়ে তার সঙ্গে সুরা পান হয়ে থাকে। এতে আগে সম্মিলিত গণিকাদের সুরাপাত্র দেওয়া হয়-তাদের পান হয়ে গেলে নাগরিকবৃন্দ পান করবে। সেই সঙ্গে নানা রকম ফল
খাওয়া হয়।
৪। উদ্যান প্রমোদ ভিন্ন ভিন্ন
বন্ধুর বাগানে প্রমোদ উৎসব হয়ে থাকে। যাঁরা অংশ গ্রহণ করেন তাঁরা অশ্বে আরোহণ করে দাসদাসী নিয়ে সেখানে যাবেন। এখানে নানা খেলাধূলা,
মোরগ
লড়াই, নৃত্যগীত,
যাদুবিদ্যা
প্রভৃতি হয়ে থাকে। এইভাবে সারাদিন আনন্দে কাঠিয়ে
সন্ধ্যাবেলা বাড়ী ফিরবে। ফেরার সময় বাগান থেকে পুষ্পস্তবক ও পুষ্পমালা প্রভৃতি নিয়ে ফিরবে।
৫। উপরে যেসব উৎসব বর্ণনা করা হলো তা ছাড়া সাধারণ
নাগরিকদেরও কতকগুলি উৎসবে যোগদান করা অবশ্য কর্তব। তা এবারে একে
একে বলা হচ্ছে। (ক) দেওয়ালি উৎসব। (খ) পূর্ণিমা উৎসব বা পূর্ণিমার রাতে নানান
উৎসব। (গ)
বসন্ত উৎসব-বসন্তকালে। (ঘ) অপক্ক আম্রোৎসব (শেখর লঞ্জলিকা) আম পাকার
আগে। (ঙ)
পিষ্টক উৎসব বা পিঠে বানানো। (চ) বিশ খাদিকা-ফাল্গুন্তচৈত্র মাসে। (ছ) নব
পত্রিকা-বর্ষার প্রথমে। (জ) হোলি উৎসব। (ঝ) পাঞ্চালি
উৎসব বা ভাঁড়ামি। (ঞ) শিমুল উৎসব-শিমুল ফুল নিয়ে খেলা। (ট) কদম্ব
উৎসব-কদম্ব ফুল নিয়ে খেলা। (ঠ) যব উৎসব-যবের গুঁড়া নিয়ে খেলা। (ড) ঝুলন উৎসব।
(ঢ)
মদন উৎসব-চৈত্রমাসে মদন দেবের সম্মান। (ণ) দমনকে উৎসব-ফুল নিয়ে খেলা। (ত) অশোক
উৎসব-ফুল নিয়ে খেলা। (থ) পুষ্পচয়ণ উৎসব। (দ)
আম্রলতিকা-কচি আমপাতা নিয়ে খেলা। (ধ) ইক্ষুমঞ্জিকা-আখ খাবার প্রতিযোগিতা।
সম্ভ্রান্ত
নাগরিকের সঙ্গী ও কিংকর পীঠ মর্দ নাগরিকের সহযাত্রীদের মধ্যে পীঠ মর্দন সর্ব প্রধান। প্রেম বিজ্ঞানে
সে বিশেষ পারদর্শী। তার স্ত্রী নেই পুত্র কন্যা
নেই। সংসারে কারও হেপাজত নেবার বাধ্যবাধকতা
নেই। দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো ও প্রেম বিষয়ে অভিজ্ঞতা
সঞ্চয়ই তার জীবনের কাজ। অতি দরিদ্র সে
কিন্তু খাওয়া পরা কোনও সম্ভ্রান্ত নাগরিকের দায়িত্বে চলে।
বাৎস্যায়নের
কালে এরূপ পীঠ মর্দ প্রায়ই সম্ভ্রান্ত নাগরিকের থাকত।
বর্তমান যুগে এরূপ লোক
খুব অল্পই দেখা যায়। বিট এ আর এক প্রকারের লোক। বেশ লেখা পড়া জানা ও অভিজ্ঞ। এক কালে যথেষ্ট
ধন সম্পত্তি ছিল। কিন্তু কাম সম্ভোগে সমস্তই
হারিয়েছে। মৃচ্ছকটিক নামক বহু পুরানো সংস্কৃতি
নাটকে এরূপ একটি মানুষের অবতারণা দেখা যায়। এ সকল লোক
ধনী ও প্রভুত্ব সম্পন্ন ব্যক্তির চিত্ত জয় করে থাকে। নিজে কিছু
উপার্জন করে না। বড় লোক সঙ্গীর ব্যয়েই তার বাবুয়ানা চলে যায়। বিদূষক ইংরেজীতে যাবে
বলে ‘বাফুন্থ’
বা ‘ক্লাউন’ তাদেরই সে আমলে
বিদূষক বলা হতো। এদের অন্য নাম
ছিল ভাঁড়। ভাঁড়ামিই তার ব্যবসা। বড় বড় লোকও রাজরাজড়াদের সঙ্গী। কোনও
নারীর সঙ্গে প্রেম যুদ্ধে তিনিই হলেন ঐ ধনী রাজার বা সম্ভ্রান্ত
ব্যক্তির সাক্ষী বা দূত। বিদূষক সাধারণতঃ
অবিবাহিত এবং ব্রাহ্মণ বংশোদ্ভূত। তিনি তাঁর সম্পত্তি নষ্ট করেছিলেন। এবং সাধারণত এক দরিদ্র ব্যক্তি। রাজার বা
সম্ভ্রান্ত নায়কের বড় বড় সভায় বিদূষক অনেক কৌতুকপূর্ণ কতাবার্তা বলেন ও সভাষদবর্গকে বিভিন্ন কৌতুক দ্বারা উল্লাসিত করে থাকেন। সংস্কৃত নাটকে দেখা যায় যে এঁরা নায়কের সহচর-এঁরা অভীষ্টা নারীর
প্রতি দৌতকার্য্য করে থাকেন।
আধুনিক যুগে গোপাল ভাঁড়ের কতা সকলে জানেন সম্রাট আকবরের সভায় রসিক বীরবল ঐ বিদূষকের একটি দৃষ্টান্ত।
বিদূষকের মত কাজ
অনেক স্ত্রীলোকেরাও করে থাকে। তারা কেউ কেউ (১)
উদাসিনী-সন্ন্যাসিনী যিনি বিজ্ঞানে বিশেষ
পারদর্শিনী (২) নারী নাপতানী (৩) অসৎ দরিদ্রা নারী (৪) নিঃসন্তান নারী
(৫) কোনও বৃদ্ধ বেশ্যা তপস্বিনী। এঁরা সম্ভ্রান্ত বংশের কুল নারীদের নাগর সংগ্রহে প্রায় দূতীকার কাজ করে থকেন। দূতীর কাজ এই দূতীরা খুব
কুশলী হয়ে থাকেন। এরা নায়ক বা
নায়িকার গুণাবলী এমন সুন্দর ও বিশদভাবে বা বাড়িয়ে পরস্পরের কাছে বলে থাকেন যে তারা মুগ্ধ হতে বাধ্য হয়।
তাই
দূতীকাদের সে আমলে বিশেষ কদর ছিল-কারণ সে আমলে লোকে জানত যে দূতীকারা নারীর পক্ষে অপরিহার্য। বিশেষ করে উচ্চ
রাজ পরিবারে বা খুব উচ্চ রাজ পরিবারে বা খুব ধনী পরিবারের
পক্ষে
তারা ছিল অপরিহার্য। এই দূতীকারের
গুণাবলীও ছিল অশেষ-তারা হাস্যরস, নাট, গান ইত্যাদি
জানত।
১-৫ দূতী ও দূত কর্ম
কামসাধানায় নারী-পুরুষের বিভিন্ন ধারা শাস্ত্রমতে
কামচর্চার জন্য কোনও নারী লাভ করতে গেলে, স্ব-বর্ণীয় বা স্বজাতির কোন অবিবাহিতা কিশোরীকে শাস্ত্র ও সমাজ সম্মতভাবে বিবাহ করে
তার সঙ্গে সহবাস করা উচিত।
কিন্তু
কোনও উচ্চবংশীয় নারী বা নীচ বংশীয়া মেয়েমানুষ অথবা অন্য কোনও লোকের বিবাহিতা পত্নীর সঙ্গে সহবাস নিষিদ্ধ। উপরের
শাস্তসম্মতবাবে বিবাহিত নারীর সঙ্গে সহবাস করলে যে সন্তান বা সন্ততি জন্মায় তারাই হলো কুল প্রদীপ। এছাড়া কোনও
বারাঙ্গনা বা বিধবার সঙ্গে সহবাসে যে সন্তান হয় তারা পূর্বপুরুষের
বংশধারার স্থান পায় না। তাদের সঙ্গে সহবাসে পুরুষ বেশি সুখ উপভোগ করতে পারে, কিন্তু সন্তান বংশের ধারায় স্বীকৃত হয় না।
সহবাসের অনুমোদিত নারী তিন প্রকার
সাধারণতঃ বাৎস্যায়নের মতে দৈহিক সহবাসের জন্য অনুমোদিত-
১। সমাজসম্মতভাবে বিবাহিতা স্ত্রী।
২। বারাঙ্গনা বা পতিতা নারী
৩। বিধবা নারী। আচার্য
গণিকাপুত্র যোনিসুখের জন্য আর একশ্রেণীর নারী কথা লিখেছেন তিনি ।
(ক) অন্যের স্ত্রী
উপভোগ করা যায়; সম্পত্তি বা ধনলাভের সম্ভাবনা থাকলে। (খ)
আত্বারক্ষার্থে বা জীবন বাঁচাবার জন্য। (গ) বন্ধুত্ব দৃঢ়
করার জন্যে।
অন্যের বিবাহিতা স্ত্রীর সঙ্গে যৌনসুখ লাভ করা সাধারণতঃ পাপকার্য। কিন্তু যদি জানা যায় ঐ নারী স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষের সঙ্গে এর আগে
যৌন সহবাস করেছে বা করে তাহলে সে স্ত্রীলোক
উচ্চবংশীয় হলেও সহবাসের পক্ষে সে উপযুক্ত বলে
বিবেচিত। এতে ধর্মনাশের কোন প্রশ্ন ওঠে না। নরনারী উপভোগের
বিধিসম্মত ব্যবস্থা গণিকাপুত্রের
মতে নিুলিখিত অবস্থায় নরনারী উপভোগ বিধিসম্মত।
(১) যদি কোনও লোক
প্রতাপসম্পন্ন ও ধনবান হয় কিন্তু যদি কোন ব্যক্তির শত্রুর
সঙ্গে
যোগদান করে থাকে, তা হলে পূর্বোক্ত ধন ও প্রতাপ সম্পন্ন ব্যক্তির স্ত্রীর সঙ্গে সুবিধা হলে সহবাস করা সংগত। কেননা, তার নারীর সঙ্গে
সহবাসে, সে ব্যক্তি শত্রুর দল ছেড়ে উপপতির দলে আসতে পারে-বা স্ত্রী
তাকে আসতে প্রলুব্ধ করতে পারে।
(২) ঠিক সেই
নারীর সঙ্গে অবৈধ প্রণয় করা যেতে পারে, যার স্বামী বহু কালের পরম শত্রু বা শত্রুতা করে আসছে। এরূপ ধর্ষিতা স্ত্রী স্বামীকে বন্ধু
পদে আনতে পারে।
(৩) সে নারী তার
স্বামীকে ভবিষ্যৎ উপপতির বন্ধর দলে আনতে পারে এবং উপপতির শত্রু নাশ করেত
প্রলুব্ধ করতে পারে।
(৪) কোনও নারীর
স্বামী যদি কাও ঘরবাড়ী, সম্পত্তি বা ধনদৌলত কেড়ে নিতে থাকে, তা হলে সঙ্গে
শেষোক্ত লোক প্রণয়স্থাপন বা যৌন সহবাস করতে পারে। ফলে হয়তো ঐ ব্যক্তির স্ত্রীর সাহায্যে সে ঘরবাড়ী বা ধনদৌলত ফিরে পেতে পারে।
(৫) যে নারীর সাহায্যে কোনও পুরুষ বিপদ ছাড়া কোনও অর্থ উপার্জন করতে
পারে ঐ নারীর সঙ্গে যৌন সংসর্গ সে নিঃসন্দেহে করতে
পারে।
(৬) যে নারী
অত্যন্ত কামুক এবং তার কাম পরিতৃপ্তি না হলে উপপতির বিশেষ
নিন্দা
প্রচার করতে পারে। এরূপ নারীর সঙ্গে ব্যভিচার করতে পারে।
(৭) যে নারী তার
ঈপ্সিত পর পুরুষের বিশেষ ক্ষতি এমন কি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে,
সে
নারীকে উপভোগ করে জীবন ধন বাঁচানো যেতে পারে।
(৮) যে নারী স্বামীকে শত্রুর সঙ্গে যোগদান করিয়েছে, এমন কি নিজেকে
শত্রুর দলে মিশিয়েছে, সুযোগ ঘটলে সে
নারীর সঙ্গে কাম সম্পর্ক স্থাপন করা যায়।
(৯) যদি কোনও পুরুষ অন্য পুরষের পত্নীর সঙ্গে কাম সম্পর্ক স্থান করে তাকে-তাহলে শেষোক্ত পুরুষ প্রতিশোধ নেবার জন্যে প্রথমোক্ত পুরুষের
স্ত্রীর সঙ্গে ইচ্ছামত ব্যভিচার করতে পারে।
(১০) রাজ-অন্তঃপুর লুক্কায়িত শত্রুর অনুসন্ধান করতে পারে বলে কোন লোক
রাজার অনুগৃহীতা পরস্ত্রীর সঙ্গে কাম সম্পর্ক স্থাপন
করতে পারে।
(১১) কোন
অভীপ্সতা কুমারীকে বিবাহ করতে হলে যে নারী এ বিবাহ সফল করে দিতে পারে তার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক চলতে পারে।
(১২) যে নারীর
স্বামী কারও পত্নী বা উপপত্নীকে প্রলুব্ধ করে কেড়ে নেয়, তা হলে শেশোক্ত ব্যক্তিও ঐ নারীকে শয্যাশায়িনী করতে পারে।
(১৩) শত্রুতা থাকলে যে কোনও লোক শত্রুর স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচার করতে
পারে।
(১৪) চারায়ণ (কামশাস্ত্রের একজন লেখক), আরও বেশী সাহশী!
তিনি বলেন, রাজার ভার্য্যা অথবা অন্যান্য
রাজকর্মচারীদের নারী বা বিধবাগণ অর্থ উপার্জন সহায়তায় পথের
দিক দর্শন করে। তাই তারাও উপভোগ্যা।
(১৫) সুর্বণাভ
বলেন্তবিধবা সন্ন্যাসীনীরাও উপভোগ্র। পুরুষের
শ্রেণীবিভাগ যে কুমারী নারী কখনও কোনও পুরুষের
সঙ্গে কামক্রিয়া করেনি, সে কুমারীর নাম অনাঘ্রাত কুমারী।
কিন্তু যতোই কোনও নারী বা নারীদের সঙ্গে যৌনক্রিয়া করে থাকুক সে চিরদিন
যৌনশক্তি সম্পন্ন ও নারীদের কাম্য।
নিষিদ্ধা নারী বাৎস্যায়নের মতে
নিম্নলিখিত নারীরা চিরদিন পুরুষের সঙ্গে সঙ্গমে নিষিদ্ধ।
১। কুষ্ঠ রোগ
সংক্রান্ত নারী।
২। যক্ষ্মা
রোগগ্রস্তা নারী।
৩। উন্মাদ রোগ
আক্রান্তা নারী।
৪। জাতি বা সমাজ
পরিত্যাগী নারী।
৫। যে নারী
প্রেমের গোপন সংবাদ রক্ষণে অসমর্থা।
৬। যে নারী এত
কামুকী যে সাধারণের দৃষ্টির সামনেও যৌন সহবাস করতে প্রস্থত।
৭। বয়স্থা নারী।
৮। যে নারীর চোখ
পাটকিলে রং কিন্তু অতি শুভ্র চর্ম।
৯। যে নারী
অত্যন্ত কালো।
১০। যার মুখে বা
যোনিতে অত্যান্ত দুর্গন্থ বের হয়।
১১। নিকটাত্নীয়
(যেমন বোন পিসতুতো বোন প্রভৃতি)।
১২। নিজের
স্ত্রীর কোনও বান্ধবী।
১৩। সন্ন্যাসিনী
বা ব্রহ্মচারিণী নারী।
১৪। কোনও
আত্নীয়ের স্ত্রী।
১৫। কোনও বন্ধুর
স্ত্রী।
১৬। কোন পণ্ডিত বা
গুরু পত্নী।
১৭। রাজপত্নী।
বাভ্রব্য
বলেন, যে
নারী তার পতি ছাড়া আও পাঁচজন পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক রয়েছে তার সঙ্গে
অবাধে মিলন চলতে পারে। দূতী নির্বাচন প্রেম সম্পর্ক স্থাপন করতে দূতীর প্রয়োজন হয়ে থাকে। এই দূতীর মাধ্যমে অন্য নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা যায়।
এই
দৌত্য করার জন্য নিুলিখিত ধরণের নারী খুব প্রশস্ত।
১। বাল্যের বান্ধবী।
২। যে লোকের কোন
উপকার করা হয়েছে এমন লোক বা তার স্ত্রী।
৩। সম ব্রবসায়ী
কোন লোক বা তার স্ত্রী।
৪। সগোত্র বা
সহপাঠী বা পাঠিনী।
৫। মনের সব গোপন
কথা জানে এমন বন্ধু বা তার স্ত্রী।
৬। যাকে সব কথা বলা চলে এমন
বন্ধু বা তার স্ত্রী।
৭। যদি সমবয়সী ধাত্রীপুত্
বা ধাত্রী কণ্যা থাকে।
৮। সমবয়সী লোক একসঙ্গে বাস
করে বা তার স্ত্রী।
দৌত্য কার্য্যে
গুণ প্রথম দূত বা দূতীর কতকগুলি গুণ থাকা একান্ত
প্রয়োজন। তা হচ্ছে-
১। এরা উচ্চবংশীয়
হওয়া উচিত।
২। এরা প্রতারণা
পরায়ণ হবে না।
৩। এদের মনসি’র হবে।
৪। এরা
দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হবে।
৫। এরা লোভী বা
দূর্নীতি পরায়ণ হবে না।
৬। এরা স্বদেশে
থাকবে।
৭। অপরিচিত
লোককে গুপ্ত উদ্দেশ্য প্রকাশ করবে না কখনও।
নিম্নজাতির দূতী চারায়ণ বলেন, নীচজাতীয় লোকের সঙ্গেও বন্ধুত্ব স্থাপন করা
যায়-দূত নির্বাচনও করা যায়। তা
হলো-
১। রজক বা ধোপা।
২। নাপিত।
৩। বাগানের
মালী!
৪। গন্ধ বা আতর ব্যবসায়ী।
৫। মদ্য
বিক্রেতা।
৬। স্বর্ণকার।
৭। পীঠ মর্দ
(বিলাস শিক্ষক)
৮। বিট (যে
নায়িকা বেশ্যার বিশ্বস্ত)
৯। বিদূষক (ভাঁড়
জাতীয় লোক)।
এই
নয় ধরনের লোকেরা প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে যেতে পারে, তাই সফল হয়।
অবশ্য বুদ্ধিমান লোক হওয়া উচিত, এদের পত্নীদের
সঙ্গে কথাবার্তা বলা। এর কারণ হলো
নারীই পুরুষদের দোষগুণ সম্পর্কে সংবাদ সহজে সংগ্রহ করে দিতে পারে। বিশেষ দূতীর গূণ যে লোক অতি সহজে বারাঙ্গনাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্পর্ক স্থাপন করতে
পারে আবার বিলাসী লোকদেরও বন্ধু হয়, সেই লোকই সহজে
প্রণয়িনী জোগাড় করতে পারে। কিন্তু এ কাজটি
খুব সহজ নয়।
এর জন্যে যে
গুণগুলি অবশ্যই থাকা দরকার তা এখানে বলা হচ্ছে-
১। যে অবস্থা
অনুযায়ী ব্যবস্থা করতে হবে।
২। সে বিশেষ
ভাবে সাহসী ও সব কাজে অগ্রসর হবার মত মনের বল রাখবে।
৩। সে লোকদের
এমন গুণ থাকবে, যে কোনও লোকের মুখ দেখেই তার মনের ভাব বুঝতে
পারবে।
৪। সহজে তার মন
দমবে না।
৫। অপরের মনের
গোপন কথা না বললেও, বুঝতে পারবে।
৬। স্থান ও কাল
বুঝে উচিত মত পরিবর্তনের পারদর্শিতা থাকবে।
এর পর পড়ুনঃ
কামসূত্রে পত্নীলাভ
__ কামসূত্রঃ পর্ব
– ২
http://banglamoon.blogspot.com/2015/04/blog-post_3.html
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন